তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ মমতার






 

দীপেন্দু চৌধুরী

গত দু’বছরের তুলনায় এবারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হল অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে। এবছরই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী মমতা শপথ নিলেন রাজভবনের থ্রোন রুমে। চার দেওয়ালের মধ্যে হাতে-গোনা কয়েকজন অতিথির সামনে তিনি শপথ নিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে এই অনুষ্ঠান ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং অনাড়ম্বর তুলনায় ২০১১ এবং ২০১৬ সালের মুখ্যমন্ত্রী মমতার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ছিল অনেক আড়ম্বরপূর্ণ। প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা ২০১১ সালে শপথ নিয়েছিলেন রাজভবনের লনে। ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছিল রেড রোডে জাঁকজমকপূর্ণভাবে।

সরকারি নিয়ম এবং প্রথা মেনে ৫মে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে শপথবাক্য পাঠ করেন মুখ্যমন্ত্রী। পরে সাংবিধানিক কিছু আচার সম্পন্ন করে রাজ্যের তৃতীয়বারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘’আমাদের অগ্রাধিকার কোভিডকে নিয়ন্ত্রণ করা। সব রাজনৈতিক দলের কাছে আবেদন, শান্তি, শৃঙ্খলা, সংহতি, বজায় রাখুন। বাংলা অশান্তি পছন্দ করে না। আমি নিজেও করি নাপ্রত্যেককে বলব, কোথাও যাতে কোনও হিংসার ঘটনা না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা আমার দ্বিতীয় কাজ। নবান্নে ফিরে গিয়ে যেখানে যেখানে যাদের পোস্টিং করতে হবে, সেখানে তা করব। কোনও অশান্তি হলে কঠোর পদক্ষেপ করব।‘’

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে কিছুটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল অভিঞ্জ প্রশাসকের মতো সামলেছেন মমতা। রাজ্যপালের বক্তব্যের পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘’কোনও রাজনৈতিক দল যেখানে যেখানে জিতেছে, সেখানে সেখানে অত্যাচার করছে। এদের কেউ যেন রেহাই না পায়, তা আমরা দেখে নেব। এই তিন মাসের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায় সেটা আমার হাতে ছিল না। ফলে, সেখানে অনেক দুর্বলতা ও অক্ষমতা থাকতে পারে। আজকেই নবান্নে গিয়ে নতুন সেট-আপ তৈরি করব। আবেদন করব, কেউ যেন কারও প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ না হন।‘’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, রাজ্যপালের বক্তব্যের পরে অভিঞ্জ প্রশাসক হিসেবে মমতা যে বক্তব্য রেখেছেন, সেটা অত্যন্ত সুচিন্তিত। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, ভোটের আগে থেকে এবং ভোটের সময় বিজেপির যে আচরণ ছিল, তা স্বাভাবিক পরিস্থিতির পক্ষে অনুকূল ছিল না। ভোট পরবর্তী হিংসার পিছনে বিজেপি যে দায় এড়াতে পারে না, সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করছে, নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যের একাধিক উচ্চপদস্থ অফিসারদের বদলি করে নির্বাচন কমিশন। যেমন ডিজি, এডিজি (আইনশৃঙ্খলা)-সহ একাধিক জেলার পুলিশ সুপার এবং জেলাশাসককে বদলি করা হয়েছিল। রাজ্যের কোনওরকম আপত্তিকে গুরুত্ব দিতে চায়নি নির্বাচন কমিশনের কর্তারা।

রাজনৈতক পর্যবেক্ষকরা জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে মাত্র কয়েকটি বদলির বিষয়ে রাজ্যের পরামর্শ শুনলেও বেশিরভাগ বদলির সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে কমিশনের আধিকারিকরা নিয়েছেন। যে কারণে নির্বাচনী প্রচারে গিয়েও একাধিক বার সরব হতে দেখা গেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আর এই জন্যই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দ্বিতীয়বারের বক্তব্যে আক্ষেপ করে বলেছেন, গত তিন মাস আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কোনও উপায় তাঁর হাতে ছিল না। শুধুমাত্র আক্ষেপ করেই থেমে থাকেননি তিনি। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পরে নবান্নে গিয়েই পুলিশ প্রশাসনের প্রথমসারির অফিসারদের কয়েকজনকে বদল করে আবারও নিজের ‘সেট আপ’ তৈরির বার্তা দিয়ে রাখলেন। প্রশাসনিক ভারসাম্য বজায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী বলে অভিমত রাজ্যের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের

উল্টোদিকে তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা শপথ নেওয়ার দিনেই রাজ্যে ছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় জগৎ প্রকাশ নড্ডা। রাজ্যের ভোট পরবর্তী হিংসা প্রসঙ্গে বিজেপি সভাপতি অভিযোগ করেন, ‘’রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ‘ভয়ানক হিংসা’ চলছে। এ সব ঘটনা দেশভাগের সময়ের ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’র কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে।‘’ জে পি নড্ডার আক্রমণের জবাবে তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায় বলেন, ‘’ওদের কাজ ইতিহাস বিকৃত করা। ইতিহাস পড়ার অভ্যাস ওদের নেই। তাই দেশভাগের কথা তুলছেন। যাদের হাতে গুজরাত ও দিল্লির দাঙ্গার রক্ত লেগে আছে তাঁদের মুখে এ সব কথা কেউ শুনবে?’’ সুখেন্দুবাবুর আরও অভিযোগ, ‘’গত দু’বছর ধরে ওঁরা হিংসা ও সন্ত্রাসের যে বাতাবরণ তৈরি করেছিলেন, তা প্রত্যখ্যান করে বাংলার মানুষ রায় দিয়েছেন। এখন তাকে কালিমালিপ্ত করতে চাইছেন। ওঁদের রাজনীতি বিভাজনের। এ সব কথা বলে এখনও সেই চেষ্টাই ওঁরা চালিয়ে যেতে চাইছেন।‘’ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিজেপি সভাপতি এই সময় দেশভাগের প্রসঙ্গ তুলে ‘বিভাজন’ রাজনীতির প্রসঙ্গকেই টেনে আনতে চেয়েছেন। যে ঘটনার সঙ্গে বর্তমান সময়ের কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই।  

বিজেপির বিরুদ্ধে কিছু ভুয়ো (ফেক) ভিডিও প্রচার করে সাপ্রদায়িক মেরুকরণ করার প্রচেষ্টার অভিযোগও উঠেছে। এদিকে মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার এক প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য। এই ঘটনা অভুতপূর্ব। উল্টোদিকে দিল্লি দাঙ্গার অপরাধীরা এক বছর হয়ে গেল প্রকাশ্যে মুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

নির্বাচন পরবর্তী হিংসা নিয়ে সংযুক্ত মোর্চা ও নকশালপন্থী দলের বিবৃতি  

সংযুক্ত মোর্চার বিবৃতি

রাজ্যে নির্বাচন পরবর্তী হিংসা নিয়ে ৩ মে সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে বিমান বসু এক বিবৃতিতে বলেছেন, ২মে নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের সময় থেকে তৃণমূল কংগ্রেস পুনরায় নতুন করে সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ শুরু করেছে। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে এই নৃশংস আক্রমণে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বর্ধমানের জামালপুরে তৃণমূলী সন্ত্রাস প্রতিহত করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন সিপিএমের কর্মী কাকলী ক্ষেত্রপাল। উত্তর ২৪ পরগণার দত্তপুকুরে তৃণমূলের আক্রমণে নিহত হয়েছে এক আইএসএফ কর্মী। উত্তর ২৪ পরগণার মধ্যমগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে কেনিয়া খামারপাড়ায় প্রায় ১০টি বাড়ি তৃণমূল দুষ্কৃতিরা ভাঙচুর করেছে। সেই ঘটনায় ৫১ জন ঘরছাড়া হয়েছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগণায় ক্যানিং-পূর্ব বিধানভার মৌলী মুকুন্দপুর গ্রামে সশস্ত্র তৃণমল দুষ্কৃতীদের হামলায় মোট তিনজন গুরুতর আহত হয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূল-বিজেপির বিরোধ ও সংঘর্ষ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করছে বলে আমরা মনে করি।

বিমানবাবু দাবি করেন, রাজ্যের সর্বত্র নতুন করে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্য তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি তৎপর হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, আমরা এই নৃশংস হত্যাকান্ড, হামলা, ও সাম্প্রদায়িক বিরোধে ইন্ধন দেওয়ার ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি এবং অবিলম্বে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। এইসব সন্ত্রাসমূলক ও সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে এবং সর্বত্র শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষা করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবিলম্বে শান্তি-শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠায় তৎপরতা এবং দৃঢ়হস্তে দুষ্কৃতীদের দমন করার দাবি জানাচ্ছি।

সিপিআই (এম এল) লিবারেশনের বিবৃতি

সিপিআই (এম এল) লিবারেশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে কার্তিক পাল এক বিবৃতিতে জানাচ্ছেন, আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, নির্বাচনী ফলাফল বেরনোর পর রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিজয়ী দল বিশেষ করে তৃণমূলের সমর্থকরা বিরোধী দল ও জনগণের যে অংশ তাদের ভোট দেয়নি, তাদের উপর হামলা নামিয়ে এনেছে। পশ্চিমবাংলার গণতান্ত্রিক জনমত বিজেপির আগ্রাসনকে রুখে দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রায় এই নির্বাচনের মাধ্যমে দিয়েছে। এই ধরনের ঘটনাগুলো সেই জনাদেশের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়ে গোটা পরিমণ্ডলকেই কলুষিত করবে। আমরা এই প্রতিহিংসাপরায়ণ ঘটনাগুলোর তীব্র নিন্দা করছি। তিনি আরও বলেন, আমরা নব নির্বাচিত রাজ্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে এই হিংসাত্বক ঘটনাগুলো বন্ধ করতে হবে। সেই অনুযায়ী শাসকদল ও রাজ্য প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমরা আবেদন জানাচ্ছি।

সরকার চলুক সন্ত্রাস নয়। শান্তি চাই দাঙ্গা নয়। লড়াই হোক করোনার বিরুদ্ধে প্রভৃতি স্লোগানকে সামনে রেখে ৫ মার্চ ধর্মতলা লেনিন মূর্তির পাশে নাগরিক প্রতিবাদী অবস্থান করে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সহ বিভিন্ন নাগরিক উদ্যোগ ও গণসংগঠন। লিবারেশন দলের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য নিজে এই প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন।                                             

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?