‘কৃষি বাঁচাও গণতন্ত্র বাঁচাও’-য়ের দাবিতে কৃষকরা আজও রাস্তায়





দীপেন্দু চৌধুরী

করোনা পরিস্থিতিতেও কৃষকরা কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে গত সাত মাস যাবৎ দিল্লির সিঙ্ঘু  সীমান্তে অবস্থান বিক্ষোভ করছে। দিল্লির পুলিশের হয়রানি। কেন্দ্রের কৌশলী আমলাতান্ত্রিক চাপ, করোনার প্রথম ঢেউ এই আন্দোলনকে স্তিমিত করতে পারেনি। দ্বিতীয় ঢেঊ আছড়ে পড়ার পরও কৃষকরা ক্লান্তিহীন প্রত্যয়ের সঙ্গে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। গত সাত মাস ধরে তারা টানা এই আন্দোলন করছেন। এই আন্দোলন করতে গিয়ে গত সাত মাসে ৫০০ জন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। তবু তিন বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিত সংযুক্ত কিসান মোর্চার নেতৃত্বে এই আন্দোলন হচ্ছে। ২৬ জুন করোনা বিধি মেনে মোর্চার নেতৃত্বে ‘কৃষি বাঁচাও গণতন্ত্র বাঁচাও’- স্লোগানকে সামনে রেখে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভ দেখান হয় প্রতিটি রাজ্যের রাজভবনের সামনে। দিল্লিতে উপ রাজ্যপালের প্রতিনিধি বিক্ষোভস্থলে এসে  মোর্চা নেতৃত্বের কাছে থেকে তাদের দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি নিয়ে যায়। দিল্লিতে সংযুক্ত কিসান মোর্চার নেতৃত্ব জানিয়েছে, তারা বিজেপি সরকার বিরোধী প্রচার চালিয়ে যাবে। সামনের বছর উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আছে।

সেই নির্বাচনেও কৃষকরা সংগঠিতভাবে বিজেপি বিরোধী প্রচার চালিয়ে যাবে। সংযুক্ত কিসান মোর্চার এই আন্দোলনে কৃষকরা আশাবাদী যে, বিজেপি পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে যথেষ্ট লড়াইয়ের সামনে পড়বে। কারণ পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে জাঠদের আধিপত্য বেশি। ২৬ জুন ‘কৃষি বাঁচাও গণতন্ত্র বাঁচাও’ দিবসে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন নেতা রাকেশ টিকায়েতের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল হয়েছে। রাকেশ টিকায়েত কেন্দ্রে তিন বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিল করার আন্দোলনের অন্যতম মুখ এবং প্রথম সারির নেতা। তিনি নিজেও জানুয়ারি মাস থেকে এই আন্দোলনের সঙ্গে আছেন। রাষ্ট্রীয় লোকদল নেতা জয়ন্ত চৌধুরী সংযুক্ত কিসান মোর্চার এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছে। আন্দোলনকারী কৃষক নেতৃত্ব আশাবাদী ২০২২ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও রাষ্ট্রীয় লোকদল নেতৃত্ব তাদের সঙ্গে থাকবে। প্রাসঙ্গিক ভাবেই উল্লেখ করতে হয় যে, চলতি বছরের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সংযুক্ত কিসান মোর্চার নেতৃত্ব  ভোটমুখী পাঁচ রাজ্যে গিয়ে বিজেপি বিরোধী প্রচার করে। বিজেপি বিরোধী প্রচার করলেও কিসান মোর্চার নেতৃত্ব জানিয়ে দিয়েছিল, তারা নির্দিষ্ট কোনও দলের হয়ে প্রচার করছে না। শুধু মানুষকে বলছে, বিজেপিকে ভোট দেবেন না। আগামী বছরে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পঞ্জাব, গোয়া এবং মণিপুরে ভোট আছে। সেই সব রাজ্যেও সংযুক্ত কিসান মোর্চা একই আবেদন নিয়ে যাবে। তাদের বক্তব্য এই প্রচার করলে তবেই বিজেপিকে হারান যাবে।

বিজেপি যে সমস্যায় পড়েছে সেটা বোঝা গেল কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমরের বক্তব্য থেকে। ২৫ জুন তোমর আন্দোলনরত কৃষকদের উদ্দেশ্যে এক আবেদনে বলেন, দিল্লি সীমান্তে সাত মাস ধরে চলা অবস্থান বিক্ষোভ তুলে নেওয়া হলে কেন্দ্র তাদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা করবে। সেই আলোচনা হবে তিন কৃষি আইন বিষয়ে। এই আইন নিয়ে কৃষকদের অযথা ভয়ের কোনও কারণ নেই। তোমর দাবি করেছেন, কেন্দ্রের আনা নতুন তিন কৃষি আইনকে সমর্থন জানিয়েছেন অন্যান্য কৃষক সম্প্রদায়। ভারতীয় কৃষকদের বিভিন্ন সংগঠন ২৬ জুন যৌথভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। সেদিন তারা তোমরের আবেদনের উত্তরে যৌথভাবেই জানিয়েছেন, ‘’কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এটা খুব পরিষ্কার হয়েছে যে, সরকার কিসান মোর্চার আন্দোলনকে ভয় পেয়েছে। এখন তিনি বলছেন, নতুন তিন আইনের প্রতিটি বিষয়ের  অভিযোগ নিয়ে সরকার আলোচনার জন্য প্রস্তুত আছে। মোর্চা নেতৃত্ব ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে তাদের আপত্তির বিষয়গুলি জানিয়ে এসেছে। নতুন তিন কৃষি আইনে আপত্তিজনক কয়েকটি কৃষক বিরোধী বিষয় আছে, সেগুলির কথা চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের বৈঠকে আমরা জানিয়ে দিয়েছি।‘’

কৃষক নেতৃত্ব আরও বলেছে, ‘’লক্ষ্য লক্ষ্য কৃষক তিন বিতর্কিত কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। কিন্তু মোদী সরকার কৃষকদের, ভারতীয় জনগণকে এবং সংবাদ মাধ্যমকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। আমারা আবেদন করব, নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে আপনারা আন্দোলনরত কৃষকদের পাশে থাকুন। বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার করে ওদের জনসমর্থন কমাতে সাহায্য করুন।‘’

কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিল, বিদ্যুৎ(সংশোধনী) বিল বাতিলের দাবিতে এবং মোদী সরকারের আমলে দেশে যে ‘অঘোষিত জরুরী অবস্থা’ চলছে, তার বিরুদ্ধে কলকাতাতেও বিক্ষোভ হয়। ‘কৃষি বাঁচাও গণতন্ত্র বাঁচাও’-র দাবিতে ২৬ জুন কর্মসূচীর ডাক দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের কৃষক সংগ্রাম কমিটি। ওই দিন সিদো-কানহু-ডহরে কৃষক সংগঠনের নেতা অমল হালদার, কার্তিক পাল, সুভাষ নস্কর এবং শ্রমিক নেতা অনাদি সাহু, অতনু চক্রবর্তীরা এই আন্দোলনে যোগ দেন। মেয়ো রোডে করোনা বিধি মেনে বিক্ষোভ দেখানোর সময় আইএসএফ বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকি সহ তার ১২ জন সমর্থককে গ্রেফতার করে লালবাজারে নিয়ে যায় কলকাতা পুলিশ। সেদিন সন্ধ্যায় নওসাদ সহ তার ১২ জন সঙ্গীকে মুক্তি দেওয়া হয়।            

২৬ জুন কংগ্রেস সংযুক্ত কিসান মোর্চার আন্দোলনকে সমর্থন করে বলেছে, কেন্দ্রীয় সরকার আস্তে আস্তে ‘মান্ডি’ ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। নতুন তিন কৃষি আইন লাগু হওয়ার পর থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর ফলে কৃষকরা স্থানীয় বাজারে আর তাদের ফসল বিক্রি করতে পারবে না। কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালা বলেছেন, ‘’মোদী সরকার ২০১৪ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই কৃষকদের অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। তারই ফলশ্রুতি হচ্ছে নতুন তিন কৃষি আইন। কিন্তু সরকার অত্যাচারের সব সীমা অতিক্রম করেছে। সেটা বোঝা গেছে, গত সাত মাস ধরে  ভারতীয় কৃষকরা দিল্লির সিঙ্ঘু সীমান্তে আন্দোলন করছে। অথচ সরকারের কোনরকম হেলদোল নেই। কেন্দ্রের উদাসীনতা এক রকম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছে। মোদী সরকারের উদ্দ্যেশ্য ২০১৪ সালেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, যখন তারা জমি অধিগ্রহণ আইন ২০১৪, বাতিলের চেষ্টা করে।‘’ কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি বলেছেন, ‘’বিক্ষোভরত কৃষকদের আন্দোলনকে কংগ্রেস আবারও সমর্থন করবে।‘’                                                      

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?