বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের হারকে কেন মেনে নিতে পারছে না!
দীপেন্দু চৌধুরী
আলোচ্য ‘নারদ’ কতটা রামায়ন বা মহাভারতের? আর কতটাই
বা ‘বংগাল’ রাজ্যের
রাজ্য-রাজনীতি? গত পাঁচ-ছ বছর ‘নারদ’ নামক এই বংগাল এপিসোডের কোনও লাতাপাতা ছিল না। ‘বংগাল’ থুরি আমাদের বাংলার সপ্তদশ নির্বাচন শেষ
হতেই আইনি তথা রাজনৈতিক হাতিয়ার ‘নারদ’ মামলা হাতে তুলে নিয়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয়
নেতৃত্ব। প্রশাসনিকভাবে সরকারি সংস্থা সিবিআই (সমালোচকদের ভাষায়, খাঁচাবন্দি তোতা)-কে সামনে রেখে। এই
বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হওয়ার মতো যথেষ্ট যুক্তি কেউ দিতে পারবেন বলে মনে হয় না।
কারণ সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের পরে আমাদের আলোচ্য মতামত আরও জোর
পাচ্ছে। আইন আইনের পথে চলবে এ কথা বলতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে নারদ মামলায় গত
১৭ মে তৃণমূল কংগ্রেসের দু’জন মন্ত্রী যথাক্রমে সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও ফিরহাদ হাকিম,
বিধায়ক মদন মিত্র এবং প্রাক্তন মেয়্রর
শোভন চট্টোপাধ্যয়েকে সিবিআই গ্রেফতার করে। এই গ্রেফতার প্রতিহিংসা ছিল না পরবর্তী
ভোট প্রস্তুতি? নারদ-কান্ডে অভিযুক্ত চার নেতামন্ত্রীকে গৃহবন্দি রাখার নির্দেশ
দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। সেই রায়ের বিরুদ্ধেও সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিল
সিবিআই। সুপ্রিম কোর্ট এই মামলায় কোনও রায় দেয়নি। সিবিআই মামলা প্রত্যাহার করে
নেয়। আইনজীবীদের কারও কারও অভিমত শীর্ষ আদালতে মুখ পোড়ার ভয়েই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী
সংস্থাটি মামলা প্রত্যাহার করে নেয়।
এই ঘটনায় আবারও
প্রমাণ হয়ে গেল বিজেপি ছলে বলে কৌশলে নিজেদের কতৃত্ব প্রমাণ করতে চাইছে।
হাইকোর্টের পাঁচ বিচারপতি নিয়ে গঠিত বৃহত্তর ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে গত ২৮ মে চার
নেতা ও মন্ত্রী অন্তর্বর্তী জামিন পেয়েছে।মামলার শুনানি এখনও চলছে। ‘বংগাল’ দখল
সম্ভব না হলেও রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে বারেবারে তাঁরা আইনের রাস্তায় টেনে আনার
চেষ্টা করছে। এবং আগামীতেও করবে এমনটা অনুমান করা যায়। সেই প্রচেষ্টা কতটা
সাংবিধানিক আর কতটাই বা অসাংবিধানিক এই প্রশ্নও তুলতে শুরু করেছেন রাজনৈতিক
বিশ্লেষক এবং আইনজীবীরা। অথবা বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে না পেরে কেন্দ্রের
অতি সক্রিয়তার অভিযোগও উঠে আসছে। পরবর্তী ঘটনা পরম্পরা দেখলেই হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির
উদ্দেশ্য আমাদের কাছে ছবির মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সম্প্রতি রাজ্যের
মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লি বদলির নির্দেশনামার পরে যে তত্বে সিলমোহর
দিয়েছে কেন্দ্র নিজেই। নতুন এই অধ্যায়ের সূচনা হয় গত ২৮ মে। কলাইকুন্ডায়
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘ইয়াস’ পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য এই বৈঠক
ডেকেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী রাজ্যে এলেন কিন্তু রাজ্যের দুর্যোগ কবলিত কোনও
এলাকায় তিনি পরিদর্শনে গেলেন না। কেমন যেন ধোঁয়াশা ঠেকছে না? ২৮ মের বৈঠকে
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় কেন উপস্থিত
ছিলেন সেই বিতর্কও সামনে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে
বৈঠক করে আমাদের রাজ্যে এসেছিলেন। সেই বৈঠকে কি ওড়িশার রাজ্যপাল ছিলেন? অথবা
বিরোধী দলনেতা? জানা গেছে ওড়িশার বিরোধী দলনেতা করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারণে
উপস্থিত থাকতে পারেননি। মেনে নেওয়া গেল কিন্তু তার ডেপুটি নিশ্চয় আছেন। তাঁকে
আমন্ত্রণ জানানো হল না কেন? তা হলে পশ্চিমবঙ্গে কেন উলট পুরাণ? ২৮ মের বৈঠকে
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী (তৃণমূল কংগ্রেস থেকে যাওয়া দলবদলু
নেতা) স্বদর্পে হাজির ছিলেন। গুজরাতের ঝড়ের পরে সে রাজ্যে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী
যখন বৈঠক করেন, সেই বৈঠকে ছিলেন না কোনও বিরোধী দলনেতা। কংগ্রেসের গুজরাতের নেতা
ভরত সোলাঙ্কি বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছেন, ‘বাংলায় বিরোধী দলনেতাকে প্রধানমন্ত্রী
ডেকেছেন জেনে ভাল লাগল। কিন্তু গুজরাতের ঝড়ের পর তাঁর সে রাজ্যে সাম্প্রতিক সফরের
সময় মোদী গুজরাতের বিরোধী দলনেতাকে ডাকতে ভুলে গেলেন কী ভাবে! আমি গোটা বিষয়টাতে
অবাক।’ প্রশ্ন উঠেছে, করোনা অতিমারি নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী কি বিরোধীদের
সঙ্গে বা বিরোধীদলের নেতার সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন?
দুর্যোগ পরবর্তী ওই
দিনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথামাফিক উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে
দুর্যোগ কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে অতি ব্যস্ততার মধ্যেও মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের
ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন
মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যসচিবকে সঙ্গে নিয়েই পূর্ব নির্ধারিত দিঘার
প্রশাসনিক বৈঠকে চলে যান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাওয়ার আগে
প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়েছিলেন মমতা। এ দিন থেকেই ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়’ কাঠামো
ব্যবস্থার বিতর্কিত অধ্যায়ের আলোচনা নতুন করে উত্থাপিত হয়।
কারণ ২৮ মে রাতেই
মুখ্যসচিবকে দিল্লিতে ডেকে কেন্দ্রীয় কর্মীবর্গ ও প্রশিক্ষণ দফতরে যোগ দেওয়ার কথা
বলে কেন্দ্র। ঘটনাচক্রে মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবসরের দিন ছিল ৩১ মে।
উল্লেখ্য রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে কেন্দ্র মুখ্যসচিব হিসেবে আলাপনবাবুর চাকরি
মেয়াদ আরও তিন মাসের জন্য বাড়ানোর অনুমোদন দিয়েছিল। তারপরেও ২৮ মে রাতে দিল্লিতে
ডেকে পাঠানোকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মেনে নিতে
পারেননি। তিনি বলেছেন, ‘’শুধু আমাকে
অপছন্দ করেন বলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে এটা করা হয়েছে। বাংলায় ওরা হেরেছে,
মানুষ ওদের প্রত্যাখ্যান করেছে। সেটা ওরা মানতে পারছে না।‘’
বিষয়টা নিয়ে যখন
বিতর্ক শুরু হয়েছে তখন রাজ্যের একাধিক প্রাক্তন আমলা কেন্দ্রের সমালোচনায় সরব
হয়েছেন। প্রাক্তন মুখ্যসচিব সমর ঘোষ, অর্ধেন্দু সেন ও জহর সরকার। প্রাক্তন
কেন্দ্রীয় অর্থসচিব সুভাষচন্দ্র গর্গ ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মুখ্য তথ্য কমিশনার
ওয়াজাহাত হাবিবুল্লা। তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন মতামত থেকে উঠে আসছে মুখ্যসচিব পদে
চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর পরে সেই অফিসারকে সরানো হলে তাকে বিধিসম্মত বলা যাবে না।
তাঁদের মূল বক্তব্য, কেন্দ্রের হাতে ক্ষমতা থাকতে পারে যে কাউকে বদলি করার, কিন্তু
যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
কারণ রাজ্য সরকারের যদি তার অফিসারের উপরে নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তা হলে তারা কাজ
করবে কি করে? কেন্দ্র বলতে চাইছে মুখ্যসচিব হিসেবে আলাপনবাবু ২৮ মের পর্যালোচনা
বৈঠকে হাজির না থেকে প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করেছেন। কেন্দ্রের এই যুক্তি আদপে
আত্মরক্ষার একটা কৌশল। প্রাক্তন আইএএস অফিসারদের বক্তব্য রাজ্যের ক্ষেত্রে
মুখ্যসচিব সহ যে কোন অফিসার মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনতে বাধ্য।
কংগ্রেসের কেন্দ্রীয়
নেতৃত্ব রাজ্যের পাশে দাঁড়িয়েছে। আলাপনবাবুর বদলির নির্দেশ বিষয়ে কংগ্রেস আবেদন
করেছে, সমস্ত সংবিধান বিশেষঞ্জ, আইনজীবী, নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সমস্ত দেশবাসীর
উচিত ভারতীয় সংবিধান এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর বিজেপি সরকারের এই ক্ষমাহীন
আক্রমণের নিন্দা করা। কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা এক বিবৃতিতে বলেছেন,
‘রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, যখন-তখন এ ভাবে সর্বভারতীয় আমলাদের কেন্দ্র
যদি ডেকে পাঠায়, তা হলে দেশের সার্বিক আইনের কাঠামো এবং সংবিধান ভেঙ্গে পড়বে।’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী এবং সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যও রাজ্যের
পাশে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের সমালোচনা করেছেন। সিপিএম থেকেও কেন্দ্রের অতি সক্রিয় এই
সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সমালোচনা করা হয়েছে। দক্ষ এক প্রশাসককে কেন্দ্র করে
রাজ্য এবং বিরোধী দল এক বিন্দুতে আস্তে পারাটা বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে নতুন বাতাবরণ
বলতেই হবে। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি বিরোধী সর্বভারতীয় মঞ্চ গড়ে তুলতে অনেকটা
সহায়ক হবে।
Comments
Post a Comment