আসন পুনর্বিন্যাসই কি নতুন সংসদ ভবনে প্রবেশের সোপান!



দীপেন্দু চৌধুরী 

করোনা আবহে কেন্দ্রের ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে কাউকে দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রতিদিন বিরোধী দলের নেতৃত্ব করোনা ইস্যুতে মোদী সরকারকে বিঁধছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রিকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।সংসদের বাদল অধিবেশনে লোকসভায় সুযোগ না হলেও রাজ্যসভায় করোনা ব্যর্থতা নিয়ে বিরোধীরা কেন্দ্রকে চেপে ধরেছে। ক্রণা বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য সহ ডেটা তুলে দেওয়া হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমের কাছে। করোনার সঙ্গে লড়াই করতে করতে মানুষ ক্লান্ত। কোভিডে মৃত্যু, মৃতের পরিবারের কাছে মৃতদেহ সৎকারের অর্থ নেই। তারা আত্মীয়ের মৃতদেহ গঙ্গা অথবা আঞ্চলিক নদীতে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। কি মর্মান্তিক দৃশ্য। করোনা মহামারি আমাদের মহাকালের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সে সব খবর আমরা প্রভাতি সংবাদপত্রে দেখছি। আন্তর্জাতিক স্তরেও ভারত সরকারকে করোনা পরিস্থিতি, বেকারত্ব বা নতুন কর্মসংস্থানের অভাব সহ একাধিক বিষয়ে আগাম সতর্ক করেছে। এবং করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার আগেও করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাঙ্ক ভারত-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে ব্যাঙ্কের ঋণ নিয়েও সতর্ক করেছে। করোনা অর্থনীতির সঙ্গে লড়াই করার জন্য শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তি ধরে রাখতে ২০২০-২০২১ অর্থবর্ষে প্রথম ঢেউ আছড়ে পড়ার পরে পরেই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ৩ লক্ষ কোটি টাকার সহজ ঋণের প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন। প্রদেয় এই ঋণের জন্য সরকার নিজেই গ্যারেন্টার হচ্ছে।

গত আর্থিক বছরে বরাদ্দ টাকার ২.৭ লক্ষ কোটি টাকার সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ ইতিমধ্যেই বিলি বন্টন হয়ে গেছে। তারপরেও উল্লেখিত প্রকল্পে আরও বর্ধিত ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। চালু প্রকল্পের বহর বেড়ে হয়েছে ৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা। চলতি আর্থিক বছরে অর্থ মন্ত্রক আরও ১.১ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ গ্যারান্টি প্রকল্পের ঘোষণা করেছে। আলোচ্য এই ঋণ নিয়েই সতর্ক করেছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। তাদের মতে এই ধরণের ঋণ ভবিষ্যতে আর্থিক সঙ্কটের কারণ হতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে মোদী সরকার মানুষের করের টাকা ‘লুকানো পথে’ দলের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের হাতে তুলে দিচ্ছে। পাশাপাশি আরও একটি পথ অবলম্বন করতে চাইছে মোদীর নেতৃত্বে ‘জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি’-র দল বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনের আগে ২০২২ সালে সারা দেশে আসন পুনর্বিন্যাসের পরিকল্পনা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে আগ্রহী বিজেপি। ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের আগে সঙ্ঘ পরিবারের নেতৃত্ব মনে করছেন, উত্তরপ্রদেশের মুখমন্ত্রী যোগীর বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে সেটা প্রশমিত করতে না পারলে ২০২৪ সালের প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব নয়।

‘বিমারু’ শব্দবন্ধনীতে আগে চারটি রাজ্য ছিল। বর্তমানে সাতটি রাজ্য। বিহার ভেঙে ঝাড়খন্ড, উত্তরপ্রদেশ ভেঙে উত্তরাখন্ড এবং মধ্যপ্রদেশ ভেঙে ছত্তিশগড় রাজ্য হয়েছ। তাই বিমারু না বলে ‘গোবলয়’ বলাটা হবে বর্তমান সময়ের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে অনেকটা প্রাসঙ্গিক।লোকসভা কেন্দ্রের পুনর্বিন্যাসের পরে উচ্চ বর্ণের ‘হিন্দু ভোটার’-র সংখ্যা ‘গোবলয়’-র রাজ্যগুলিতে বহুগুণ বেড়ে যাবে। সমাজ বিঞ্জানীদের অভিমত এমনটা দাবি করছে। এইচটি পত্রিকার কলকাতা সংস্করণের একটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতের ৮৩শতাংশ হিন্দু দম্পতির দুটির অধিক সন্তান আছে। যেমন অন্যান্য পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীভুক্ত হিন্দুর সংখ্যা দেশে ৩৯.৫ শতাংশ। তপসিলি জাতিভুক্ত হিন্দুর সংখ্যা ভারতে ২১.৬ শতাংশ। সারা দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের জনবিন্যাস মাত্র ১৩.০ শতাংশ। বর্ণহিন্দু (আপার ক্লাস) ১১.৬ শতাংশ। হিন্দু তপসিলি উপজাতির জনবিন্যাস ১০.২ শতাংশ। এবং দেশের অন্যান্য গোষ্ঠীর হিন্দু শতাংশ হিসেবে ৪.১ শতাংশ আছে। জাতি গণনার হিসেবে ব্রহ্মাণ আর ঠাকুর সম্প্রদায়ের শতাংশের হার প্রায় এক। যে সম্প্রদায় বিজেপির সঙ্গেই  আছে। সবর্ণ বৈশ্য এবং কায়স্থদের হারও প্রায় এক। যে ভোট ব্যাঙ্ককে কাজে লাগিয়ে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ২০১৪, ২০১৯ সালে পর পর দু’টো লোকসভা নির্বাচন জিতেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্টে প্রকাশ ভারতে ৪০% সরকারি কর্মচারী হিন্দু ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত। মানে সামাজিকভাবে উচ্চবর্ণের দখলে। দাবি উঠেছে, ২০১১ সালের জাতি ভিত্তিক জনগণনা সর্বজনিন করার। অর্থাৎ গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হোক। এবং ২০২১ সালের জনগণনায় জাতি বিষয়ক কলম রাখার দাবিও উঠে আসছে।

উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, বিহার, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশ সহ গোবলয়ের রাজ্যগুলিতে গত এক দশকে জনবিস্ফোরণ হয়েছে। তথ্য দাবি করছে, উত্তর ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দুদের থেকে কম। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের জনসংখ্যা সারা দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের থেকে বেশি। মুসলিম জনসংখ্যা ভারতে বাড়ছে বলে যে প্রচার হয়ে থাকে সেটা অসত্য প্রচার। গত এক দশকে তুলনামূলকভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যা চোখে পড়ার মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। হিন্দি বলয়ের উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোটারদের উপর অনেকটাই নির্ভর করতে হয় বিজেপিকে। নব্বই দশকের মণ্ডলয়ান রাজনীতির পরে বিজেপিকে আরও বেশি করে উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোটারদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। গত শতাব্দীর নব্বই দশকের অবিভক্ত বিহার রাজ্যের একটা পরিসংখ্যান দেখে নিলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার করে বলতে পারব আমরা। গত শতাব্দীর নব্বই দশকে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিকাশের ধারায় অবিভক্ত বিহারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মণ্ডল রাজনীতির বিকাশে ওই রাজ্যটির নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে। কারণ ‘মণ্ডলরাজনীতি’-তে বিহারের পিছিয়ে পড়া জাতিগুলির অন্যতম প্রাধান্য ছিল। ওই সময়ে বিহারে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতিগুলির জনসংখ্যা সমগ্র বিহারের জনসংখ্যার শতকরা ৪৮ ভাগ ছিল।

২০২২ সালের জনগণনার পরে হিন্দিবলয়ের উল্লেখিত এই শতাংশ হারের অনেকটা হেরফের হবে। আমরা জানি হিন্দিবলয়ের গ্রামাঞ্চলে স্বাধীনতার আগে থেকেই সামন্ততন্ত্রের মূল স্তম্ভ হল উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়। উচ্চবর্ণের এই সম্প্রদায় জাতপাতের আধিপত্য যেমন বজায় রাখতে পারে, পাশাপাশি তারা জাতপাতের সামাজিক আধিপত্যের ধারা মেনে পিছিয়ে পড়া জাতিগুলির উপর অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করে। মণ্ডল উত্তর রাজনীতিতেও যার সুযোগ নিতে চায় মনুবাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি। কারণ কংগ্রেস নামক এক সময়ের সর্বদলীয় যৌথ মঞ্চের শক্তি ক্ষয় হয়েছে। যদিও ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসবে কংগ্রেস মণ্ডল উত্তর রাজনীতিতে বর্তমান সময়েও জাত-পাত নামক সামন্ত রাজনীতির উর্ধে। আধুনিক ও উদার মূল্যবোধের এই সুর বেঁধে দিয়ে গিয়েছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। তিনি নিজেও ব্রিটিশ ভারতে ‘হিন্দিবলয়’-র সন্তান।

যেহেতু আমাদের মূল বিষয় হল উচ্চবর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় তাই একটি উদাহারণ দেওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি ফেসবুকে বিজেপির প্রবীণ নেতা সুব্রমনিয়াম স্বামী লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মিণ’ সংবাদপত্র তামিলনাড়ুর বিজেপির খবর করেছে। তাতে আমি খুশি। ওই সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে, বিজেপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তামিলনাড়ুতে কর্মসুচী নিচ্ছে না। একটি সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। তিনি আরও লিখেছেন, যদি বিজেপি একটি হিন্দুত্ববাদী দল হয় এবং তামিলনাড়ু রাজ্যের সমস্ত হিন্দুদের কথা বলে তবেই বিজেপি দল হিসেবে সমৃদ্ধ করতে পারবে। প্রবীণ দক্ষিণী এই নেতা নিজেও জানেন তামিলনাড়ুতে জাত-পাতের লড়াই আগের মতো নেই। কারণ উত্তর স্বাধীনতা তামিলনাড়ু, কেরল সহ দক্ষিণের   রাজ্যগুলির চোখে পড়ার মতো অর্থনৈতিক বিকাশ হয়েছে। সেই বিকাশের উপর ভিত্তি করে অনিবার্যভাবে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটও আধুনিক হয়েছে।

এই লেখা যখন লিখছি ঠিক তার প্রাক মুহূর্তে রাজ্যের জনসংখ্যা নীতি ঘোষণা করলেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। ১১ জুলাই ‘উত্তরপ্রদেশ জনসংখ্যা নীতি ২০২১-২০৩০’ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এই সময়ের দাবি এবং ২০২৬ সালের মধ্যে জন্মহার কমিয়ে ২.১-এ আনতে চায় উত্তরপ্রদেশ সরকার। আইন কমিশন ইতিমধ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিলের খসড়া প্রকাশ করেছে। এই খসড়াতে দুই সন্তান নীতি না মানলে সরকারের বিভিন্ন সুযোগ রাজ্যের নাগরিকরা পাবে না। এমন কি স্থানীয় ভোটে লড়াইয়ের অধিকারও হারাতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিলের এই খসড়া হঠাত ২০২১ সালের জনগণনার আগে কেন? আবার ২০২১ সালেই বিধানসভার ভোটও আছে। দুটো বিষয়কে এক বন্ধনীতে আনলে আমাদের কিন্তু ভাবতে বলছে! আসলে টার্গেট কারা? কোন সম্প্রদায়? এই আলোচনায় দেশের জনবিন্যাসের পরিসংখ্যান উল্লেখিত হয়েছে। লোকসভার আসন পুনর্বিন্যাসের আগেই বা কেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথা বলছেন?

হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলিতে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা অত্যন্ত কম হলেও সামাজিকভাবে প্রাধান্য এখনও আছে উচ্চবর্ণের সম্প্রদায়ের হাতেই।তারাই সমাজপ্রভু। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত আরএসএস তথা বিজেপি ভালোভাবেই জানে ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ’ আসলে সোনার পাথর বাটি। ১৯ জুন ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ লিখেছেন, ‘’The states that serve their citizens indifferently or abominably, such as Uttar Pradesh and Bihar, will find their already considerable influence on the Union government’s policies and priorities escalating even more. This increasing asymmetry shall place fresh burdens and stresses on the already fragile state of Indian federalism.’’ ২০২২ সালের জনগণনার পরে গোবলয়ের দুটি রাজ্য উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের প্রাধান্য যে বাড়বে সেই বিষয়েই ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ আলোকপাত করেছেন। ২০ হাজার কোটি টাকার ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’-র ময়ুর সিংহাসনে বসার আগাম প্রস্তুতি হিন্দুসম্রাট মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি শুরু করে দিয়েছে। শেষ কথা বলবে ভারতীয় নির্বাচকমণ্ডলী। ততদিন আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে বিরোধী দলগুলির নেতৃত্বের ভূমিকা দেখার জন্য। ছত্রভঙ্গ বিরোধী দল না ঐক্যবদ্ধ বিরোধী মঞ্চ? ইউপিএ না নতুন যুক্তফ্রন্ট?                                                                                        

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?