মগজে কার্ফুঃ হোম সেন্টারে দুই পরীক্ষা কেন নয়!
দীপেন্দু চৌধুরী
কোভিড পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এ বছরের মতো বাতিল করা হয়েছে
মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা।৭ জুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান,
‘’সোমবার(৭ জুন) বেলা ২টো পর্যন্ত ৩৪ হাজার ই-মেল পেয়েছি। তার মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার
বিপক্ষে ৭৯ শতাংশ মানুষ মত দিয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার বিপক্ষে মত দিয়েছেন ৮৩
শতাংশ। এটা সাধারণ মানুষের মত। অনেক ছাত্রছাত্রীও মতামত দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম
কোর্টেরও একটা মতামত রয়েছে। আমাদের বিশেষঞ্জ কমিটিও বলেছে, এই কোভিড পরিস্থিতিতে পরীক্ষা
নেওয়া উচিত নয়। অনেক স্কুলে সেফ হোম হয়েছে। তাই আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা
নিচ্ছি না।‘’ মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি আবু তাহের কামরুদ্দিন জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর
নির্দেশ অনুযায়ী আলিম, ফাজিল, হাই মাদ্রাসা পরীক্ষা বাতিল হল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দশ বছর পার করেছেন। এই বারও তিনি বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হয়ে ফিরে
এসেছেন।
দশ বছর প্রশাসন চালানোর পর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা অনেক বেশি
সহনশীল।অনেক বেশি সহিষ্ণু।একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রথম ভাগে বিরোধীনেত্রী এবং
রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক হিসেবে তার মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা দেখা যেত।২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী
হিসেবে মমতা মহাকরণে যখন প্রবেশ করেন তখন তিনি অভিমন্যুর মত প্রবেশ দ্বারটা চিনতেন।
প্রশাসনে কি ভাবে প্রবেশ করতে হবে সেই অভিঞ্জতা তার কেন্দ্রের মন্ত্রী থাকার সুবাদেই
হয়েছিল। কিন্তু নিষ্ক্রমণ তিনি সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে পারেননি। দক্ষ রাজনীতিবিদরা যেমনটা
করে থাকেন।পরবর্তীতে সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন বলা যায়। বিগত কয়েক বছর তিনি
আমলাদের উপর নির্ভরশীল হলেও সামগ্রীক অর্থে
আত্মসমর্পণ করেন না। বর্তমানে কর্পোরেট দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে
তিনি প্রশাসন চালাতে চাইছেন। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে আছে, দক্ষ শাসক ভালো উপদেষ্টা নিয়োগ
করেন। তাঁদের কথা শোনেন। বর্তমান সময়ে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যথা রাজ্যের প্রধান প্রশাসক
হিসবে তিনি অনেক অনেক পরিণত। আমরা মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করতে চাইছি না। অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী
বিজেপির সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, গণতান্ত্রিক দেশে সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে।
এই প্রতিবেদনে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরতে চাইছি। প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গ
সরকার যে ছয় সদস্যের বিশেষঞ্জ কমিটি করেছিল সেই কমিটি নিয়ে। আমাদের রাজ্যে কয়ক ডজন
শিক্ষক সংগঠন আছে। তাঁদের থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি এই বিশেষঞ্জ দলে মুখ্যমন্ত্রী রাখতে
পারতেন। তাতে ভিন্নমত উঠে এলেও ছয় সদস্যের টিম সমৃদ্ধ হত। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের নেতৃত্ব
ইতিমধ্যেই সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকে(শিক্ষক-শিক্ষিকা) রাজ্য সরকার
পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না কেন?
তাঁদের আরও প্রশ্ন রাজ্যের কতজন সাধারণ মানুষ, ছাত্রছাত্রী
এবং অভিভাবক পরামর্শ দিতে পেরেছেন? কারণ সারা রাজ্য কতজনের ই-মেলে মতামত দেবার যোগ্যতা
আছে? এবং গ্রাম বাংলার ছাত্রছাত্রীদের কাছে ট্যাব(রাজ্য সরকারের দেওয়া অনুদানের টাকায়
সব ছাত্রছাত্রী আদৌ ট্যাব কিনতে পেরেছি কি?)থাকলেও সেখানে নেট সংযোগ পাওয়া সম্ভব? প্রত্যন্ত
অঞ্চল বাদ দিয়ে কোথাও কোথাও নেট সংযোগ থাকলেও নেট খরচ দেবে কে? করোনাকালে অনেক অভিভাবকের
কাজ নেই। তাঁদের সংসার চলছে ত্রাণের উপর নির্ভর করে। তারা ই-মেল করবে কি করে? অভিযোগ
শোনা যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী যে ৩৪ হাজার ই-মেল পাওয়ার কথা সাংবাদিকদের ৭ জুন বলেছেন,
সেগুলি নির্দিষ্ট কয়েকজন বিশেষ অভিভাবকের ই-মেল। কারণ রাজ্যে ১২০০ মাধ্যমিক স্কুল এবং
৭০০০ উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের ২১ লাখ পরীক্ষার্থী আছে।মাধ্যমিকের ১২ লক্ষ, উচ্চ মাধ্যমিকের
সাড়ে আট লক্ষ। তা হলে ধরে নেওয়া যেতে পারে প্রায় ২১ লক্ষ অভিভাবক আছেন। তাঁদের মধ্যে
থেকে মাত্র ৩৪ হাজার ই-মেল পেল বিশেষঞ্জ কমিটি? শিক্ষক সংগঠনের অভিযোগ, সরকার আগেই
সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন পরীক্ষা না নেওয়ার। বিশেষঞ্জ কমিটি সরকারকে সাহায্য করতে
মুখ্যমন্ত্রীকে ই-মিলের যে হিসেব দিয়েছে সেটা সম্পাদিত সংখ্যার ই-মেল নয়ত? বিশেষঞ্জ
কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনা আবহে পড়ুয়াদের স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া বাস্তবসম্মত
নয়। মুখ্যমন্ত্রী ইতিপূর্বে ২৭ মে ঘোষণা করেছিলেন জুলাইয়ে উচ্চ মাধ্যমিক এবং অগস্টে
মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে। ২৭ মে থেকে ৭ জুন। মাত্র ১০ দিনের ব্যবধান এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী
তথা প্রশাসন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলার আসল কারণ কি? করোনা বিধি মেনে ‘হোম সেন্টার’-এ
পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা করা যেত না? বেশির ভাগ শিক্ষক সংগঠন জানিয়েছে, তারা পরীক্ষার
পখেই মত দিয়েছিল।তাঁদের বক্তব্য ছিল, সময় কমিয়ে দেওয়া হোক। কম নম্বরে, হোম সেন্টারে
পরীক্ষা হোক। কারণ পশ্চিমবঙ্গের ২১ লক্ষ শিক্ষার্থী চরম উৎকণ্ঠায় ভুগছে। তাঁদের উৎকণ্ঠা
আগামী ভবিষ্যৎ নিয়ে।কারণ মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ছাত্রছাত্রীদের কাছে নিজেদের
পছন্দের উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার অন্যতম সোপান। নিজেদের মেধা যাচাই না করতে পারার একটা যন্ত্রণা
তাঁদের সারা জীবন পীড়া দেবে। পরপর দু-বছর পরীক্ষা দিতে না পেরে একরকম মানসিক বিপর্যয়ের
সম্মুখীন আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা। বাংলার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
করোনা মহামারির মধ্যেই কেরালা সরকার পাঁচ হাজার কেন্দ্রে দূরত্ববিধি
মেনে এপ্রিল মাসে ১০ লক্ষ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষার ব্যবস্থা
করেছিল। ছাত্রছাত্রীরা নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিয়েছে। আগামীতে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা
মূলক সর্বভারতীয় পরীক্ষায় কেরলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমাদের রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা
তুলনামূলকভাবে ভালো ফল করতে পারবেতো? করোনার আবহের কারণে রাজ্যের যে সব ছাত্রছাত্রীরা
দু-দু’টো বছর পরীক্ষায় বসতে ব্যর্থ হল, তাঁদের কথা বলছি।
পরীক্ষা না হওয়ার কারণে মূল্যায়নের বিষয়ে যে সব মানদণ্ড ধরা
হয়েছে সেগুলি নিয়ে আলোচনা করছি না।গত বছরও করোনার কারণে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক
পরীক্ষা হয়নি। এর জন্য ছাত্রছাত্রীদের মগজে একপ্রকার অঘোষিত কার্ফু চলছে। ছাত্রছাত্রীদের
মানসিক অবস্থার কথা জানতে কি সরকারের ছয় সদস্যদের বিশেষঞ্জ কমিটি খোঁজ নিয়েছেন? বা
উদাসীন শিক্ষা দফতর অবসাদগ্রস্ত মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্রছাত্রীদের বিষয়ে কতটা
চিন্তিত? দু-দু’টো বছর পরীক্ষা দিতে না পারার অনুশোচনায় ওরা ভুগছে। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের
ভবিষ্যৎ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী কতটা দায়িত্বশীল? যদিও মুখ্যমন্ত্রী ১৪ জুন বলেছেন, দেখতে হবে ছাত্রছাত্রীদের
যেন কোনও রকম মানসিক যন্ত্রণা না হয়।ছাত্রছাত্রীদের অবসাদের কথা উল্লেখ করছি একটি অবাঞ্চিত
আত্মহত্যার ঘটনা দিয়ে। ১৬ বছর বয়সী কুচবিহারের দিনহাটার গোপালনগর হাইস্কুলের মেধাবী
ছাত্রী বর্ণালী বর্মণ পরীক্ষা বাতিল হওয়ার অবসাদে আত্মঘাতী হয়েছে। তার ইচ্ছে ছিল উচ্চ
শিক্ষা শেষ করে ভালো চাকরি নিয়ে বাবার পাশে দাঁড়াবে। সুইসাইড নোটে বর্ণালী লিখে গেছে,
‘’তোমার সব কাজের দায়িত্ব নিতে পারলাম না বাবা।‘’
আমরা যারা ষাট বছর বয়স টপকেছি তারা খুব মনে করতে পারি, বিগত
শতাব্দীর সত্তর দশকে আমরা একবার স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা দিতে পারিনি। রাজনৈতিক হিংসার
কারণে সারা রাজ্য জুড়ে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল।
এই কারণে আমাদের প্রজন্মের অনেকের স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। ‘সোসাইটি ফর হেড
মাস্টার্স অ্যান্ড হেড মিস্ট্রেস’ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার মাইতি রাজ্যের
মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে আবেদন জানিয়েছেন।
৭ জুন এক বিবৃতিতে তিনি লিখেছেন, ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনায় মন না দিয়ে হতাশায় অন-লাইন
গেম খেলছে। একটা প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে।স্পেশাল ট্রেন-বাসের ব্যবস্থা করে, শারীরিক
দূরত্ববিধি মেনে, যথাযথভাবে ক্লাসরুম স্যানিটাইজ করে হোম সেন্টারে পরীক্ষা নেওয়া হোক।
তা না হলে উপযুক্ত মেধা তার মূল্য পাবে না। রাজ্যের প্রায় সব শিক্ষক সংগঠন ‘হোম কেন্দ্রে’
এই পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।
Comments
Post a Comment