অগ্নিমূল্য বাজারের দহনে মানুষের দিশাহারা অবস্থা






দীপেন্দু চৌধুরী  

অনেকেই কথাটা বলছেন, বাব্বা বাজারে কোনও জিনিসে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। আগুন দাম।হাত পুড়ে যাচ্ছে।নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছা-পোষা কেরানিবাবু বলছেন, সকালে বাজার করতে গেলে প্রতিদিন সবজির দাম, মাছের দাম বাড়ছে। গোষ্ঠগোপাল বাবুরা মাছ-সবজির বরাদ্দ হিসেবে ৩০০-৪০০ টাকা প্রতিদিন খরচ করতে পারছে। তাতে হয়ত সঞ্চয় কমছে তাদের। কিন্তু রাজ্য সরকারের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে অন্য অভিঞ্জতার কথা। ওদের বক্তব্য, আরে ওরা তাও পারবে কারণ অফিসার-কেরানি বাবুদের বেতন অনেকটাই বেড়েছে। আমাদের অবস্থা আরও খারাপ। প্রতিদিন মাছ খাওয়ার কথা ভুলেই গেছি। মাছ কিনতে গেলে সবজি কিনতে পারছি না। সবজি কিনতে গেলে মাছ কিনতে পারছি না।আনাজের দাম বেড়েই চলেছে। তারপর ওষুধের টাকা আছে। এর থেকে আরও বড় সমস্যা সর্ষের তেল, ডাল, আটা, চাল, চিনি বা মুদিখানার জিনিসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।সর্ষের তেল প্রায় ২০০ টাকা। ভাবুন একবার কোন রামরাজ্যে আছি আমরা। করোনার সময়ে আবার প্রোটিন না খেলে হবে না।তাই পাতে ডিম রাখছি। সুগার ফ্রি মাছ (চারাপোনা), তেলাপিয়া দিয়ে দুপুরেরটা চালিয়ে নিতে হচ্ছে। এভাবে যে কতদিন চলবে কে জানে? নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের বা রাজ্য সরকারি কেরানি বা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীরাও তাও লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারছেন কিন্তু ‘দিন আনি দিন খাই’ যারা তাদের কি অবস্থা? সাধারণ মানুষ কি করবে? বাজারে এখন খুব কম যাই। বাড়ির সামনে ঠেলা নিয়ে যারা সবজি বিক্রি করতে আসে, তাদের থেকেই আনাজপাতি কিনে নেওয়া যায়। একদিন এমনই এক ঠেলাওয়ালার কাছ থেকে সবজি কিনছিলাম।ওরা অসম বয়সি দু’জন এক সঙ্গে আসে।কখনও কখনও মাছ নিয়েও আসে।সেদিন যে ছেলেটি সবজি ওজন করছিল তার হাত কাঁপছিল।দেখেই বোঝা যাচ্ছিল আনাড়ি হাত। সেদিন আমি বুঝতে পারিনি। পরে জানতে পারলাম ও এই লাইনে সদ্য এসেছে। বয়স খুব কিছু বেশি নয়। কৌতুহলবশতঃ জানতে চাইলাম ওদের কেমন আয় হয় প্রতিদিন। ওরা প্রথমটায় আমতা আমতা করছিল। পরে বলল, ঠিক থাকে না। কোনওদিন ২০০ টাকা আবার কোন কোনও দিন একটু বেশি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। ওরা দু’ই ভাই। একজন কলেজে বিএ পড়ে আর দ্বিতীয় জন এগার ক্লাশে পড়ে। বাবা একটা ছোট কারখানায় কাজ করত। গত বছর লক ডাউনের সময় বাবার চাকরি গেছে। আর কাজ পায়নি। বাবা এখন বেকার। ওরা দু’ই ভাই দশ-পনের কিলোমিটার উজিয়ে কলকাতার উপকণ্ঠে বিভিন্ন শহরতলি ঘুরে ঘুরে সবজি বিক্রি করে। কোনও কোনওদিন মাছও বিক্রি করে।প্রশ্ন উঠছে করোনা মাত্র দেড় বছর এসেছে। কিন্তু মোদী সরকার সাত বছর। দেশের ২৩ কোটি লোক দারিদ্রসীমার নীচে চলে গেছে মোদী জামানায়। একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, দিন মজুর এবং ছোট ব্যবসায়ী মিলিয়ে কাজ হারিয়েছে প্রায় ১৭ মিলিয়ন মানুষ। ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত গবেষকরা হিসেব দিচ্ছেন, বেরোজগারি পৌচেছে ১১.৯ শতাংশে।উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে ভারত তুলানামূলক উন্নয়নসূচকে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপালের থেকেও পিছিয়ে পড়েছে।          

দু’একটা ছবি ধরতে চেষ্টা করলাম, আধুনিক ভারতের এক অঙ্গ রাজ্যের কলমচির টেবিল থেকে। মানুষ যে কতটা দুঃসহ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে সেটা কিছুটা সংবাদ মাধ্যমে আসলেও পুরোটা কি পাওয়া যায়? করোনা মহামারি জেনেও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও রকম হেলদোল নেই।মোদী সরকার এখন ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ নিয়েই ব্যস্ত। সামনে পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন। সদ্য পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপির ‘হিন্দুত্ব’ অ্যাজেন্ডা কাজে আসেনি। বিশেষত আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। প্রায় ১৩৫ বছরের বেশি কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রভাব এই রাজ্যকে আজও টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পাসাপাশি বামপন্থীরাও দাবি করছে, তারা বিধানসভায় একটি আসন না পেলেও মোদী-শাহ-র ‘যুগলবন্দি’-তে অপরাজেয় হিন্দুত্ব রাজনীতিকে আটকে দিতে পেরেছে।কারণ পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী রাজণীতি, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের প্রভাব ১০০ বছরের। ২০২২ সালে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ‘মোদী-শাহ’-র কাছে অতি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসছে। কারণ উত্তরপ্রদেশে নির্বাচন আছে। তারপরেই ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট। তাই বিজেপি অনেক বেশি আক্রমণাত্বকভাবে রাজনীতির ময়দানে থাকতে চাইবে। সামাজিক উন্নয়ন বিশেষত সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা বিজেপি গভীর প্রত্যয়ে দেখতে কোনওদিনই আগ্রহী নয়।করোনার কারণে সরকারের উদাসীনতা নিয়ে ইতিমধ্যেই ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ভারতের সমালোচনা করেছে। প্রথম সারির কয়েকজন শিল্পপতির স্বার্থ দেখতেই বিজেপি ব্যস্ত।পেট্রল, ডিজেলের দাম বেড়েই চলেছে। মহামারির সময়ে মোদী সরকার পেট্রল-ডিজেলের উপর কর বাবদ ২.৭৪ লাখ কোটি টাকা কর হিসেবে বাজার থেকে তুলেছে। এই টাকা দিয়ে কি কি করা সম্ভব? সারা দেশে বিনামূল্যে ভ্যাকসিনের জন্য খরচ হবে ৬৭,০০০ কোটি টাকা। ৭১৮ টি জেলায় অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানো সম্ভব আদায়ীকৃত করের  টাকায়।২৯টি রাজ্যে ‘এমস’ হাসপাতাল গড়ে তোলাও সম্ভব ওই টাকা খরচ করেই। ২৫ কোটি গরিব মানুষকে মাসে ৬০০০ টাকা করে প্রতি মাসে দেওয়া সম্ভব। যে দাবি গত কয়েক বছর কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা করে আসছে। এই দায়িত্বকে অস্বীকার করে মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকার পেট্রল-ডিজেল এবং গ্যাসের দাম বাড়িয়েই চলেছেন।গত এক বছরে পেট্রল-ডিজেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে, ২০২০ সালে ৬ জুন পেট্রলের দাম ছিল ৭১ টাকা ২৬ পয়সা। এই বছর ৬ জুন  পেট্রলের দাম হয়েছে ৯৫ টাকা ০৩ পয়সা। গত বছর ৬ জুন ডিজেলের দাম ছিল ৬৯ টাকা ৩৯ পয়সা। এই বছর ৬ জুন ডিজেলের দাম হয়েছে ৮৫ টাকা। ৯৫ পয়সা। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী দেশের কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ সহ আটটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিভিন্ন শহরে পেট্রলের দাম ১০০ টাকা। ১২ জুন পেট্রল এবং ডিজেলের দাম সমান ছিল। অর্থাৎ ১০০ টাকা। করোনাকালে মানুষের নাজেহাল অবস্থা অথচ পেট্রল-ডিজেলের দাম  এক বছরে কর বাবদ কেন্দ্রীয় সরকার আয় করেছে ২.৫ লাখ কোটি টাকা। পেট্রপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ১১ জুন সারা দেশে কংগ্রেস প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করেছে।সূত্রের খবর, চলতি মাসে ট্রাক মালিকদের সংগঠন পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সারা দেশে ধর্মঘট ডাকতে পারে।    

পেট্রল-ডিজেল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ কেন্দ্র অত্যাবশ্যক পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন তুলে দিয়েছে। যে কারণে কৃষকরা ন্যুনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি)পাচ্ছে না। গত ছ’মাস যাবত দিল্লি সীমান্তে বিতর্কিত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষকরা যে আন্দোলন করছে তাদেরও অন্যতম দাবি ন্যুনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকারের দিক থেকে কোনও উচ্চবাচ্চ নেই। দেশের প্রথম সারির কয়েকজন শিল্পপতির স্বার্থের দিকেই সরকারের নজর বেশি।

আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভাইরাল’ খবর অত্যন্ত জনপ্রিয় হচ্ছে।মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে এমনই একটি খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। খবরটি হচ্ছে, নিজের দাড়ি নয়, অন্যের কাজের সুযোগ বাড়ান। মোদীকে নাপিত খরচের টাকা পাঠালেন এক চা ওয়ালা। অতীতের এক চা বিক্রতাকে দাড়ি কাটার জন্য ১০০ টাকা মানিঅর্ডার করেছেন বর্তমানের এক চা বিক্রেতা। আমারা জানি প্রধানমন্ত্রী নিজেকে ‘চাওয়ালা’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তাঁকে নাপিত-খরচ বাবদ ওই টাকা পাঠিয়ে মহারাষ্ট্রের এক চা বিক্রেতা একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘’যদি কিছু বাড়াতেই চান, তবে কাজের সুযোগ বৃদ্ধি করুন, দেশে টিকাকরণের হার এবং হাসপাতালের সংখ্যা বৃদ্ধি করুন।‘’ মহারাষ্ট্রের বারামতির ওই চা বিক্রেতা আরও বলেছেন, ‘’লকডাউনে প্রধানমন্ত্রী নিজের দাড়ি বাড়িয়েছেন।‘’ মৃত্যু মিছিলের শোক মানুষকে প্রতিবাদের জন্য নতুন ভাষা খুঁজে নিতে বাধ্য করছে। সত্যিই, হ্যা সত্যিই মানুষ আজ বড় অসহায়! মানুষ দিশেহারা হয়েও বাঁচতে চায়। চিৎকার করে বলছে ‘আমি বাঁচতে চাই, আমরা বাঁচতে চাই’।                                                   

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?