নির্ভীক সাংবাদিকদের জন্য ভারত নিরাপদ দেশ নয়



 

দীপেন্দু চৌধুরী

‘গোদী মিডিয়া’ শব্দ বন্ধের সঙ্গে আমাদের বাংলা সহ সারা দেশ বর্তমান সময়ে পরিচিত। ভারতে প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক, এডিটর, সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। এমন যন্ত্রণাদায়ক অভিযোগ কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। একটি সংবাদমাধ্যমের পরিচালকমণ্ডলী বা মালিকপক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বিঞ্জাপন সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে অনৈতিকভাবে তাদের সহযোগিতা করছে। ইউপিএ সরকারের আমলে ২০১২ সাল থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অতি ধীর লয়ে। ২০১৯ সালের পর এক শ্রেণির সাংবাদিকদের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ প্রকটভাবে নজরে পড়ছে। সাংবাদিক মানে সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব মানুষের পাশে থাকবে। তাদের সম্মান, মর্যাদার পক্ষে কথা বলবে। মানবতার জন্য লড়াই করবে। এটাই হচ্ছে সাংবাদিকদের এথিক্স। ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থস্তম্ভের দায়বদ্ধতা। কিন্তু চিরায়ত এই সত্যকে অস্বীকার করে, মানবতার সঙ্গে সমঝোতা করে মোটা অর্থের লোভে একজন সাংবাদিক তথা একটি সংবাদ মাধ্যমের পুরো পরিচালকমণ্ডলী বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।

আলোচ্য বিষয়ের সত্যতা সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোরটেও প্রকাশ হয়েছে। ২০২১ সালে এডেলম্যান ট্রাস্ট (Edelman Trust) নামে একটি সংস্থা অনুসন্ধান করে জানিয়েছে, ভারত সহ ২৮ টি দেশের ৫৯ শতাংশ মানুষ সাংবাদিকদের উপর বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের বক্তব্য সাংবাদিকরা ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের নাগরিকদের বিভ্রান্ত বা ‘মিস লিড’ করছে। যে নাগরিকরা দেশের জন্য কর দিয়ে থাকে তাদের যেমন এই সব সাংবাদিকরা ঠকাচ্ছে। পাশাপাশি গরিব মানুষ, শিশু, নারীদের প্রতি অবিচার করে তাদেরও বিভ্রান্ত করছে। উল্লেখিত পরিবারগুলির অভিভাবকরা সংবাদ মাধ্যমের উপর আস্থা রাখতে আগ্রহী নয়। এডেলম্যান ট্রাস্ট ২৮টি দেশের যে সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে উল্লেখিত দেশের মানুষ সমীক্ষায় জানিয়েছে, পেড সাংবাদিকরা নিজেরাও জানে তাঁরা যে খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করছে সেটা সত্যের পক্ষে দাঁড়াবে না। ইংরেজি ভাষায়, ‘জার্নালিস্টস ডেলিবারেটলি ট্রাই টু মিসলিড দ্য পাবলিক বাই রিপোর্টিং ইনফরমেশন দে নো টু বি ফলস।’ 

একটি সংস্থার রিপোর্ট উল্লেখ করে আমরা যেমন এক শ্রেণির ভীরু, লোভী, অসৎ এবং হ্যা, অবশ্যই সরকারের কাছে আত্মসমর্পণকারী সাংবাদিকদের কথা বললাম। আবার সত্যেরও একটা দাবি থেকে থাকে। যে দাবিকে অস্বীকার করলে আমি বা আমরা ভারতের চতুর্থস্তম্ভের মানবিক শাখার বিশ্বাসযোগ্য সদস্য হিসেবে নিজেদের পৌঁছে দিতে পারব না। আমাদের হাতে আরও একটা সমীক্ষা রিপোর্ট এসেছে। যে রিপোর্টে বলা হয়েছে। ভারত নামক বর্তমান দেশটি সাহসী, নির্ভীক, সৎ সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ দেশ নয়। ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম’ তালিকায় ভারত এখনও ১৪২ নম্বরে আছে। এই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ভারত হচ্ছে বিশ্বের সাংবাদিকদের জন্য সর্বাধিক ভয়ের দেশগুলির মধ্যে একটি। ‘’ওয়ান অব দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ডেঞ্জারাস কান্ট্রিস’’ ফর জারনালিস্ট 

রিপোর্ট থেকে আরও যেটা জানা যাচ্ছে, ভারতে বর্তমান আর্থসামাজিক ও আর্থরাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলেছে বিজেপির এক শ্রেণির কর্মী সমর্থকরা। সাংবাদিকরা কেন্দ্রের এবং রাজ্যের বিজেপি শাসিত সরকারের সমালোচনা করলে তাদের ‘রাষ্ট্র বিরোধী’ (anti-state) বা ‘দেশদ্রোহী’ (anti-national) হিসেবে দেগে দেওয়া হয়। তাদের শাস্তি দেওয়ার অধিকার নিচ্ছে বিজেপির ওই নেতা, কর্মীরা। একই দাবি করেছে রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) নামে একটি পৃথক অলাভজনক সংস্থা। এই সংস্থাও তাদের সাম্প্রতিক ব্যাখ্যায় বলেছে, ভারতের নির্ভীক, সৎ, প্রতিবাদী সাংবাদিকদের পক্ষে নিজেদের দেশে দায়িত্ব নিয়ে সাংবাদিকতার কাজ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ২০ এপ্রিল ১৮০টি দেশের যে তালিকা প্রকাশ হয়েছে নরওয়ে সেই তালিকায় এখনও শীর্ষে আছে। সাংবাদিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রিক অধিকারকে সম্মানের সঙ্গে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে। সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক এবং সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের কাজ করার জন্য নিরাপদ দেশ হিসেবে। একই অধিকার নিয়ে এর পরেই আছে ফিনল্যান্ড এবং ডেনমার্কচিনের র‍্যাঙ্ক ১৭৭, উত্তর কোরিয়া ১৭৯। ভারত সেখানে আছে ১৪২ নম্বরে। গত বছরও ওই একই স্থানে ছিল ভারতের অবস্থান। ২০১৬ সালে ভারত ছিল ১৩৩ নম্বরে। গত পাঁচ বছরে আমাদের দেশের সরকার সাংবাদিকদের জন্য আর্থসামাজিক নিরাপত্তা দিতে আরও ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ভারতের র‍্যঙ্ক ১৪২ নম্বরে উঠে এসেছে। রিপোর্ট থেকে এটাও জানা যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশি দেশ নেপাল ১০৬ নম্বরে আছে। শ্রীলঙ্কা ১২৭ নম্বরে, মায়ানমার (সেনা অভ্যুত্থানের আগে) ১৪০ পাকিস্তান ১৪৫ এবং বাংলাদেশ ১৫২ নম্বরে থেকে প্রমাণ করছে, ওই দেশগুলি ভারতের থেকে সাংবাদিকদের জন্য বেশি নিরাপদ।

২০ এপ্রিল প্রকাশিত রিপোর্টে আরও দাবি করা হয়েছে, ব্রাজিল, মেক্সিকো এবং রাশিয়ার থেকেও খারাপ অবস্থা ভারতের সাংবাদিকদের। তাদের পক্ষে বিজেপি শাসিত সরকারের সমালোচনা করা মানেই জীবনের ঝুঁকি। ২০২০ সালে চারজন ভারতীয় সাংবাদিকের দুষ্কৃতিদের হাতে খুন হওয়ার অভিযোগও উঠে এসেছে রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডার-র সমীক্ষায়। রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংবাদমাধ্যমকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।

ভারতের এইসব সাহসী সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, পুলিশের হয়রানি সহ্য করে, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যুঝেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে খবর করেন তাঁরা। সাহসী, সমঝোতা না করা সাংবাদিকদের উপর স্থানীয় সংগঠিত   সমাজবিরোধী আক্রমণ আকছার হয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত হাতে না মারতে পারলে ভাতে মারার ব্যবস্থা করে সরকারে আসীন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব। সমীক্ষা রিপোর্ট সুনির্দিষ্টভাবে বলেছে, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আসার পর থেকে সংবাদ মাধ্যমের উপর ক্রমাগত চাপ আসতে থাকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী লাইন মেনে খবর করার জন্য। যে সব সাংবাদিক এই নির্দেশিকা মানতে অস্বীকার করে, সরকারের তথাকথিত নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার যারা তাঁদেরকে সামাজিক মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়। তাঁদের সম্পর্কে হেট ক্যাম্পেন সুসংগঠিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে সামাজিক বয়কটও চলে। এই ব্যবস্থার পরে একজন সৎ-সাহসী সাংবাদিক সাহসী কলম বন্ধ না করলে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর সদস্যদের দ্বারা সেই সাংবাদিক খুন পর্যন্ত হতে পারে। বিশেষত মহিলা সাংবাদিকদের অনেক বেশি হিংসার শিকার হতে হচ্ছে আমাদের দেশে নীতিচ্যুত হতে রাজি নয় এমন প্রতিবাদী সাংবাদিককে আইনি হয়রানিও সহ্য করতে হয়। ‘দেশদ্রোহী’ আইনে তাঁকে আটক করে গ্রেপ্তার করাও হতে পারে বলে এই সমীক্ষা রিপোর্ট জানাচ্ছে।

কাশ্মীরের সাংবাদিকদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা না করলে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষিত জওয়ানদের অত্যাচার সহ্য করতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরা সাংবাদিকদের। কাশ্মীরের প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের নিউজ কন্টেন্ট সরকার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এই বিষয়টাও রিপোর্টে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। কেন্দ্র শাসিত কাশ্মীর সরকারের সঙ্গে সংবাদমাধ্যম সহযোগিতা না করলে সেই সংবাদমাধ্যমের স্থানীয় অফিস বন্ধ করে দিতে পারে সরকার।

২০২০ সালে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস নিয়ে খবর করার ক্ষেত্রেও কেন্দ্র সব রকমের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে,  সর্বভারতীয় প্রথমসারির সংবাদ মাধ্যমগুলির উপর। সরকার নিয়ন্ত্রিত অর্থাৎ ‘গোদী মিডিয়া’ প্রচার করে থাকে যে সব সাংবাদিক বিজেপি শাসিত সরকারের সমালোচনা করে সাংবাদিকতা করবে তাদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। অথবা সন্ত্রাসবাদীদের পক্ষের লোক বলেও দেগে দেওয়া হতে পারে। রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারের সাম্প্রতিক রিপোর্ট থেকে এই বিষয়টিও পরিষ্কার জানা যাচ্ছে। বিশেষত যে সব সাংবাদিক মাঠে ময়দানে রোদ, বৃষ্টিতে ভিজে, তুষার ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে সাংবাদিকতার কাজ করেন তাদের শারীরিকভাবে নিগ্রহ করার ঘটনাও আকছার ঘটে থাকে।

রিপোর্ট উল্লেখ করছে ভারতীয় উপ-মহাসাগরীয় অঞ্চলে অনেক দেশই সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নতুন দমন পীড়নের আইন এনেছে। রাষ্ট্রের গোপনীয়তা এবং  ‘জাতীয় নিরাপত্তা’-র ঘেরাটোপে এই আইন কার্যকর করা হচ্ছে ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। এক শ্রেণির সাংবাদিক অনেক সময় বাধ্য হয়েই সরকারের হয়ে কাজ করছে। নিজের চাকরি বাঁচিয়ে রাখতে। জীবন জীবিকা চালাতে। মানবিকতার কথা ভুলে মেনস্ট্রীম মিডিয়া সরকারের কাছে নিজেদের বিক্রি করে দিলেও আমরা বিশ্বাস রাখি সৎ, নির্ভীক, প্রতিবাদী সাহসী সাংবাদিকরা আজও আছেন। স্বার্থান্বেষী সমাজে যারা ‘দিন দর্পণ’ হয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন। তারাই আজও আশাবাদ, সাংবাদিক আদর্শকে টিকিয়ে রেখেছেন।                                                                              

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?