চলে গেলেন গাঁধিবাদী পরিবেশবিদ সুন্দরলাল বহুগুণা




দীপেন্দু চৌধুরী

‘’ইকোলজি ইজ পার্মানেন্ট ইকোনমি’’ এই স্লোগানের স্রষ্টা ছিলেন গাঁধিবাদী পরিবেশবিদ সুন্দরলাল বহুগুণা।ভারতের পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অবশ্যই একজন পথিকৃৎ। ৯ জানুয়ারি ১৯২৭ সালে তাঁর জন্ম গঢ়বালের মারোরা গ্রামে।৯৪ বছর বয়সে তিনি চলে গেলেন। পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের একজন অভিভাবক চলে যাওয়ার গেলেন। পরম আত্মীয় চলে যাওয়ার বেদনা।পরিবেশ আন্দোলনের তিনি ছিলেন পিতাসম এক ব্যক্তিত্ব। মৃদুভাষী মানুষ পরিবেশবিদ হিসেবে সুন্দরলাল বহুগুণা বলে গেছেন, ‘যা কিছু করেছি, সবই পরিবেশ আর প্রকৃতিকে ভালোবেসে’।গাঢ়বাল মারোরা গ্রামের জীবন ছিল গঙ্গা। শৈশব থেকেই গঙ্গা হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রথম প্রেম। গ্রামের স্কুলে পড়াশুনো শেষ করে ইন্টার মিডিয়েট পাশ করে চলে গেলেন লাহোরে। উচ্চ শিক্ষার জন্য। সেখানকার এস ডি কলেজ থেকে বি এ পাশ করলেন। সময়টা অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তরুণ সুন্দরলাল দেশপ্রেমের শপথ নিলেন। ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেশের কাজে। গাঁধিজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মন্ত্রকে সামনে রেখে।ব্রিটিশ পুলিশ তাকে ধরে জেলে পুড়ে দিল। বিচারে জেল হল পাঁচ মাসের। আজীবন তিনি গাঁধিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।স্বাধীনতার পর রাজনীতিকেই প্রাধান্য দিলেন। জড়িয়ে পড়লেন দৈনন্দিন রাজনীতির সঙ্গে। জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব নিলেন।

স্বাধীনতা উত্তর ভারতের পঞ্চাশ-ষাটের দশকে দেশে ছিল জাতপাত আর অস্পৃশ্য নামক এক সামন্ত সংস্কৃতির ভয়াবহ উপস্থিতি। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের সমাজপ্রভুরা কিছু মানুষকে ‘জাতপাত’-র নামে অন্ত্যজ করে রেখে দিয়েছিল। ছোঁয়াছুঁয়ির বিধিনিষেধের বেড়াজালে নীচু জাত বলে দেগে দিয়ে।আজও কি আমরা ‘জাতপাত’ নামক ওই অভিশাপ থেকে মুক্ত? সেই সময় অনেক হিন্দু মন্দিরে নীচু জাতের মানুষদের প্রবেশ করতে দেওয়া হত না। সুন্দরলালের নিজের গ্রাম গাঢ়বালের গ্রাম্যজীবনেও ছিল প্রবল জাতপাত আর তথাকথিত অস্পৃশ্য সংস্কৃতির দাপট। গাঁধিবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত তরুণ রাজনৈতিক কর্মী সুন্দরলাল উপলব্ধি করলেন অস্পৃশ্যতা নামক এই অভিশাপ থেকে নিজেদের গ্রামকে মুক্ত করতে হবে।তিনি শুরু করলেন গাঢ়বাল নামে ‘গঙ্গা মাইয়ার’ গ্রামের অস্পৃশ্যতা নামক চিরন্তন এক অভিশাপের বিরুদ্ধে লড়াই। এই কাজ করতে গিয়ে একই পথে দেখা পেলেন গাঁধিজির ইংরেজ-শিষ্যা মীরা বেনের। মীরা তাঁকে পথ চেনালেন। মীরা বললেন, ‘গ্রামের মানুষের সেবায় নিজেকে সমর্পণ করো। গ্রামের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি হবে না।’

আদর্শবাদী সুন্দরলাল বেছে নিলেন গাঁধিজির সেবার আদর্শকে। দেখা পেলেন আরও একজনের। মীরা বেনের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতেন বিমলা নামে এক তরুণী। পরবর্তী জীবন একসাথে চলার জন্য তাঁকেই বেছে নিলেন।বিমলা আর সুন্দরলাল গাঁধিবাদী আদর্শকে সামনে রেখে বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়লেন। তৎকালে তাদের সমসাময়িক অনেকেই ভেবেছিলেন তাঁরা দুজনেই সক্রিয় রাজনীতিকে বেছে নেবেন। কিন্তু না তাঁরা সে পথে গেলেন না। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, গ্রামের উন্নতি না করলে সমাজ বা দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। গাঁধিজির আদর্শ তাঁদের এই শিক্ষা দিয়েছে। বাড়ির কাছে সিলিয়ার গ্রামে গড়ে তুলেছিলেন ‘নবজীবন আশ্রম’।তেহরিতে তৈরি করেন ‘ঠক্কর বাপা হস্টেল’। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতেন তাঁরা দু’জনে। কাজ শেষে স্কুল চালাতেন। দৈনন্দিন সেবার কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখতেন। অতি সামান্য উপার্জনে সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তাঁরা।

সুন্দরলালের জীবনসময়ে বাঁক নিল আর এক অধ্যায়ের। তিনি ‘হিমালয়পুত্র’ হিসেবে খ্যাত হবেন। পরিবেশ আন্দোলনকে যিনি এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ‘চিপকো’-র আন্দোলন নামে। ১৯৭০ সালে যে আন্দোলনের শুরু। বন সংরক্ষণে ‘চিপকো’-র আন্দোলন আমাদের মনে রাখতেই হবে।মনে রাখতে হবে নদী, গাছ, জল-জংলার পরিবেশ বাঁচাতে ‘অরণ্যবান্ধব’ সুন্দরলাল বহুগুণার কথা। গঢ়বাল ও কুমায়ুনের প্রকৃতি সংরক্ষণে সতত সরব ছিলেন সেই ঋজু মানুষটি। চিপকো আন্দোলনের জন্য ৪৮৭০ কিমি পথ হেঁটেছেন। ১৯৮১-৮৩ সালে কাশ্মীর থেকে কোহিমা পর্যন্ত হেঁটেছিলেন তিনি। তেহরি বাঁধ তৈরির প্রতিবাদে ৮৪ দিন অনশন করেছেন। ১৯৭৩ সালে এক শিল্পপতি অলকানন্দা নদীর সংলগ্ন একটি অঞ্চলে খেলনার কারখানা করার জন্য সেই অঞ্চলে গাছ কাটতে উদ্যোগী হলেন। প্রতিটি গাছকে ঘিরে দাঁড়ালেন মেয়েরা। গাছকে জড়িয়ে ধরে নতুন আন্দোলনের ভাষা চেনালেন তাঁরা। অরণ্য রক্ষায় আমরা ফিরে পেলাম প্রাচীন আন্দোলনকে। তারপরেও তিনি থামেননি।২০১৩ সালে কেদার বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করে পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম কর্মী ৮৬ বছরের পদ্মবিভূষণ সুন্দরলাল বহুগুণা বলেছিলেন, ‘’যদি এত বিপুল অরণ্য ধ্বংস না হত গঢ়বালে, তাহলে  নদীধসে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হত না।‘’ তাই তাঁর মৃত্যু সারা বিশ্বকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘সুস্থ পরিবেশই একমাত্র স্থিতিশীল অরথনীতি’।                                                               

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?