পরম্পরাগত আর্থসামাজিক নীতির কথা ভাবতে চাইছে কংগ্রেস
দীপেন্দু চৌধুরী
দেশের আর্থরাজনৈতিক তথা আর্থসামাজিক সমাজব্যবস্থা গত কয়েক বছরে এক বিতর্কিত
বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে। যেটা সহিষ্ণু সমাজের কাছে অত্যন্ত ঝুঁকিরও বলা যায়।
স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ৭০ বছর ধরে গড়ে ওঠা ভারতীয় সভ্যতার চিরায়ত সংস্কৃতি এবং
শক্ত-অটুট সামাজিক বন্ধনটা কেমন যেন নড়বড়ে দেখাচ্ছে। ভারত আজ এক চ্যালেঞ্জের সামনে
দাঁড়িয়ে আছে। অসহিষ্ণুতা, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতার বীজ, বিভাজন সংস্কৃতি, মানবতার
প্রতি অবিচার এবং ঘৃণার রাজনীতি, সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুপরিকল্পিতভাবে
বহুদলীয় ব্যবস্থা ভেঙে এক দল, এক ভাষা, এক রাষ্ট্রের মতাদর্শের প্রচার চলছে। আমরা
ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সচেতন নাগরিক এই সংকীর্ণ দর্শনকে কি মেনে নেব? না বিপড়িত দিকে দাঁড়িয়ে
ভারতীয় চিরায়ত সংস্কৃতি, উদার গণতন্ত্রের পক্ষে জনমত গড়ে তুলব? বহু বিতর্কিত হিন্দুত্ববাদী এই আদর্শের বিপড়িতে আছে কংগ্রেস
ঘরানার পরম্পরাগত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি এবং বহুস্বরের সংস্কৃতি। বহুদলীয় ব্যবস্থার
অনুমোদিত স্বীকৃতি। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের বার্তা ছিল সনাতন ভারতের এক আকাশ
অহংকার। ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর দিল্লির আইজিআই স্টেডিয়ামে তাঁর মূল্যবান বক্তব্যে
সনিয়া গাঁধি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘’Some individuals attempt to infect our nation
and its people with a sense of intolerance, prejudice, injustice, communalism,
hatred and bigotry.’’ তাই শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস দল যতই ছোট হয়ে
আসুক আজও করোনা সঙ্কটের সময়েও কংগ্রেসের দায়িত্ব অপরিসীম। করোনা উত্তর আর্থসামাজিক
ভারতের দায়িত্ব ধর্মনিরপেক্ষ, উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসকেই
নিতে হবে। কংগ্রেসের কাছে চ্যালেঞ্জটা এসেছে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের প্রচার করা
দল বিজেপির দিক থেকে।
কংগ্রেস সরকারের গড়ে তোলা একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার গঙ্গাযাত্রা করে
মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ভাবছিল তাঁরা অপারেজয়। ৭০ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা ওই
সংস্থাগুলি কেমন ছিল? একবার দেখে নেওয়া যাক। ১৯৫১ সালে পাবলিক এন্টারপ্রাইজ নামে
পরিচিত সংস্থা ভারতে ছিল মাত্র ৫টি। সেই বছরে পুঁজি নিয়োগ করা হয়েছিল ২৯ কোটি
টাকা। আশির দশকের শেষে এই সব সংস্থার সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ২৪৪টি। পুঁজি বিনিয়োগ করা
হয়েছিল ৯৯, ৩২৯ কোটি টাকা। বর্তমান সময়ের সঙ্গে তুলনা করার জন্য আগ্রহী পাঠকদের
অনুরোধ করব। কল্যাণকামী অর্থনীতির সঙ্গেও আমরা তুলনায় যেতে পারি। অর্থনীতিতে
রাষ্ট্রের কী ভূমিকা থাকবে সে বিষয়ে আজও প্রাঞ্জ অর্থনীতিবিদরা আলোচনা করছেন।
কিন্তু সমাজে অসহিষ্ণুতার বার্তা গেলে পুঁজি থমকে যায়। এবং পুঁজিপতিরা বিনিয়োগ
করতে চায় না সে কথা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা
অর্থনীতিবিদ ডঃ মনমোহন সিংহ। ২০১৫ সালে জওহরলাল নেহরুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে
আয়োজিত সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘’অর্থনৈতিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশের পূর্বশর্তই হল
শান্তির পরিবেশ কায়েম রাখা। বিরোধী স্বরকে জায়গা করে দেওয়া। কিন্তু যে ভাবে বিরোধী
মতের কন্ঠরোধ করা হচ্ছে তাতে মার খেতে পারে অর্থনীতি।‘’
অতিমারির ক্ষেত্রেও মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার এতটাই ব্যর্থ যে শিবসেনা
ভারতে কংগ্রেস দল এবং নেহরু-গাঁধি পরিবারের ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। করোনার
টিকা সার্বজনীন না করে মোদী সরকারের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, ১৮-৪৫ বছর বয়সের ভারতীয়
নাগরিক গাঁটের কড়ি খরচ করে টিকা নেবে। প্রশ্ন উঠছে কেন? ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’ নামক
প্রকল্পে মোদী সরকার ২০ হাজার কোটি খরচ করতে পারলে বিনামূল্যে সব নাগরিককে করোনার
টিকা দেওয়া সম্ভব নয় কেন? ভারতে গুটি
বসন্ত (স্মল পক্স), কলেরা, যক্ষ্মার টিকা, বিসিজি (৬ মাস বয়সের শিশু থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত দেওয়া হয়) টিকা
কংগ্রেস সরকারের আমল থেকে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। যে কথা মনে করিয়ে দিয়ে শিবসেনা
দলীয় মুখপত্র সামনাতে লিখেছে, ‘’The world is now scared of what is happening in India. Most countries
have banned travel and business engagements with India. This is hurting India
financially. Still India is thriving because of projects undertaken by Jawaharlal
Nehru, Lal Bahadur Shastri, Indira Gandhi, Rajiv Gandhi, P. V. Narshima Rao and
Monmohan Sing. This is a blessing. Prime Minister Narendra Modi will have to
work hard and shed political nationalism to sustain the country. It is not good
for India to become a global concern’’. বিজেপি এবং
দলের প্রধানমন্ত্রী মোদীর অহংকার এবং করোনা চিকিৎসায় সরকারের ব্যর্থতা বিশ্ববাসীর
কাছে অত্যন্ত লজ্জার বলে মনে হতে পারে। প্রতিবেশি ছোট দেশগুলি সাহায্যের হাত
বাড়িয়ে দেওয়া থেকেই আমাদের এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষত অক্সিজেন
কান্ডের পরে এমনটা মনে হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
সম্প্রীতি পাঁচটা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সরকার গঠন করতে না
পারলেও বিজেপি নামক দলটিও পরাজয়ের মুখ দেখতে শুরু করেছে। ‘বঙ্গাল’ দখল সম্ভব হয়নি। তামিলনাড়ুতেও ব্যর্থ। কেরলে বিজেপি
খাতাই খুলতে পারেনি। পরের দুঃসংবাদে বিজেপির কয়েকজন প্রবীণ নেতৃত্ব আঙুল তুলছেন
মোদীর দিকে। দুঃসংবাদটি হচ্ছে, যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত
নির্বাচনে বিজেপির সামগ্রিক স্থান দুই নম্বরে। ভারতীয় গণতন্ত্র যে কতটা শক্তিশালী
সেই উদাহারণ আবারও সারা বিশ্ব পরখ করল। আরও একটা বিষয় অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এবং
অবশ্যই উল্লেখযোগ্য, উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা বিধানসভা কেন্দ্রের রুদৌলি তহসিলের
অন্তর্গত রাজনপুর গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রাম প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন
ইসলামি ধর্মগুরু হাফিজ আজিমউদ্দিন। গ্রামবাসীরা বলেছেন, ধর্ম নয় সম্প্রীতির কথা
মাথায় রেখেই ভোট দিয়েছেন তাঁরা।
কংগ্রেস নামক দলকে একুশ শতাব্দীর মানদণ্ডে সংগঠনকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে
হবে, পরাম্পরাগত আর্থসামাজিক নীতির কথা মাথায় রেখে। কংগ্রেস সূত্রে খবর, সেই
প্রস্তুতি দলের প্রবীণ এবং নবীন গোষ্ঠীর সম্মিলিত টিম শুরু করে দিয়েছে।
সম্প্রতি এই বিষয়গুলিকে মাথায় রেখে ১০ মে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক
বসে। এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, জাতীয় কংগ্রেসের ৭২তম রাষ্ট্রীয় সভাপতি নির্বাচন
২৩ জুন হবে। সারা দেশে কংগ্রেসকে নতুন করে গড়ে তুলতে এক গুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়
ওই দিনের বৈঠকে। ১৩৬ বছরের একটি দল হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস দলকে ঢেলে সাজানোর
বিষয়ে নতুন করে আলোচনা করা হয়। ১০ মের বৈঠকে যুব সম্প্রদায়কে সামনের সারিতে নিয়ে
আসার নির্দেশ দিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধি। বিশেষ সূত্রের খবর, কংগ্রেস
এই প্রথম ‘এক ব্যক্তি এক পদ নীতি’ শুরু করতে চলেছে। কংগ্রেসের অন্দরের খবর, নেহরু-গাঁধি
পরিবার থেকে আগ্রহী নন কেউ। এমতবস্থায় বরিষ্ঠ নেতাদের তালিকায় নাম উঠে আসছে
দু’জনের। প্রথমজন প্রবীণ এবং অভিঞ্জ নেতা মল্লিকার্জুন খার্গে এবং দ্বিতীয়জন তরুণ
নেতা সচিন পাইলট। অবশ্য ইতিমধ্যে ১৭ টি রাজ্য থেকে দ্বিতীয়বারের জন্য রাহুল
গাঁধিকে সভাপতি করার জন্য আওয়াজ তোলা হয়েছে। পাশাপাশি ১২ টি রাজ্যের কংগ্রেস
নেতারা চাইছেন, গাঁধি পরিবারের বাইরে থেকে কংগ্রেস সভাপতি পদের জন্য মনোনয়নপত্র
জমা দেওয়া হোক। তবে আরও যেটা জানা যাচ্ছে শচীন পাইলট এবং মল্লিকার্জুন খার্গে
রাহুল গাঁধিকে সভাপতি করার কথা সোচ্চারে বলেছেন। কংগ্রেস দলের রক্তক্ষরণ শুরু
হয়েছিল দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমল থেকেই। প্রত্যেকবারই দক্ষ ও অভিঞ্জ নেতার মতো
দলকে সামলেছেন সনিয়া গাঁধি। ধর্মনিরপেক্ষ আঞ্চলিক দল এবং বামপন্থীদের একসঙ্গে নিয়ে
চলার রাস্তাও তিনি দেখিয়েছেন। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পরেই কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব
দুটি কমিটি গঠন করেছে। একটি বিধানসভা নির্বাচনে হারের কারণ খতিয়ে দেখবে। দিতীয়টি
কোভিড-১৯ ত্রাণের কাজকর্ম দেখবেন। বিক্ষুব্ধ জি-২৩ গোষ্ঠীর সদস্যদের কমিটিতে রেখে
সনিয়া সহ শীর্ষ নেতৃত্ব বার্তা দিয়ে রাখলেন কংগ্রেস প্রবীণ এবং তরুণের সম্মিলিত
প্রয়াসে আগ্রহী।
Comments
Post a Comment