গ্রীক পক্ষীরাজ ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তির উপর ছুটছে
দীপেন্দু চৌধুরী
যত দূর মনে করতে পারছি তারিখটা ১৫ জুলাই হবে। সাংবাদিক বন্ধু
চন্দ্র রায় চৌধুরী(নাম পরিবর্তিত)-র ফোন পেলাম। চন্দ্র বলল, এই জান আজ হঠাত আমার অ্যান্ড্রয়েড
ফোনের গত কয়েক বছরের ফোন রেকর্ডিং ডিলিট করে দেওয়া হল। প্রশ্ন করেছিলাম, তোমার ফোনের
কল রেকর্ডিং তুমি না করলে ডিলিট করবে কে? আর কেনই বা করবে? আমার সমবয়সী বন্ধু হেসে
বলেছিল, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে কে লড়াই করবে? চন্দ্রের কথা মেনে নিয়েছিলাম। খুব স্বাভাবিক
কিন্তু মনে মনে প্রশ্ন করেছিলাম সংবিধানে বাক স্বাধীনতা, ব্যক্তি পরিসরকে মৌলিক অধিকারের
স্বীকৃতি দেওয়া আছে। সেই অধিকার থেকে কি আমরা বঞ্চিত হচ্ছি না? আমার মনের কথা কেউ পড়তে
পারেনি। কিন্তু ফোনে আড়িপাতার এত বড় কেলঙ্কারির জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে কে জানত?
১৯ জুলাইয়ের দেশের সমস্ত প্রভাতি সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল গ্রীক পক্ষীরাজ (পেগাসাস)
ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তির উপর দিয়ে ছুটছে। আড়ি পাতার কেলেঙ্কারিতে বিদ্ধ মোদী সরকার। এখনও
পর্যন্ত জানা গিয়েছে, পেগাসাস স্পাইওয়্যার ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও-র তৈরি সফটওয়্যার।
এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে যে কোনও দেশের যে কেউ তাঁর শ্ত্রুপক্ষের মোবাইল ফোনে আড়ি পাততে
পারে।
২০১৯ সাল থেকে ভারত সহ বিভিন্ন দেশের ১৬টি সংবাদমাধ্যমের যৌথ
উদ্যোগে ‘পেগাসাস প্রকল্প’ নামে তদন্তের কাজ চলছিল। ১৮ জুলাই সেই তদন্ত আমাদের সামনে
এসেছে। ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে মোদী সরকার ভারতে ৩০০র বেশি ফোনে ‘পেগাসাস’-র
মাধ্যমে আড়ি পেতেছিল। ‘পেগাসাস প্রোজেক্ট’ তদন্ত রিপোর্টে এই দাবি করা হয়েছে। ভারতে
‘দ্য ওয়্যার’ নামের একটি জনপ্রিয় পোর্টাল এই তথ্য ভাণ্ডার নিজেদের হাতে পেয়েছে। ‘দ্য
ওয়্যার’ জানিয়েছে, ২০১৯ সালেও আড়ি পাতার অভিযোগ সামনে এসেছিল। টরন্টো ইউনিভার্সিটির
সিটিজেন ল্যাব জানিয়েছিল, ভারতের প্রায় ২৪ জন সাংবাদিক থেকে শুরু করে প্রিয়াঙ্কা গাঁধি
বঢড়া, প্রফুল্ল প্যাটেলের মতো রাজনীতিক এবং কয়েকজন সমাজকর্মীর ফোনে আড়ি পাতা হয়। এই
অস্ত্র ব্যবহারে যে লাইসেন্স কিনতে হয় তার দাম আনুমানিক ৭০-৮০ লক্ষ ডলার। তথ্যপ্রযুক্তি
বিশেষঞ্জদের অভিমত ১০ জনের ফোন হ্যাক করতে প্রায় ৯ কোটি টাকা খরচ হতে পারে।
২০১৯ সালেই সংসদে প্রশ্ন উঠেছিল মোদী সরকার কি পেগাসাস স্পাইওয়্যার
কিনেছে? লোকসভার অধিবেশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই প্রশ্নের উত্তরে বিরোধীদের তোলা অভিযোগ
যেমন অস্বীকার করেনি আবার মেনে নিতেও চায়নি। তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী রবিশঙ্কর
প্রসাদ বলেছিলেন, আড়ি পাতার কোনও বেআইনি নির্দেশ দেওয়া হয়নি। এই কথা থেকেই অনুমান করা
যায় আইনি নির্দেশ দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে যাদের ফোনে আড়ি
পাতার অভিযোগ উঠছে তারা কি রাষ্ট্র বিরোধী? তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক এবারেও পেগাসাস কাজে
লাগানোর অভিযোগকে অস্বীকার করতে চাইছে না। মন্ত্রকের তরফে জানান হয়েছে, ব্যক্তি পরিসরের
অধিকার মৌলিক অধিকার। তার প্রতি সরকার দায়বদ্ধ।
এই লেখা লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে চন্দ্রের বলা কথা। আধুনিক প্রযুক্তির
সঙ্গে কে লড়াই করবে? এই উচ্চারণ থেকে আমাদের মনে হচ্ছে না? আমরা অতি শক্তিশালী এক রাষ্ট্রের
কাছে কত অসহায়! আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের পরিসর সরকারের দখলে! দেশের নাগরিকরা পারিবারিক
গোপনীয়তা, সামাজিক গোপনীয়তা তথা রাজনৈতিক গোপনীয়তা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত জীবনের
গোপন পরিসর বলে আর কিছু থাকবে না? আমার সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা বলেও কিছু থাকবে না? একোন
দেশ? যে দেশে আমাদের জীবনেও ‘সীমান্ত সীমাবদ্ধতা’ নিয়ে থাকতে হবে? কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায়
কি বলব ‘নিহিত পাতাল ছায়া’! কবি তাঁর ‘পোকা’ কবিতায় লিখছেন, ‘’খেয়ে যা, খেয়ে যা, খা/
দেয়ালের মধ্য খুড়ে জল।/ বাহিরে ভরসা ছিল এতকাল শাদা/ কোথা হতে নীলাভ গরল- দেয়ালের মধ্যবুকে
জল।‘’
রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বলি অথবা প্রশাসনিক ‘তথ্যপ্রযুক্তির’ উঠোনে
এই নীরব যুদ্ধের হাতিয়ার ব্যবহারকে আমাদের মেনে নিতে হবে? রাহুল গাঁধি বলেছেন, ‘ওটা
স্পাইওয়্যার নয়, যুদ্ধাস্ত্র’। আমাদের অজান্তে
এ কোন ঘুণপোকার অসংসদীয় আক্রমণ? বিরোধীদের কন্ঠরোধ করার জন্য এই হাতিয়ার ব্যবহার করা
হয়েছে বলে ইতিমধ্যেই কংগ্রেস, শিবসেনা, তৃণমূল এবং বামেরা অভিযোগ করেছে। পেগাসাসের
ফাঁদে এনডিএ সরকারের মন্ত্রী থেকে বিরোধী দলের নেতা সবাই। পেগাসাস ফোন চরের তালিকায়
যাদের নাম পাওয়া গেছে, কংগ্রেসের রাহুল গাঁধি সহ তার ঘনিষ্ঠ বলয়ের পাঁচজন। তৃণমূল কংগ্রেসের
সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর। রাজ্যের বিধানসভা
নির্বাচনের আগে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে মমতার বৈঠকও পেগাসাসে আড়ি পাতার কবলে
পড়েছিল। এমনটাই অভিযোগ তৃণমূলের। পেগাসাস নজরদারির আওতায় সেনা গোয়েন্দা কর্তাও।
এই কেলেঙ্কারি সামনে আসার পড়ে তড়িঘড়ি করে পেগাসাস তদন্তে দুই
সদস্যের তদন্ত কমিশন গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নবান্ন। রাজ্যের গড়ে দেওয়া কমিশনের দুই
সদস্য যথাক্রমে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মদন ভীমরাও লোকুর ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জ্যোতির্ময়
ভট্টাচার্য। তারা ফোনে আড়ি পাতার তদন্ত করবেন।যদিও তৃণমূল সরকারের এই কমিশন গড়ার এক্তিয়ার
নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী দল বিজেপি সহ বাম এবং কংগ্রেস।
সুপ্রিম কোর্টের একজন কর্মরত বিচারপতির ফোনও মোদী সরকারের নজরদারির
আওতায় ছিল। দাবি পেগাসাস প্রোজেক্টের। নজরবন্দি সাংবাদিকরাও । কেন্দ্র দাবি করছে নির্দিষ্ট
ব্যক্তিদের উপরে সরকারি অভিযোগ ভিত্তিহীন। ফোনে আড়ি পাতা, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে নজরদারিতে
সরকারের অনুমতি আছে। সরকারের আইন মেনেই ফোনে আড়ি পাতা হয়।সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী করুণা
নন্দী সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ‘পেগাসাসের সাহায্যে ফোন হ্যাকিং আইনত অপরাধ। তথ্যপ্রযুক্তি
আইনের ৪৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী সরকার কারও ফোন হ্যাক করতে পারে না। মোবাইল বা কম্পিউটারের
ক্ষতি করতে পারে না। সেখান থেকে তথ্য চুরিও করতে পারে না।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনে সরকারের অধিকার থাকতেই পারে যে রাষ্ট্রবিরোধী
শক্তির ফোনে ‘ফেলুদা’র নজরদারির প্রয়োজন। কিন্তু ফেলুদা থাকলে কি দেশের বৈধ নাগরিকদের
উপর, স্বাধীন দেশের সাংবাদিকদের ফোনে নজরদারি সমর্থন করতেন? গোয়েন্দা ফেলুদার টেবিল
থেকে প্রশ্ন তুলতে চাইছি। কে আড়ি পাতার নির্দেশ দিয়েছিল? জানা গেছে ইজরায়েলি সংস্থা
এনএসও ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারকেই তাদের পেগাসাস
স্পাইওয়্যার বিক্রি করেছিল। যে দেশগুলি এই ‘গোয়েন্দা প্রযুক্তি’ কিনেছিল সেই সব দেশের
সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা এই স্পাইওয়্যার কাজে লাগিয়ে ফোনে আড়ি পেতে থাকে। বিরোধীদের
অভিযোগ কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রসচিবের অনুমতি ছাড়া আড়ি পাতা যায়
না। কংগ্রেসের অভিযোগ মোদী সরকারই কি নিজের মন্ত্রীদের ফোনে আড়ি পাতার নির্দেশ দিয়েছিল?
কংগ্রেসের এক বর্ষীয়ান নেতা বলছেন, দেশের হিন্দু সম্রাট নিজের ক্যাবিনেটের মন্ত্রীদেরও
বিশ্বাস করেন না! যেমন নতুন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের ফোনে আড়িপাতার
অভিযোগ উঠেছে। তবে সেটা তিনি মন্ত্রিসভায় যোগদানের আগের ঘটনা।
হুতোমকে আপনারা অনেকেই চেনেন। হুতোম এসে আমাকে বলে গেল, আমাদের
সমাজের এক পক্ষীরাজ তোদের হেঁসেলে উঁকি দিচ্ছে? তোদের প্রধানমন্ত্রীকে কেন বিশ্বাস
করছিস? হুতোমের কথা মেনে নিতে হচ্ছে কারণ কংগ্রেস থেকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, পায়রার পায়ে
বেঁধে পাঠানো বার্তাও কি এখন মোদীজির থেকে নিরাপদ? কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি খুব নির্দিষ্ট
করে বলেছেন, ‘আমরা এখন জানি, উনি কী পড়ছিলেন? ফোনে যা কিছু রয়েছে, সব কিছু।’ সংসদের
চলতি অধিবেশনের প্রথম সপ্তাহ পেগাসাস ইস্যুতে সংসদ অচল হয়েছে। লোকসভার সচিবালয় সূত্রে
খবর, চলতি বাদল অধিবেশনের দ্বিতীয় সপ্তাহেও সরকার ‘পেগাসাস’ আলোচনার তালিকাতেই রাখেনি।
পার্লামেন্টারি তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান শশী থারুর সংবাদ
মাধ্যমকে জানিয়েছেন, লোকসভার অধ্যক্ষের অফিস থেকে সংসদে আলোচনার জন্য যে বিষয়সূচী(অ্যাজেন্ডা)
দেওয়া হয় সেই তালিকায় ‘পেগাসাস’র উল্লেখ নেই। তিনি আরও জানিয়েছেন, সরকার কোভিড-১৯ ম্যানেজমেন্ট,
ভ্যাকসিন নীতি, পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বিষয়গুলি নিয়েও সংসদে কোনও আলোচনা করতে আগ্রহী
নয়।
লোকসভায় ‘গণতন্ত্রের হত্যা বন্ধ করো’ স্লোগান তুলে বিরোধীরা
যৌথ সংসদীয় কমিটির দাবি করেছে। কংগ্রেসের দাবি বিচারবিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। গ্রীক
পক্ষীরাজ ভারতীয়দের ফোনে নজরদারি করে চরবৃত্তি করবে? আর আমরা ভারতীয় করদাতারা তথা সাধারণ
নাগরিক ‘আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে কে লড়াই করবে’ এই উদাসীনতায় সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ
করব? নিশ্চয় করে বলা যায় এই সিদ্ধান্ত সঠিক
সিদ্ধান্ত হবে না। লড়াই আমাদের করতেই হবে, গণতান্ত্রিক অধিকারের বৃহত্তর স্বার্থের
কথা মনে রেখে।
Comments
Post a Comment