সর্বজন গ্রাহ্য মুক্ত সমাজের অন্বেষণে






 দীপেন্দু চৌধুরী 

নতুন করে শুনতে হচ্ছে কি আমাদের, নতুন ভাষায়? সম্ভবত না। কারণ ভারতে অর্থনৈতিক উদারীকরণের সুফল বা কুফল যাই দেশেবাসী পেয়ে থাকুক না কেন বিতর্ক আজও থেকে গেছে। ভবিষ্যতেও এই বিষয়ে আরও গভীরে আলোচনা হবে। বিশ্বায়নের শর্ত হোক বা নাই হোক ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ তিন তিনটে দশক পেরিয়ে এল। অর্থাৎ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্থান করে নিয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের ঐতিহাসিক এই পদক্ষেপ।তিন দশকের পরে যে কোনও নীতি, ঘটনা পরম্পরা ইতিহাসের পাতায় পাকাপাকিভাবে স্থান পায়। ইতিহাস স্বীকৃত বিষয় হিসেবে ভারতের উদার অর্থনীতিও এক ঐতিহাসিক ঘটনা। উদার অর্থনীতির কারণে ভারতীয় সমাজের কাঠামোগত যে পরিবর্তন হয়েছে তার সুফল দেশের নিচু তলার মানুষের কাছে পৌঁছয়নি। সম্প্রতি এই মতকে সমর্থন করেছেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এরিক মাসকিন। চলতি বছরের ১ অগস্ট ভারতের এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভার্চুয়াল বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, বিশ্বায়নের পরে ভারতের জিডিপি প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি তার সুফল পায়নি। আমেরিকার নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ তাঁর তাত্বিক পর্যবেক্ষণের ব্যখ্যায় আলোকপাত করে বলেছেন, ‘’বিশ্বায়ন এক প্রজন্মের মধ্যে ভারতের অর্থনীতিকে তিন গুণ বাড়িয়েছে। যে সাফল্য অভূতপূর্ব। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি এই সাফল্যের সুফল পুরোপুরি পায়নি।…… আগামী দিনে আর্থিক বৈষম্যের বিপুল চ্যলেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে ভারতকে। যা অতিমারির মোকাবিলার চেয়েও কঠিন।‘’

ভারতে উদার অর্থনীতির জনক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা অর্থমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ জানিয়েছেন, সামনের রাস্তা যথেষ্ট অমসৃণ। বিষয়টা অর্থনীতিতে বিদগ্ধ পণ্ডিতদের বিষয়। আমরা বেশি দৌড়ঝাঁপ করলে কুট্টিদের ভাষায় কত্তা ‘ঘুড়াই  হাসবে’। মুজতবা আলি থাকলে বলতেন, নিজের ভাষা বাংলা ভাষায় কথা বল। অর্থনীতির ভাষায় কথা বলার কাম তোমার নয়। তাই অর্থনীতিবিদ এরিক মাসকিনের আরও একটি ব্যাখ্যা উল্লেখ করে নিজের বিষয়ে যেতে চাইছি। মাসকিন বলছেন, গত ২৫ বছরে সারা বিশ্বের বিপুল আর্থিক বৃদ্ধির মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বৈষম্য বেড়েছে। সাধারণ ঞ্জানে আমরা জানি বৈষম্য বাড়ার অন্যতম কারণ অসম বন্টন। বামপন্থী ও উদার গণতন্ত্রের সমর্থক সমাজকর্মীদের ভাষা যে দাবি করে থাকে। ‘সিভিল সোসাইটি’-র প্রতিনিধিদের ভাষায় এক ধরণের শোষণের জন্য এই বৈষম্য বাড়ে। একটি উদাহারণ তুলে দেওয়া যেতে পারে। দু’তিন মাস আগে দারিদ্রের পরিসংখ্যানে দাবি করা হচ্ছিল ভারতে ২৩ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে নেমে গেছে। সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যম দাবি করছে, আমাদের দেশে ২৭ কোটি মানুষ দশ বছর আগেই দারিদ্র সীমার সীমার উপরে উঠে এসছিল। আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায়, আর্থিক বৈষম্য কতটা প্রকট হলে একটি দেশের মানুষের এই পরিসংখ্যান আমাদের লিখতে হয়।

উদার অর্থনীতির মানদন্ডে বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকার বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে সামাজিক কাঠামো উন্নয়নের তাগিদে।  একুশ শতাব্দীর শুরুতেও সরকার জনকল্যাণমূলক বেশ কিছু কর্মসূচী নিলেও সেই কর্মসূচীর সুফল গরিব মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছয়নি। বিশেষত একশো দিনের কাজ (এমএনরেগা), যে প্রকল্পকে মাইল ফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়াও শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রেও সরকারের উন্নয়ন মূলক প্রকল্প থাকলেও সেই সব প্রকল্পের সুযোগ প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিচু তলার মানুষের কাছে পৌঁচচ্ছে না। বিভিন্ন স্তর হয়ে আসা এই সব প্রকল্পের টাকা অথবা চাল, গম বা অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী মধ্যসত্বভোগীদের সংগঠিত দল অত্যন্ত সুচারু দক্ষতায় হজম করে নিচ্ছে। সামন্ততান্ত্রিক এবং আমলাতান্ত্রিক পরম্পরাগত সেই ট্র্যাডিশননাল সংস্কৃতি আজও রয়ে গেল। সমাজবিঞ্জানীদের অভিমত নাগরিক সমাজের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার জন্যই ফোরেদের আধিপত্য আরও মসৃণভাষায় আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছে। একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকে উঁকি দিয়েছিল ‘মুক্ত এক সমাজ’-র আকাশ দেখার। যে আকাশ থেকে টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়বে। আমরা উদার সংসদীয় গণতন্ত্রের আস্বাদ গ্রহণ করব। কিন্তু তারপর ভারতের উদার গণতন্ত্রের অনুভবি আলিঙ্গন থেকে ক্রমেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম।

এই বিচ্ছিন্নতার দায় বর্তায় দেশের অত্যন্ত শক্তিশালী ‘নাগরিক সমাজ’-র উপর। রাষ্ট্রের রক্ত চক্ষুর শাসন না আত্মসমর্পণ? দেশের নাগরিকদের ভরসা করার মতো সিভিল সোসাইটির প্রথম সারির অন্যতম উজ্জ্বল মুখগুলির  উচ্চকিত স্বর কেমন করে যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে। কেন? সিভিল সোসাইটির ব্যর্থতা? রাজনৈতিক এক বিশ্লেষক বন্ধু উদাহারণ দিচ্ছিলেন পূর্ব ইউরোপের পোলান্ডের ‘সলিডারিটি’ আন্দোলনের। মুক্ত সমাজ বা মুক্ত গণতন্ত্রের দাবিতে এই আন্দোলন হয়েছিল। কম্যুনিস্ট শাসনকালেও সেই দেশে চার্চ থেকে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। সারা দেশের মানুষ বন্দিত্বের শৃঙ্খল থেকে বেরতে চাইছিলেন। চার্চ নামক একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে মানুষকে মুক্ত গণতন্ত্রের আলো দিতে চেয়েছিল। নেতৃত্বে ছিলেন সলিডারিটি আন্দোলনের প্রধান পুরোহিত ওয়ালেসা। কিন্তু তিনিও পারেননি। ক্ষমাহীন ইতিহাসের খাতায় তাঁর নাম উঠে গেল পরাজিত গণনায়ক হিসেবে।রাজনৈতিক বিশ্লেষক বন্ধু বলছিলেন, পোলান্ডে সিভিল সোসাইটি আন্দোলন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে হয়েছিল। কারন গণতন্ত্রের মধেই যে শক্তি নিহিত থাকে নাগরিকদের স্বাধীনতা, সত্তার অধিকার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রক্রিয়ায়। সেই শক্তির কাছে মুক্ত সমাজ আন্দোলনের নাগরিক সমাজ মুখ থুবড়ে পড়ে। সিভিল সোসাইটির আন্দোলন নেতৃত্বের অভাবে পথ হারিয়ে ফেলে।  

স্মরণ করা যাক পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগত সিংহ এবং জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের প্রসঙ্গ। তারা ভারতবাসীকে পথ দেখিয়েছিলেন। মুক্ত চিন্তা, মুক্ত সমাজ গড়ে তোলার আন্দোলনই অন্যতম দাবিদার ‘সহিষ্ণু ভারত’ নামক এক রাষ্ট্রের। যে রাষ্ট্র হবে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য মাঙ্গলিক রাষ্ট্র। মনে পড়ছে, নোবেলজয়ী সাহিত্যক অ্যালেকজান্ডার সোলঝনিৎসনের কথা। আমেরিকা গেছেন তিনি। খ্যাতনামা একটি প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে বক্তৃতা করতে। বিদগ্ধ মার্কিন শ্রোতা নোবেলজয়ী লেখকের বক্তব্য শোনার জন্য অধীর অপেক্ষায় সভাঘরে বসে আছেন। আলো ঝলমলে ঘরে বসে শ্রোতাদের প্রত্যেকেই ভাবছে, এক সময়ে সোভিয়েত দেশ থেকে বিতাড়িত বিশ্বের  মানবাধিকার রক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ লেখক কি বলতে পারেন। সভঘরের মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আধুনিক গণতন্ত্রের শর্ত পূরন করা মার্কিন দেশের নাগরিক তাঁরা। বর্ণ বিদ্বেষের বিতর্ক নিয়েই তাঁদের উদার গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াতে হয়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সোলঝনিৎসন বক্তব্য শুরু করলেন, আপনারা আমার দেশে যাচ্ছেন, আমার দেশের অনেক উন্নতি করতে আগ্রহী আপনারা। এ জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে আপনাদের সভ্যতা আমার দেশে রপ্তানি করবেন না। সিভিল সোসাইটি কোন সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে রুশ সাহিত্যিকের ভাষায় আমার সেটা বুঝতে পারি। সত্যের পথ মানুষই রচনা করে। নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠে।

অতি পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গর্বিত শাসনকালেই অবিভক্ত ভারতে সিভিল সোসাইটি আন্দোলন শুরু হয়েছিল।  বলতে পারি আমরা। উনবিংশ শতকের বাঙালি, ইংরেজ শাসনের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। বোমা, পিস্তল, বারুদ দিয়ে নয়। বুদ্ধির শক্তিতে এই লড়াই সেদিন লড়েছিল উনবিংশ শতকের বাঙালি। বাংলা ভাষায় লেখা সাহিত্যের বাস্তব অভিব্যক্তি, মুক্ত-সংস্কৃতি চর্চা ছিল বাংলার নবজাগরণের অপ্রত্যাশিত সোপান। সামনে রাজা রামমোহন রায়। তাঁর চিন্তায় তিনটে ধারার প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন ভারতের ব্রহ্মবাদীদের মরমী সাধনা, মধ্যযুগের সুফীদের মানবপন্থার ও সম্প্রীতির সাধনা। এবং আধুনিক কালের ইউরোপেীয়দের বস্তুনিষ্ঠ সাধনা। রামমোহনের চিন্তা ও পথ ধরেই আধুনিক ভারতের গঠন। পরবর্তীতে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আর্থসামাজিক সমস্যা হোক বা আর্থরাজনৈতিক বাঁক প্রতিটি ক্ষেত্রেই সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিরা নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছেন। সেক্ষেত্রে দেখা গেছে, মুক্ত সমাজ একটি সর্বজনগ্রাহ্য কর্মসূচীর আহ্বান করে। মানুষের মঙ্গলের জন্য আমাদের সময় দিতে হবে। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আস্তে হবে। জাত-পাত-র মতো সামন্ততান্ত্রিক বিষয়গুলিকে মুক্ত সামজ-সংস্কৃতির আলোয় দেখতে শেখা উচিত। সমাজকে, রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। পরিবেশ দূষণ মুক্ত করার দায়িত্ব মুক্ত সমাজকেই নিতে হবে। তবেই যথার্থভাবে মুক্ত সমাজ চিন্তার কথা আমরা বলতে পারব।                                                                                     

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?