গণতন্ত্রের শৃঙ্খল ভেঙে এ কেমন নির্বাচন!





 

দীপেন্দু চৌধুরী

দিন কয়েক আগে বাজার করতে গিয়েছিলাম। সবজিওয়ালা বলল, কাকু শনিবার আমাদের ব্যবসা হবেনি। আমরা বসবনি। বুঝলাম ১০ এপ্রিল আমাদের অঞ্চলে ভোট আছে। জানতে চাইলাম, ভোট চলবে সারাদিন। বাজার বসতে অসুবিধা কোথায়? পাশের আর একজন সবজি বিক্রেতা উত্তর দিল, কাকু আমাদের কেন অসুবিধা হবে? ওই যে ভিন রাজ্যের পুলিশ এয়েছে। উয়ারা বাংলা কিচ্ছু বুঝে না। তাই বাজার কমিটির লোক এসে বলি গেল বাজারে মাল নিয়ে না বসায় ভালো।  হর হর মহাদেব.........। মুখ ঘুরিয়ে দেখি দু’জন গাজন সন্ন্যাসী পাশে দাঁড়িয়ে। ছাইভুসি মেখে শিবের বেশে তাঁরা ঘুরছে। হাতে চড়কের লাঠি। অন্যান্য বছর দু’চারজনকে গাজন উৎসবের আগে আমাদের অঞ্চলে দেখা যায়। কিন্তু এই বছর চড়ক উৎসবের আগে ১৪ দিন যাবৎ এদের দেখা যাচ্ছে। এই বছর সংখ্যায় অনেক বেশি।  

‘’............ঢাকীরা ঢাকের টোয়েতে চামর, পাখির পালক, ঘণ্টা ও ঘুঙুর বেঁধে পাড়ায় ঢাক বাজিয়ে সন্ন্যাসী সংগ্রহ কচ্চে; গুরু মশায়ের পাঠশালা বন্দ হয়ে গিয়েচে- ছেলেরা গাজনতলাই বাড়ি করে তুলেচে; আহার নাই; নিদ্রা নাই; ঢাকের পেচোনে পেচোনে চামর ছিঁড়ছে, কখন ঢাকের পেছনটা দুম দুম করে বাজাচ্চে- বাপ মা শশব্যস্ত, একটি না ব্যায়রাম কল্লে হয়।‘’ হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ, পৃষ্ঠা- ১০,  প্রকাশক-নতুন সাহিত্য ভবন।

এক বছরের বেশি করোনাকালে স্কুল কলেজ মায় সরকারি বেসরকারি সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি খোলা ছিল। মেধা চর্চার অখন্ড অবকাশ পাওয়া গেছে। এ পাশ ও পাশ করে বাংলার সংস্কৃতি ভেঙে খান খান হয়ে গেল। জাতপাত-ধর্ম জাঁকিয়ে বসতে চাইছে, সংস্কৃতির পীঠস্থান, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী ভাষা জানা, চাকরি না পাওয়া এই বাংলার তরুণ প্রজন্মের মগজে।             

সেদিন বাজার করতে গিয়ে সবজিওয়ালা, মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে যে কথা শুনলাম। তারপর আমি আরও অনেকের মতো কার্য-কারণ খুঁজতে চাইনি। রাজ্যের সপ্তদশ বিধানসভা  নির্বাচনের আগে হঠাত করে  বুঝতে পারছি পশ্চিমবঙ্গের মত একটি ধর্মনিরপেক্ষ, বাম ঐতিহ্যমণ্ডিত রাজ্য ধীরে ধীরে ধর্মীয় মেরুকরণকে আঁকরে ধরতে চাইছে। জাতপাত, ধর্ম নিয়ে আম বাঙালি মাতলেও ভোট রাজনীতির ময়দানে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে বাংলায় এর আগে এত রমরমা দেখা যায়নি।     

রাজ্যের ভোটে হিংসা যে ভাবে বাড়ছে তার থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের রাজ্যেও চিরায়ত সহনশীল সংস্কৃতির বাতাবরণ হোঁচট খেয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ করছে, হাওড়ার শ্যামপুরে, জগৎবল্লভপুরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তাদের বুথ ক্যাম্প ভেঙে দিয়েছে বিজেপির নেতা, কর্মী-সমর্থকরা। আমতায় তৃণমূলের এজেন্টকে বুথে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বিজেপি অভিযোগ করেছে, উলুবেড়িয়া উত্তরের চন্দ্রপুরে তৃণমূল একতরফাভাবে যখন ভোট করছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সেই সময় দেখা যায়নি।

‘ভোট সন্ত্রাস’-র এই দুটি ঘটনা আমরা তুলে নিয়েছি ৬ এপ্রিলের ভোটের দিনের উদাহারণ হিসেবে। প্রায় প্রত্যেকেই বলবে ‘ভোট রাজনীতি’-র ময়দানে এই উদাহারণ অত্যন্ত সাধারণ মাপের অভিযোগ ভোট হবে অথচ বুথ দখল হবে না? এই ধরণের নিরামিষ অভিযোগ পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে বিধানসভা এবং লোকসভা ভোটের সময় যুযুধান দুই দলের মধ্যে বিস্তর হয়ে থাকে। বামফ্রন্ট আমলেও হয়েছে। কিন্তু রাজ্যের সপ্তদশ বিধানসভার নির্বাচনের তৃতীয় দফার ভোটে বহু আলোচিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতেই দু’ই মহিলা প্রার্থীকে আক্রমণ করা হল! একজন তৃণমূল কংগ্রেসের মহিলা প্রার্থী, দ্বিতীয়জন বিজেপি নামক সর্বভারতীয় কর্পোরেট ঘরানার পার্টির সেলিব্রেটি প্রার্থী। অথচ কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, এই রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ হবে মেয়েদের ভোটে। ৬ ফেব্রুয়ারি ভোটের দিন নিরাপত্তায় থাকা রাজ্যের পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা কথা বলা পুতুলের ভূমিকায় অভিনয় করল? প্রশ্ন উঠছে নির্বাচন কমিশন নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হল কেন? তিন দফা ভোটের পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, আয়োজনে যতটা নিরাপত্তার ‘ঘেরাটোপ’-র কথা কমিশন বলেছিল সেটা আসলে ফস্কা গেঁড়ো ছিল?    

২৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণার সময় সাংবাদিক বৈঠকে করে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল আরোরা জানান, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার কথা মাথায় রেখে আট দফায় ভোট করা হচ্ছে। গত নির্বাচনের থেকেও এক দফা বেশি। কমিশনের পর্যবেক্ষণ ছিল, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার ইতিহাস আছে। এই বছরে ভোটের কয়েক মাস আগে থেকে সারা রাজ্যে বিক্ষিপ্তভাবে আইন শৃঙ্খলার অবনতি পরিলক্ষিত হয়েছে। পুলিশের রেকর্ড থেকে কমিশন এই তথ্য পেয়েছে। সেই জন্য আট দফায় ভোট। এই কথা মাথায় রেখে কমিশন আট ঘাট বেঁধে রাজ্যের ভোট করতে নেমেছে। যেমন জম্মুকাশ্মীরে মোতায়েন নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যার থেকেও পশ্চিমবঙ্গের ভোটে আধাসামরিক বাহিনীর সংখ্যা বেশি। ৬ এপ্রিল তৃতীয় দফা ভোটের দিন ৬৩১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) দফতর সূত্রের খবর, ১৭৫ কোম্পানি অতিরিক্ত বাহিনী ব্যবহার করা হবে ১০ এপ্রিল চতুর্থ দফা নির্বাচনের দিন । আগের দফা থেকে ১৭৫ কোম্পানি বেশি বাহিনী মোতায়েন করা হবে। রাজ্যে এখন ১০০০ কোম্পানি বাহিনী রয়েছে। ভোট চলাকালীন পরবর্তী কয়েক দফার জন্য আরও ৬৮ কোম্পানি বাহিনী আসার কথা আছে। জানতে ইচ্ছে করছে এর পরে কি কোথাও গণ্ডগোল হবে না? ‘ভোট সন্ত্রাস’ হবে না? কোনও মানুষের মৃত্যু হবে না? এমন আশ্বাস কি নির্বাচন কমিশন দিতে পারবে?

নির্বাচন বিশেষঞ্জদের অভিমত, আধাসামরিক বাহিনী যেমন আঞ্চলিক ভাষা জানে না ঠিক তেমনি তাঁরা যে অঞ্চলে ভোট হয় সেই অঞ্চলের আর্থসামাজিক বিষয়ে কিছু জানেন না। তাদের নির্ভর করতে হয় রাজ্যের পুলিশ কতৃপক্ষের উপর। এই অভিমতকে মান্যতা দিলে ‘ভোট সন্ত্রাস’ বা ভোটের দিনের রক্তাক্ত অশান্তি কার উপর বর্তায়? কেন্দ্র-রাজ্য পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকবে আর সাধারণ মানুষের মৃত্যু হবে! এর মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।   আমরা সব কিছু মেনে নিয়ে চুপ করে বসে থাকব? একজন পর্যবেক্ষক ছাড়াও দু’জন পুলিশ পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছে কমিশন। কোথাও গণ্ডগোলের খবর পেলেই তাদের মধ্যে একজন পৌঁছে যাবেন। সে জন্য দু’টি হেলিকপ্টার থাকার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত তিন দফা ভোট হয়ে যাওয়ার পরেও দু’জন পর্যবেক্ষকের ভূমিকা কি?

নির্বাচনের দিনগুলিতে মৃত্যু এবং বিক্ষিপ্ত হিংসার ঘটনা ঘটেই চলেছে। যে দায় নির্বাচন কমিশন এড়িয়ে যেতে পারে না। কমিশন সার্বিক নজরদারির কথা বলে আট দফায় নির্বাচনের কথা বলেছিল। রাজ্যের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ দেখছে ‘করোনা আবহে’-ও রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় এক আছে। বিশেষত কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি এবং রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। প্রথমেই আমরা খুঁজে দেখতে চাইছি আইনশৃঙ্খলা, করোনা আবহ ইত্যাদির কথা বলে নির্বাচন কমিশন আট দফা ভোট করছে। আইন শৃঙ্খলার কথা মাথায় রেখে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে কমিশন। পাশাপাশি করোনাকালে বুথের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। মুখ্য নির্বাচন কমিশন যে পরিসংখ্যান দিয়েছে সেই অনুসারে বুথের সংখ্যা ৩১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। গত বারের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে বুথের সংখ্যা ছিল, ৭৭, ৪১৩ টি এ বছর সেটা বাড়িয়ে করা হয়েছে, ১, ০১, ৯১৬ টি। এই প্রসঙ্গেই বাম-কংগ্রেস এবং তৃণমূল প্রশ্ন তুলেছে, তামিলনাড়ুতে একদিনে ভোট হল কি ভাবে? ২৩৪ টি আসন আছে ওই রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে মাত্র ৬০ টি আসন কম। ১৪০ টি বিধানসভার আসন আছে কেরল রাজ্যে। সেই রাজ্যেও এক দফায় ভোট করা যায় কিভাবে? দু’টি রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করলে করোনার ইস্যু ঠিক মিলছে না। খটকা লাগছে আমাদের।

পরিশীলিত চিন্তকদের পরিকল্পনা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হওয়া সম্ভব নয়। জানতে বড্ড ইচ্ছে করছে, ভোটের দিন পাশের কেন্দ্রে প্রচার কর্মসূচীর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে কেন? ধরা যাক আপনার বাড়ি হুগলী জেলার মোহনডাঙ্গা (কল্পিত নাম) নামক একটি স্থানে। ৬ এপ্রিল সেই গঞ্জ শহরে ভোট ছিল। মোহনডাঙ্গার প্রধান রাস্তার ওপারে কুসুমপুর (কল্পিত নাম) নামে আরও একটি ছোট গঞ্জ শহর আছে। সেই শহরে ৬ এপ্রিল নির্বাচন ছিল না। তাই রাজনৈতিক দলের প্রথমসারির কুশিলবরা বহাল তবিয়তে প্রচার করে যাচ্ছেন। ছোট বড় জনসভায় নেতা নেত্রীরা আসন্ন বিধানসভায় সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনের লক্ষ্যে মানুষকে প্রভাবিত করছেন। এই প্রচারের সমস্ত সুযোগ বেশি করে কাজে লাগাচ্ছেন বিজেপির দুই তারকা প্রচারক নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ। তৃণমূলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যাও আছেন একই তালিকায়। গণতন্ত্রের শৃঙ্খল ভেঙে এ কেমন নির্বাচন? 

কূটনীতির তত্ব-তালাশ করতে গিয়ে বিদূরের কথা মনে পড়ল। বিদূর বলছেন, ক্ষমতা দখলের জন্য সব রকমের কৌশল অবলম্বনে পাপ বা অপরাধ নেই। দাবার চালে যে যত দক্ষ সে যুদ্ধ জিতবে! কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় রথের সারথি কৃষ্ণ সখা অর্জুনকে একই উপদেশ দিয়েছিলেন কাব্য-মহাকাব্যই কি আম বাঙালির ভবিতব্য গড়তে চাইছে? সম্ভবত না। নতুন চিন্তার, নতুন ভোরের কথা বলার জন্য উল্টোদিকে একদল ঝা চকচকে তারুণ্যের স্পর্ধা আমাদের নজর কাড়ছে। তাঁরাও বাংলার গণতন্ত্রের লড়াইয়ে থাকছে।                                                     

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?