তিন কৃষিবিল প্রত্যাহারের দাবিতে ‘কোম্পানী সরকারে’-র বিরুদ্ধে আন্দোলন চলবেঃ টিকায়েত



দীপেন্দু চৌধুরী

অদ্ভুত এক সমাপতন, ২৬ মে ছিল কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকদের আন্দোলনের ছ’মাস পূর্তির দিন। আবার সেদিনই ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকারের বর্ষপূর্তিরও দিন।প্রায় ৪০০ কৃষকবন্ধুর মৃত্যুর অসহনীয় শোক বুকে নিয়ে অনমনীয় এবং দৃঢ় প্রত্যয়ে কৃষকরা আজও রাস্তায়। তারা বিতর্কিত তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আজও সমানভাবে সোচ্চার। তাদের আন্দোলন করোনা আবহে শীত গ্রীষ্মের দুর্যোগ মাথায় নিয়েই চালিয়ে যাচ্ছেন। গত বছ্রেরর শেষ ডিসেম্বরের দিল্লির কনকনে ঠান্ডায়, খোলা আকাশের নীচে সংযুক্ত কিসান মোর্চার আন্দোলনের শুরুয়াত।২৬ মে ছিল সেই দিন।তারপরে দিল্লির যমুনা দিয়ে স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ জলের প্রবাহ আজও বয়ে চলেছে। ভারতীয় কৃষকদের অবস্থা সেই একই থেকে গেছে। কেন্দ্রের গয়ংগচ্ছ উদাসীন মনোভাবের কারণে দেশের অন্নদাতারা আজও দিল্লির সীমানায়। খোলা আকাশের নীচে দেশের খাদ্যশস্য নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে তারা। ভারতে কৃষক বিক্ষোভের ছ’মাস ব্যাপী দীর্ঘ এই বিক্ষোভ আন্দোলন সারা বিশ্বে নজিরবিহীন। তাঁদের ধৈর্য এবং প্রত্যয় সারা বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের কাছে উদাহারণ হয়ে থাকবে। সংযুক্ত কিসান মোর্চা ২৬ মে কালা দিবস পালনের আহবান জানায়। বিভিন্ন ট্রেডইউনিয়ন, ফেডারেশন এবং বিভিন্ন গণসংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ সমস্ত স্তরের শ্রমিক কর্মচারী ও কৃষকদের ২৬ মে কালো ব্যাজ পড়ে, কালো পতাকা ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে কালা দিবস পালনের আহবান জানিয়েছিল।কৃষক বিরোধী তিনটি কালা আইন বাতিল, শ্রমিক বিরোধী চারটি শ্রম কোড বাতিল, শ্রমিক ও কৃষক পরিবারের রোগীদের চিকিৎসার খরচের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। কোভিড নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্যাকসিন সবাইকে বিনামূল্যে দিতে হবে সহ ন’দফা দাবিতে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সারা দেশে ‘কালা দিবস’ পালন হয়।

কংগ্রেস, সিপিআই, সিপিআইএম এনসিপি, জেডি(এস), তৃণমূল কংগ্রেস, শিবসেনা, ডিএমকে সহ ১২ টি বিরোধী রাজনৈতিক দল ২৬ মের কালাদিবসকে সমর্থন করে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এই বিবৃতিতে কেন্দ্রের কাছে আবেদন করা হয়েছে, তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে করোনা প্যানডেমিকের কবল থেকে হাজার হাজার ভারতীয় ‘অন্নদাতাদের’ বাঁচান। যাতে তারা দেশবাসীর জন্য খাদ্য উৎপাদনের কাজে লাগতে পারে। বিবৃতিতে সনিয়া গাঁধি, এইচডি দেবগোড়া, শরদ পাওয়ার, মমতা ব্যনার্জি, ডি রাজা এবং সীতারাম ইয়েচুরি সহ আরও ছ’টি দলের নেতৃত্ব স্বাক্ষর করে দাবি জানিয়েছেন, আমরা চাই অবিলম্বে এই আইন প্রত্যাহার করে ন্যুনত্ম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) সি২+৫০ পারসেন্ট এই নিয়মে নতুন আইন আনতে হবে। যে প্রস্তাব ইতিপূর্বে স্বামীনাথন কমিশন অনুমোদন করে গেছেন। সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির (এআইকেএসসিসি) পশ্চিমবঙ্গ শাখার ২১টি কৃষক সংগঠনের পক্ষে আহবায়ক অমল হালদার এবং সম্পাদক কার্তিক পাল ২৬মের ‘কালা দিবস’-কে সমর্থন করে এক আবেদনে জানিয়েছেন, মোদী সরকারের নয়া কৃষি আইন ও নয়া বিদ্যুৎ বিল বাতিল করতে হবে।পিএম কিসানের ১৮ হাজার টাকা দিতে হবে। গত আমপান ঝড়ের পরে ত্রাণ নিয়ে যে ব্যপক দুর্নীতি হয়েছিল এই বছর ‘ইয়াস’ ত্রাণে যেন সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেই দায়িত্ব রাজ্য সরকারকে নিতে হবে।                        

ভারতবর্ষ সত্যিই এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। গত একবছর করোনা নামক মহামারিতে মানুষ কাজ হারিয়ে বিপর্যস্ত।সরকারের পরিকল্পিত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নেই। বিশেষঞ্জদের উপদেশ অগ্রহ্য করে সরকার চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। তার ফলে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে গঙ্গায় মরদেহ ভেসে যাচ্ছে। সারা বিশ্বের প্রথমসারির সংবাদ মাধ্যমে সেই ছবি ছাপা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের নেতৃত্ব কেন্রীয় সরকারের এই উদাসীনতার নিন্দা করছে।কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি বলছেন, ‘’মৃত ভাবমূর্তি উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী ‘নৌটঙ্কি’ করছেন।‘’ গত সাত বছরে মোদী সরকার কর্মসংস্থান গড়ে তুলতে পারেনিদেশের ৩৫ শতাংশ মানুষ কর্মহীন। শুধু এই বছর এপ্রিল মাসে ২০ লক্ষের বেশি লোক কাজ হারিয়েছেন। বেকারত্ব বৃদ্ধির মধ্যেই কেন্দ্র রেলের ১৩,৪৫০টি পদ বিলোপ করল। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েই চলেছে। তথ্য দাবি করছে সর্ষের তেল প্রতি কেজি ৭০ টাকা হতে সময় লেগেছিল ৬৫ বছর।মাত্র সাত বছরে সর্ষের তেল ৭০ টাকা থেকে ১৯০ টাকা হয়েছে। তবু মোদী সরকারের হেলদোল নেই। সরকার নিজেদের ‘আত্মনির্ভর ভারত’-র প্রচার নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে। অভিযোগ উঠে আসছে, কেন্দ্রীয় সরকার করোনা পরিস্থিতিকে তাঁদের কর্পোরেট স্বার্থে জনবিরোধী নীতি রুপায়ন করার  উদ্দেশ্যে কাজে লাগিয়েছে।ভারত কি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের তকমাও হারাতে বসেছে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে?                     

সংযুক্ত কিসান মোর্চার নেতৃত্ব ২৬ মে ‘কালা দিবস’-র দিন দেশের কৃষকদের বার্তা দিয়েছেন, ‘কোম্পানী সরকার’ (পড়ুন কেন্দ্রীয় সরকার)-র বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন চলবে ২০২৪ সালের লোক্সভা নির্বাচন পর্যন্ত। একটি ভার্চুয়াল সাংবাদিক সম্মেলনে সম্প্রতি ভারতীয় কৃষক ইউনিয়ন নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেন, ‘’কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৯ সালে গঠন হয়েছিল একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে। বা ‘এনডিএ’ নামে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের একটি মঞ্চের নেতৃত্বে।কিন্তু সেই সরকার বর্তমানে দেশের কয়েকটি কর্পোরেট সংস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তাই আমরা এই সরকারকে এখন ‘কোম্পানী সরকার’ বলছি। যারা কোম্পানীর স্বার্থে কাজ করছে।‘’ প্রাসঙ্গিকভাবে এসে যায়, সংযুক্ত কিসান মোর্চা এর আগে ঘোষণা করেছিল তাঁদের আন্দোলন চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত চলবে।কেন্দ্রীয় সরকারের চোখে চোখ রেখে অটুট মনোবল নিয়েই তারা আন্দোলনে থাকতে চাইছে। কারণ আন্দোলনরত কৃষক নেতৃত্ব বুঝে গিয়েছেন  কৃষক বিরোধী এই সরকার তাঁদের কথা শুনবে না। তাই নতুন সরকার আসা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে চাইছে।     

২৬ মে ভারতীয় মহিলা সাংবাদিকদের একটি সংস্থা একটি অনলাইন মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছিল। সেই সভায় কৃষক নেতা টিকায়েত তাঁর বক্তব্য রাখেন।টিকায়েত আরও জানান, এ দিন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নতুন করে কৃষকদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয়নি। গত ২১ মে আন্দোলনরত কৃষকমোর্চা নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠির উত্তর প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে এ দিন পর্যন্ত কৃষক নেতৃত্বের কাছে আসেনি। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি কেন্দ্র এবং সংযুক্ত কিসান মোর্চার মধ্যে শেষ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়। কৃষকরা ২৬ মে কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ মেনেই নিজের নিজের গ্রামে ‘কালা দিবস’ পালন করে। পাশাপাশি দিল্লি সীমান্তে তাদের ধর্না যেমন চলছিল তেমনি  চলছে। কৃষকনেতা টিকায়েত অভিযোগ করেন, ‘’কেন্দ্র বলছে কৃষকদের জমায়েত থেকে ‘কোভিড’ সংক্রমণ বাড়ছে। এই বক্তব্য নতুন কিছু নয়। গত ছ’মাস থেকে সরকার এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার প্রথমে চেষ্টা করেছিল আন্দোলন ভেঙ্গে দিতে। প্রচার করা হয়েছিল আমাদের আন্দোলন বৃহৎ চাষী বা ‘বিগ ফার্মার্স’ গোষ্ঠীর আন্দোলন। এই প্রচারে সাফল্য না পেয়ে আমাদের খালিস্তানি আন্দোলনের সমর্থক বলে দেগে দেওয়ার চেষ্টা হল।‘’ তিনি আরও জানান, কৃষক নেতৃত্ব বিশ্বাস করে, সারা দেশে মোদী সরকার বিরোধী যে প্রচার আন্দোলন তারা করেছে, তার প্রভাব পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে পড়েছে।টানা ছ’মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরে মোদী সরকার হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে, কৃষকরা খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাবে না।তাঁদের মনোবল অটুট আছে। কৃষক বিরোধী তিন কৃষি আইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কৃষকরা রাস্তায় থাকবে।

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?