যোগী রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে গণতন্ত্রের প্রহসন ও তামাশা!





দীপেন্দু চৌধুরী

দলিত নিগ্রহ, নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণে দেশের যে রাজ্য শীর্ষে তার নাম নতুন করে বলে দিতে ভারতের সমাজ সচেতন নাগরিক মাত্রেই তার নাম জানেন। জানেন একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের উত্তরপ্রদেশ নামক রাজ্যটির নাম। রামরাজ্যে ‘বাহুবলী’-দের স্বর্গ রাজ্য হয়ে উঠেছে উত্তরপ্রদেশ। বিরোধীরা দাবি করছে, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সুশাসনে এই রাজ্য অপরাধের তালিকায় প্রথম সারিতে উঠে এসেছে। যোগী শাসনে একের পর এক দলিত নিগ্রহ, ধর্ষণ, খুনের ঘটনা ঘটেই চলেছে এই রাজ্যে। অনেকটা দু’দশক আগের বিহার রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করা চলে। বিশেষত ‘জাতপাত’ প্রসঙ্গে। এখানে গণতান্ত্রিক ভারতের সাধারণতন্ত্রের শাসনের কথা বলা হলেও ‘নাগরিক অধিকার’ কতটা আছে? প্রশ্ন উঠেছে বেশ কিছু দিন আগে থেকেই। যে রাজ্যে সংবাদমাধ্যমের সংবিধান প্রদত্ত ‘চতুর্থ স্তম্ভ’-র অধিকার নেই। সেই রাজ্যের দুষ্কৃতীদের অপরাধ, গৃহ হিংসা, গণপ্রহারে মৃত্যু ইত্যাদি বিষয়ে তদন্ত মূলক খবর, সংবাদমাধ্যম কতটা দায়িত্বের সঙ্গে প্রকাশ করতে পারে? বিষয়টা নিয়ে কিছুদিন আগে নিজের ব্লগের লেখায় প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক রবীশ কুমার। উত্তরপ্রদেশে সাংবাদিক নিগ্রহ বিষয়কে মাধ্যম করে তার লেখায় ম্যাগসাইসাই পুরষ্কারজয়ী সাংবাদিক আরও প্রশ্ন তুলছেন, উত্তরপ্রদেশে প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমের একজন সাংবাদিক বা চিত্রসাংবাদিক আক্রান্ত হলে তার পাশে থাকতেও সাহস পাচ্ছে না কেউ। এমন কি আক্রান্ত সেই সাংবাদিকের নিজের সংস্থাও সরে যাচ্ছে। যোগী প্রশাসনের রক্তচক্ষুর ভয়ে। বিষাক্ত ছোবলের আক্রমণ থেকে তারা নিজেদের প্রশাসনিক তথা কৌশলী আমলাতান্ত্রিকতায় দূরত্ব তৈরি করে নিতে চাইছে। সাংবাদিক আহত হোক বা নিহত, তার পারিবারের পাশেও কেউ থাকছে না। প্রশাসনের এতটাই দাপট। সাংবাদিক রবীশ কুমারের ভাষায় অত্যন্ত দুঃখজনক(দুখদ)ঘটনা।    

এই আবহে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে সেমিফাইনাল হয়ে গেল। ২০২২-র বিধানসভা ভোটের আগে যোগীরাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে প্রশাসনের দাপট সারা দেশ দেখলেও সংবাদমাধ্যমের কাছে সব ‘ফুটেজ’ নেই। যোগী প্রশাসনের শীর্ষ আমলাদের পাহারায় গণমাধ্যমের ‘গ্রাসরুট’ প্রতিনিধিদের কাছে থেকে ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ বিরোধীদলের নেতাদের এবং কয়েকজন সাহসী সাংবাদিকের। উত্তরপ্রদেশে ৮২৫টি ব্লক পঞ্চায়েত প্রধানের আসনের মধ্যে ৬৩৫টিতে ‘ভোট-সন্ত্রাস’ করে জিতেছে বিজেপি। কংগ্রেস-তৃণমূলের অভিযোগ, উল্লেখিত ‘ব্লক প্রমুখ’ ভোটের সময় যোগী-রাজ্যে ১৮টি জেলায় লাগামছাড়া হিংসার ঘটনা ঘটেছে। বিজেপি দলের নেতা, কর্মী-সমর্থকদের সংগঠিত নেতৃত্বে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মনোজ কুমার জানিয়েছেন, ৮২৫টি ‘ব্লক প্রমুখ’(পঞ্চায়েত প্রধান) নির্বাচনের মধ্যে থেকে ৪৭৬টি আসনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয়েছে। ৩৩৪টি আসনে বিজেপির প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেছেন। ৫টি আসনে এনডিএ-র শরিক দলের প্রার্থীরা জিতেছে। শতাংশের হিসেবে ৪২ শতাংশ আসনে কোনওরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই বিজেপি ও তাদের জোট প্রার্থীরা জিতেছেন।

বিরোধীদের অভিযোগ, তাদের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতেই দেয়নি যোগীর সংগঠিত সন্ত্রাসবাহিনী। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া দৃশ্যে দেখা গেছে, মহিলা প্রার্থীর শাড়ি ধরে টেনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে। বিরোধীদের অভিযোগ, মনোনয়নপত্র হাত থেকে কেড়ে নেওয়াও হয়েছে। সমাজবাদী পার্টীর শীর্ষনেতা অখিলেশ যাদবের অভিযোগ, বিজেপির উলঙ্গ নৃত্য। কংগ্রেসের মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনাতে অত্যন্ত শঙ্কিত। প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানিয়েছেন, আগামী বছরে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে যোগীর নেতৃত্বে  বিজেপি আরও সন্ত্রাস করবে বলে অনুমান করা যায়। ১০ জুলাই ‘ব্লক উন্নয়ন কাউন্সিল’(বিডিএস)-র প্রধান(পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি)-র নির্বাচনের ভোটের ফল দেখে বোঝা যাচ্ছে কার্যত ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে সমাজবাদী দল সহ সব বিরোধী দলই। গ্রামপঞ্চায়েত ব্যবস্থার দ্বিতীয় স্তর ‘ব্লক উন্নয়ন কাউন্সিল’(পঞ্চায়েত সমিতি)-র সদস্যরা চলতি বছরের এপ্রিল মাসে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। ফলাফল ছিল, জেলা পঞ্চায়েত ভোটে মোট আসন ছিল ৩০৫০টি। বিজেপি পায় ৭৫০টি আসন। সমাজবাদী পার্টি ও আরএলডি যৌথভাবে ৮২৮টি আসনে জয়ী হয়। বহুজন সমাজবাদী পার্টী ৩৮১টি আসনে জেতে। কংগ্রেস পেয়েছে ৩৭৬টি আসন, আপ ৬৪টি এবং অন্যান্য দল ৯৫১টি আসনে জয়ী হয়। এপ্রিল মাসে উত্তরপ্রদেশ জেলা পঞ্চায়েত অধ্যক্ষ(জেলা সভাধিপতি)নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে ৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে রাজ্যের জেলাগুলির প্রশাসন পরিচালনার ক্ষমতা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করেছে।

গ্রামপঞ্চায়েত ব্যবস্থার দ্বিতীয় স্তর ‘ব্লক উন্নয়ন কাউন্সিল’(পঞ্চায়েত সমিতি)-র নির্বাচিত সদস্যরা ‘ব্লক প্রমুখ’(পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি)নির্বাচিত করেন উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে। হিংসা কবলিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ‘এই জয় গণতন্ত্রের জয়। রাজ্যের মানুষ জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা এবং পেশাদার দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক টুইট বার্তায় নিজের দলের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছেন, ‘বাম্পার ভিকট্রি’। উত্তরপ্রদেশ সহ সারা ভারতের রাজনৈতিক ঘটনায়, গত কয়েক বছর বহুজন সমাজবাদী পার্টীর নেত্রী মায়াবতী বিজেপির বিরুদ্ধে সচরারাচর মুখ খোলেন না। সেই মায়াবতীও বলেছেন, উত্তরপ্রদেশে আইনের শাসন বলে কিছু নেই। ১০ জুলাই কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধির টুইট ছিল, উত্তরপ্রদেশে হিংসার নাম ‘মাস্টার স্ট্রোক’। প্রিয়ঙ্কা টুইট করেন, ‘ক’বছর আগে বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনায় নিগৃহীতাকে খুন করার চেষ্টা  হয়েছিল। আর এ বার এক মহিলার মনোনয়ন জমা দেওয়াকে আটকাতে গিয়ে সব সীমা পার করে গেল বিজেপি। সেই সরকার, সেই আচরণ।’

তৃনমূল কংগ্রেস অভিযোগ করছে, পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে উত্তরপ্রদেশে হিংসা ছড়ানো সত্বেও মুখে কুলুপ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, মানবাধিকার কমিশনের। রাজ্যসভার তৃণমূলের মুখ্য সচেতক সুখেন্দুশেখর রায় বলেছেন, ‘’উত্তরপ্রদেশে ১৮টি জেলায় তুমুল হিংসা হয়েছে। সাংবাদিককে মেরে ক্যামেরা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে বলতে শোনা গিয়েছে তাঁর উপরে বিজেপি নেতা-কর্মীদের হামলার কথা। কোথাও কর্তব্যরত পুলিশকে কাজে লাগিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে। বিষয়টির তদন্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক দল পাঠাচ্ছে না কেন? মানবাধিকার কমিশন কোথায় গেল?’’ বিরোধিরা আরও বলছে, যোগী রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে গণতন্ত্রের প্রহসন ও তামাশা হয়েছে!                    

উত্তর প্রদেশে পঞ্চায়েত ভোটের মতই ঘটনা আমাদের রাজ্যের নাগরিকদেরও মনে থাকার কথা। ২০১৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা ‘ত্রিস্তর পঞ্চায়েত’ ভোট সারা রাজ্যে একরকম বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে নিয়েছিল। বাংলার বিরোধীশুন্য পঞ্চায়েত ভোট আমদের দেখতে হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে পঞ্চায়েত ভোটের আগে বিজেপি ত্রিপুরাতেও সন্ত্রাস করে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত প্রশাসন নিজেদের দখলে রেখেছে। গ্রাম ভারতের মানুষ কি এই পঞ্চায়েত চেয়েছিল? পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট সরকার ‘ত্রিস্তর পঞ্চায়েত’ ব্যবস্থা চালু করে। ১৯৮৮ পর্যন্ত বাংলার গ্রাম উন্নয়নে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভালো কাজ করে। তারপরেই অবশ্য বামফ্রন্ট আমলে পঞ্চায়েত সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ শোনা গিয়েছে। ২০০৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএম-এর বিরুদ্ধে ব্যপক সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধি ‘পঞ্চায়েত রাজ’ ব্যবস্থাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন।তাঁর আমলে নিজের সারা দেশে অভিন্ন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ও সব স্তরে এক তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের খসড়া তৈরি হয়। যে খসড়া পিভি নরসিংহ রাওয়ের সময়ে গৃহীত হয়। তবে দলীয় ভিত্তিক নির্বাচন দেখিয়ে দিল গ্রাম ভারতের মানুষের হাতে ক্ষমতা নয়। দলীয় ভিত্তিক নির্বাচন বর্তমানে হিংসার সূতিকাগার। উত্তরপ্রদেশের সাপ্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনও দেখিয়ে দিল গ্রাম ভারতের মানুষের হাতে ক্ষমতা নয়। পঞ্চায়েতি ক্ষমতার নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ থাকবে বাহুবলী দলীয় নেতা-কর্মীদের হাতে।                                      

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?