ভোটমুখী তিন রাজ্যে আছড়ে পড়বে কৃষক আন্দোলনের ঢেউ।







 দীপেন্দু চৌধুরী

কৃষকরা কি ‘মাওয়ালি’ মানে গুন্ডা? সেই গুন্ডা(পড়ুন আন্দোলনরত কৃষক)দের অধিকারকে সমর্থন করে ২৬ জুলাই রাহুল গাঁধি লাল ট্র্যাক্টর চালিয়ে সংসদে চলে গেলেন? তিন কৃষি আইন বাতিলের জন্য গত আট মাস দিল্লির সীমানায় রাস্তায় বসে যারা আন্দোলন করছে, তাঁদের সমর্থন করে সংসদের সামনে লাল ট্র্যাক্টরের উপরে বসেই রাহুল বলেন, ‘আমরা কৃষকদের বার্তা সংসদে নিয়ে এসেছি। সংসদে এ বিষয়ে আলোচনা করতে দেওয়া হচ্ছে না। তিন কালো আইন প্রত্যাহার করতে হবে। কৃষি আইন দু’তিন জন শিল্পপতিকে ফায়দা পাইয়ে দিতে আনা হয়েছে। কৃষকদের ফায়দার জন্য নয়। সরকার এমন ভাব দেখাচ্ছে, চাষিরা খুবই খুশি। আসলে তাঁদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।‘’ কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেছেন, ‘আমরা গুন্ডা নই। অন্নদাতা।’ গত আটমাস একটানা তিন বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকরা দিল্লির সীমানায় আন্দোলনে বসে আছেন। করোনা আবহে তারা আজও বসে আছেন। ৫০০-র  বেশি কৃষকের মৃত্যু হয়েছে এই আন্দোলনের সমর্থনে ধর্ণায় বসে। দিল্লির কনকনে শীত, প্রখর গ্রীষ্মে সূর্যের লেলিহান তাপ, করোনার প্রকোপ, পুলিশের লাঠি, সরকারের প্ররোচনা কিছুই দমাতে পারেনি কৃষক আন্দোলনের প্রবাহকে। অনমনীয় দৃঢ়তায় তারা আন্দোলনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গোদী মিডিয়া সরকারের অঙ্গুলি হিলনে খবর সেন্সরশিপ করলেও যারা খবর রাখেন, তাঁদের কাছে খবর ঠিক পৌঁছে যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে এই ধরণের আন্দোলন সারা দেশে খুব একটা নজরে পড়েনি। শুধু মোদী সরকারের কোনও হেলদোল নেই। কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমর বলছেন, আইনের কোথায় আপত্তি, সেটা কৃষকরা বলতে পারছেন না।

এটা যে কতটা অসত্য সেটা বোঝা যাবে গত আট মাসে কৃষক নেতৃত্বের সঙ্গে কেন্দ্রের কয়েক দফা বৈঠকগুলির পর্যালোচনা করলে। কৃষকরা আলোচনার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেও কেন্দ্রের তরফে চরম অপেশাদারিত্ব দেখানো হয়েছিল। কৃষকদের দাবি মান্ডী ব্যবস্থা তুলে দেওয়া চলবে না। আগের মতই ন্যুনতম সহায়ক মূল্য(এমএসপি)  ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। অর্থাৎ নতুন আইনে পুরনো দুটি ব্যবস্থার উল্লেখ করতে হবে। সরকার এই সব দাবির বিষয়ে কোনরকম সহমত দেখাতে রাজি ছিল না। তার প্রতিবাদে কৃষক নেতৃত্ব সরকারের তরফে দেওয়া সৌজন্যমূলক দ্বিপ্রাহরিক আহারের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। বৈঠক চলাকালীন দুপুরে এক ঘণ্টা বিরতির সময় কৃষক নেতৃত্ব সভাঘরের মেঝেয় বসে নিজেদের দুপুরের খাবার খেয়েছেন। কৃষি সভ্যতায় যে সংস্কৃতিতে তারা অভ্যস্ত। সাহেবি ঘরানার টেবিল চেয়ার নয়। বাড়ির মেঝেয় বসে একসঙ্গে কৃষক পরিবার খেতে অভ্যস্ত। যৌথ পরিবারের সংস্কৃতি। সেই ধারা মেনেই তারা মেঝেই একসঙ্গে বসে নিজেদের আনা খাবার খেয়েছিলেন।

কৃষক নেতৃত্বের প্রতীকী এই প্রতিবাদের পরেও কেন্দ্রের কৃষিমন্ত্রী সহ প্রতিনিধিত্বকারী অন্যান্য মন্ত্রীদের অমানবিক আচরণের কোনও পরিবর্তন হয়নি। উল্টে সরকারের তরফে বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক কৌশলে কৃষক আন্দোলনে চিড় ধরানোর প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেছে। ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনের তিক্ত অভিঞ্জতা সচেতন পাঠকদের মনে থাকবে আশা করা যায়। সেই খবরও গোদী মিডিয়া উপেক্ষা করে সরকারের দেওয়া বক্তব্য বড় করে নিজেদের কাগজে ছেপেছে। সরকার নির্দেশিত খবর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তাৎক্ষনিক খবর হিসেবে বড় করে হাইলাইট করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যের উত্তর চাছাছোলা ভাষায় দিয়েছেন কৃষক সভার নেতা হান্নান মোল্লা। তিনি বলেছেন, ‘’আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় আইনের প্রতিটি ধারা দেখিয়ে আমাদের আপত্তি জানিয়ে এসেছিলাম।‘’      

তবু কৃষকরা আন্দোলন তুলে নিয়ে পিছিয়ে আসেননি। একটানা ধর্ণা আন্দোলনের সঙ্গে আরও এক প্রতীকী আন্দোলন সম্প্রতি আমরা দেখতে পেলাম। শেষ পর্যন্ত কৃষকরা রাজধানীতে ঢোকার অনুমতি পেলেন। অনুমতি দেওয়া হয়েছিল মাত্র ২০০ জনকে।  সাধারণ কৃষক সহ কয়েক জন নেতাকে নকল সংসদে বসার অনুমতি দেয় পুলিশ। ২৬ জুলাই দিল্লি-হরিয়ানা সীমানায় ছিল পুলিশের ব্যারিকেড। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। হাতে লাঠি পড়নে খাকি উর্দি তাঁদের। পাশে চলে এসছে সরকারের সশস্ত্র আধা সেনাদের বাহিনী। এতটাই কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে নিয়ে আসা হয়েছিল দিলি-হরিয়ানা সীমান্তকে। মাছি গলার কোনও সুযোগ ছিল না অকুস্থলে। কি হচ্ছিল সেখানে? ‘কৃষক সংসদ’। সংসদ ভবন থেকে খুব বেশি হলে এক মাইল দূরে কৃষক সংসদ বসেছিল। যন্তর মন্তরের ফুটপাতে কৃষকদের ‘নকল সংসদ’-এ বাদল অধিবেশন বসেছিল। অধিবেশনের নিয়ম মেনে ছিল স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার। সংযোজিত নতুন কৃষি আইনের প্রতিটি ধারা ধরে ধরে আলোচনা করছেন ‘কৃষক সংসদ’-র সাংসদরা। ২৬ জুলাইয়ের অহিংস এই  আন্দোলনও বিশ্বায়ন উত্তর ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ঘরানায় এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করল বলা যায়। সরকারেরে নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ আমরা আগেই বলেছি। কৃষক নেতৃত্বের প্রশ্ন সংসদের অধিবেশনের সময় সাংসদদের নিরাপত্তার জন্য আটশো-ন’শো জন পুলিশ সহ নিরাপত্তাকর্মীরা মোতায়েন থাকে। মাত্র ২০০ জন কৃষক নেতার জন্য তার কয়েকগুণ বেশি নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়েছিল সেদিন। দেশের চতুর্থস্তম্ভের প্রতিনিধি সাংবাদিকদেরও সেদিন যন্তর মন্তরের সংসদে প্রথমে অনুমতি ছিল না। কৃষক সংসদের খবর সংগ্রহের। পরে দিল্লি পুলিশ অনুমতি দেয়। বিজেপি সরকারের নতুন মন্ত্রী মীনাক্ষী লেখি আক্রমণাত্বক ভাষায় বলেন, ওরা কৃষক নন, ‘মাওয়ালি’। অর্থাৎ গুন্ডা। নতুন মন্ত্রীর যুক্তি ২৬ জানুয়ারি কৃষকদের মিছিল থেকেই যে হামলা হয়েছিল সেটা ফৌজদারি অপরাধ হয়েছিল। বিরোধীরা এ সবে মদত দিচ্ছে। মীনাক্ষী লেখিকে বলব, আপনি আইনজীবী এবং মন্ত্রী আশা করি দায়িত্ব নিয়ে কথা বলবেন। ২৬ জানুয়ারি হামলার ষড়যন্ত্রের কারণে কাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল? এনডিটিভি সহ একাধিক চ্যানেলে আসল সত্যটা দেশবাসী দেখেছে। যে কথা কৃষক সংসদে নেতৃত্ব বলছেন। আমরা অশিক্ষিত, মূর্খ নই। বিরোধীরা আমাদের যা বোঝাবেন আমদের তাই বুঝতে হবে? কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেছেন, ‘আমরা গুন্ডা নই। অন্নদাতা।’ যোগেন্দ্র যাদব বলেছেন, ‘টিভির পর্দায় দেখা যাচ্ছে না বলে কৃষক আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি।‘’   

উল্লেখ করা যায়, রাহুল গাঁধি ২৬ জুলাই কৃষক-বিক্ষোভকে সমর্থন জানিয়ে শুধুমাত্র ট্র্যাক্টর চালিয়ে ছ’জন কংগ্রেস নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সংসদে জাননি। রাহুল গাঁধি সহ কংগ্রেস সাংসদরা সেদিন সংসদ চতব্রে গাঁধি মূর্তির সামনে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। ওই দিন দিল্লিতে কৃষক মহিলাদের ধর্নায় অংশ নিতে চাইলে কংগ্রেসের এক শীর্ষ  নেত্রীকে পুলিশ নজরবন্দি করে রাখে বলে তারা অভিযোগ করেছেন। কৃষক নেতৃত্ব প্রশ্ন তুলেছেন ১৩ অগস্ট পর্যন্ত কৃষকদের সংসদ চলবে। প্রতিদিন কি ২০০ জন কৃষক নেতার জন্য এত পুলিশি নিরাপত্তা থাকবে? যদিও পুলিশ কতৃপক্ষ উত্তরে কিছু বলতে চাইছেন না। কারণ পুলিশ কর্তাদের কাছে খবর আছে ২০০ জন কৃষক নেতার পিছনে দেশের ২০ কোটি কৃষক আছেন। তিন কালা আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলন তুলে নেওয়াতো অনেক দূরের কথা। কৃষকরা আরও বড় আন্দোলনে যাচ্ছেন। ১৩ অগস্টের পরে শুধু মহিলা আন্দোলনকারীদের নিয়ে ‘মহিলা কৃষক সংসদ’ হবে। ভারতীয় কিসান ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকায়েত জানিয়েছেন, ভোটমুখী রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, উত্তরাখন্ডে কৃষক আন্দোলন শুরু হবে। কৃষকরা চারদিক থেকে দিল্লির মতো লখনউকে ঘিরে ফেলবে। মোরদাবাদ, হাপুড়, অমরোহা থেকে কৃষকরা দিল্লি এসে ১৫ অগস্ট ট্র্যাক্টর অভিযান করবেন। বিজেপি নেত্রী তথা নতুন মন্ত্রী মীনাক্ষীজি তখন আবার কি বলেন শোনার অপেক্ষায় তাক্লাম। কৃষক নেতার বক্তব্য, প্রয়োজনে ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন থেকে ওই সব রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা হবে। এখন কি আমরা বলতে পারি, বিজেপির শক্তি কমছে, ওরা ভয় পাচ্ছে!  সামনে কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন। মোদি সরকার কি ভয় পাচ্ছে ভারতীয় অন্নদাতা কিসানদের।         

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?