মামলা জটে আর কতদিন শিক্ষক নিয়োগ আটকে থাকবে!
দ্বৈপায়ন কবির
গত সাত-আট বছর সকালের খবরের কাগজ খুললেই এক কলামের ছোট অথবা
তিন কলামের বড় খবর সবার নজরে পড়বে। ‘মামলা জটে ফের আটকে গেল শিক্ষক নিয়োগ’। আমার ব্যক্তিগত
অভিঞ্জতায় জানি, সারা রাজ্য জুড়ে গত সাত-আট বছর শিক্ষক নিয়েগে ‘বহু চর্চিত অস্বচ্ছতা’-র
কথা। উচ্চ প্রাথমিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগে অস্বচ্ছতার অভিযোগে কলকাতা হাইকোর্টে
দফায় দফায় মামলা হয়। সেই সমস্ত মামলা এক ফোল্ডারে এনে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে নিয়োগ
প্রক্রিয়া বাতিল করে দিয়েছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য। সেই খবরের প্রতিবেদন
আমরা ‘সপ্তাহ’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলাম। ১২ জুলাই হাইকোর্টের বিচারপতি সুব্রত তালুকদার
এবং বিচারপতি সৌগত ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার অভিযোগে
নতুন করে মামলা হয়েছে। কয়েকজন চাকুরী প্রার্থীর আইনজীবী রুচিরা চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন,
বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্যের নির্দেশ ছিল ১০মের মধ্যে ইন্টারভিউয়ের তালিকা প্রকাশ
করতে হবে। কিন্তু সেই তালিকা প্রকাশ হয় ২১ জুন। তাতেও অস্বচ্ছতার অভিযোগে আবার মামলা
হয়।
সেই মামালার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিকভাবে উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই রায়ে তিনি
বলেন, সবিস্তার নম্বর-সহ তালিকা প্রকাশ করতে হবে স্কুল সার্ভিস কমিশন(এসএসসি)কে। বিচারপতি
গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশের পরে স্কুল সার্ভিস কমিশন সবিস্তার নম্বর সহ তালিকা আদালতে
পেশ করে। সেই তালিকা দেখে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
২০১৬ সাল থেকে উচ্চ প্রাথমিকে নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন ধরণের টানাপড়েন
চলছে। ২০১৪ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া টেনে নিয়ে আসা হয়েছে চলতি বছর পর্যন্ত। ২০১৭ সালের
পরীক্ষার ফল এ পর্যন্ত ঘোষণাই হয়নি। মামলা জটে বারে বারে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে
যাচ্ছে। অস্বচ্ছতার অভিযোগেই এর আগে প্যানেল বাতিল করে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। যে
প্রসঙ্গ আমরা প্রথম পরিচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়ের পরেই স্কুল
সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান শুভঙ্কর সরকার ১০ জুলাই জনিয়েছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যেই
উচ্চ-প্রাথমিকে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করার চেষ্টা করছে কমিশন। সাংবাদিক বৈঠকে সেদিন
শুভঙ্করবাবু জানিয়েছিলেন, এক দিকে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলবে এবং অন্য দিকে ইন্টারভিউ তালিকায়
যে প্রার্থীদের নাম নেই তাঁদেরও একটা সুযোগ দেওয়া হবে। যাঁরা ইন্টারভিউয়ে ডাক পাননি
তাঁরা তিনটি পদ্ধতিতে এসএসসি অফিসে সরাসরি আবেদন পাঠাতে পারবেন। এক, তাঁরা সরাসরি এসএসসি
অফিসে এসে আবেদন জমা দিতে পারেন। দুই, প্রার্থীরা স্পিড পোস্টে আবেদন করতে পারেন। তিন,
রেজিস্টার্ড পোষ্টের মাধ্যমে আবেদন পাঠাতে পারেন। এছাড়াও ই-মেলের মাধ্যমেও আবেদনকারীরা
আবেদন জানাতে পারেন।
শুভঙ্কর সরকার আরও জানান, প্রত্যেক আবেদনকারীকে এসএসসি অফিসে
ব্যক্তিগত ভাবে ডেকে কথা বলা হবে। তাঁদের মতামত নিয়ে, অভিযোগ শুনে তারপরেই কমিশন নিজেদের
মতামত রেজিস্টার্ড পোষ্টের মাধ্যমে প্রার্থীকে পাঠাবে। শুভঙ্করবাবুর এই বক্তব্যের পরেও চাকরি প্রাথীদের
একটা অংশ বিশ্বাস করতে পারছেন না। স্বচ্ছভাবে নিয়োগ হবে। কারণ তাঁদের তিক্ত অভিঞ্জতায় তাঁরা দেখেছেন যোগ্য
প্রার্থীদের বঞ্চিত করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিয়োগ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পক্ষান্তরে
তাঁরা ইঙ্গিতে আঙুল তুলতে চাইছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের দিকে। কতৃপক্ষের উদাসীনতাকে
কারণ হিসেবে দেখাতে চাইছে শিক্ষক প্রাথীরা। ভুক্তভোগী সেই অংশের শিক্ষকরা তাই আবার
মামলা করেছে। তাঁদের আইনজীবী রুচিরা চট্টোপাধ্যায় জানান, নতুন তালিকা নিয়েও কিছু প্রশ্ন
আছে। তাছাড়াও শুন্য পদের যে হিসেব দেখানো হয়েছে, প্রশ্ন আছে সেই বিষয়েও।
১৩ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের কাউন্সিলিং শেষ হয়েছে। প্রাথমিক
শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ১৪ জুলাই থেকে পর্ষদের নির্দেশিকা
অনুযায়ী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ অফিসে গিয়ে প্রাথীরা নিয়োগপত্র নিতে পারবে। আশঙ্কায়
আবারও ভুগছেন শিক্ষক পদের প্রার্থীরা। তাঁরা সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। কারণ বিচারপতি সুব্রত
তালুকদার ও বিচারপতি সৌগত ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চে নতুন করে যে আপিল মামাল করেছেন
রাজীব ব্রহ্ম সহ কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী, সেই মামলা শুনানির জন্য গৃহীত হয়েছে। ২০ জুলাই
নতুন আপিল মামলার শুনানি আছে।
গত দেড় বছর আমরা করোনা আবহে আছি। এই আবহে শিক্ষক নিয়োগের মামলার
একটা ফয়সালা হয়েছিল। তারও কয়েক বছর আগে থেকেই উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। আর
কতদিন চলবে এই অস্থিরতা! সম্প্রতি একটি রিপোর্ট থেকে জানা গেল, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে
ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ছিল সারা দেশে প্রাথমিকে ২৬:১, উচ্চ প্রাথমিকে ১৮:১। পাশাপাশি
আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এই অনুপাত ছিল প্রাথমিকে ২৯:১, উচ্চ প্রাথমিকে ২৭:১।অন্য
একটি তথ্যে জানা যাচ্ছে, ২০১১ সাল থেকে তৃণমূল সরকারের আমলে ৫ লক্ষ সরকারি পদ অবলুপ্ত।
স্কুল শিক্ষকের ৮৭ হাজার পদ খালি। কলকাতা পুলিশে শুন্য পদের সংখ্যা ৪৫ হাজার। রাজ্য
পুলিশেও ৭৫ হাজার পদ শুন্য পড়ে আছে।স্কুল সার্ভিস কমিশনে ৮৭,০০০ পদ শুন্য। স্কুল কলেজ
ধরে প্রায় ৩৭০০টি গ্রন্থাগারিকের পদে দীর্ঘদিন নিয়োগ বন্ধ। গ্রুপ ‘ডি’ পদে ১ লক্ষ ২৪
হাজার পদ খালি। স্বাস্থ্য দফতরে ২৩,০০০ পদে দীর্ঘদিন নিয়োগ হয়নি। করোনার সময়ে কম সংখ্যক
স্বাস্থ্যকর্মী নিয়েই বেজার মুখে কাজ করতে হচ্ছে কতৃপক্ষকে। খাদ্য দফতরে ১২০০০ পদে
কোনও কর্মী নেওয়া হচ্ছে না। ‘দুয়ারে রেশন’ প্রকল্প কতটা সফল হবে? এই চিত্র বলে দেয়
আমাদের রাজ্যের বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মহীনতার পীড়াদায়ক যন্ত্রণার কথা।
Comments
Post a Comment