‘ভাষা উপত্যকায়’ (বরাক) কালো মেঘের ছায়াঃ ভ্রুকুটিকে ভয় পেলে হবে না।
দীপেন্দু চৌধুরী
ভাষা আন্দোলনের জন্য বহুল পরিচিত অসমের বরাক উপত্যকার সিলচর, করিমগঞ্জ এবং
হাইলকান্দি মহকুমার বিভিন্ন মাধ্যমিক মানের স্কুলের পাঠ্যক্রমে অসম ভাষায় পঠনপাঠন
বাধ্যতামূলক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সম্প্রতি অসম মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের সচিব
সুরঞ্জনা সেনাপতি, এসিএস এক বিঞ্জপ্তি জারি করেছেন। বিঞ্জপ্তির নম্বর এসইবিএ/
এবি/এজি/ ২৬/ ২০২০/১১, তারিখ- ১৮ এপ্রিল ২০২১। বিঞ্জপ্তির বয়ান এখানে উল্লেখ করা
হল, ‘The Notification no. SEBA/AB/AG/26/2020/9 dated 12th April 2021 issued
from this, regarding implementation of Assamese Langugage learning Act
2020, has been kept in abeyance, until further order.’ এই নির্দেশকে
কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায় ফিরে এসেছে ১৯৬১ সালের স্মৃতি। উপত্যকার
আদি বাসিন্দাদের অভিযোগ এই বিঞ্জপ্তিতে পুরো বিষয়টা বলা নেই। যা আঁচ পাওয়া যাচ্ছে
অসম সরকার ‘বাংলা ভাষা’ এবং বাঙালিদের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ নামিয়ে আনতে চাইছে। অসমের
বিধানসভা ভোট শেষ হওয়ার পরেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যতদূর জানা যাচ্ছে, অসমের
প্রতিটি স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অসমীয়া ভাষায় পঠনপাঠন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পরোক্ষে বলা হচ্ছে, ‘বাংলা
ভাষা’ সহ সমস্ত আঞ্চলিক ভাষায় স্কুল পাঠ্যক্রম আর চালু থাকবে না।
উপত্যকা সূত্রে খবর, ১৯ মে বরাক ‘ভাষা শহিদ দিবস’ উদযাপনের দিনেই স্কুল
পরীক্ষার দিন ঘোষণা করা হয়ছে। এই দু’টি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২৬ এপ্রিল বরাক
উপত্যকার বিভিন্ন সংগঠন ১২ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছে। বাঙালি খেদাও কর্মসূচীর অন্যতম
এজেন্ডা কী এই সিদ্ধান্ত? পরিস্থিতি দেখে তাই মনে হচ্ছে। ১৯৬১ সালের ঐতিহাসিক ভাষা
আন্দোলের স্মৃতিই শুধু নয়, কৌশলে ওই সম্মান, মর্যাদা এবং ‘বাংলা ভাষা’-র স্বীকৃতি
কেড়ে নিতে চাইছে বিজেপি নামক বিভাজনকারী একটি হিন্দুত্ববাদী দল। বিজেপি নামক সেই
দল গত কয়েক বছর ধরে জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর নামে অসমের বাঙালিদের হেনস্থা করে
চলেছে।
ইতিহাস গদ্যের ভাষায় কথা বলে। ইতিহাসের বীর মানুষেরা আমাদের জেগে থাকতে বলে
বর্তমান সভ্যতার ‘কালো মেঘ’ চেনার জন্য। বরাক উপত্যকার মানুষ আজও দিন পাহারা
দিচ্ছে, রাত পাহারা দিচ্ছে, বছর পাহারা দিচ্ছে। বরাক উপত্যকা বলছে, ১৯ মে তোমায়
আমরা ভুলিনি। বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে ‘ রক্তাক্ত সিলচর স্টেশন’ জেগে থাকবে। ১১ জন
ভাষা শহিদের রক্ত ঝরা আত্মবলিদানের গদ্য কবিতায়। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনি। কাউকে
ক্ষমা করবে না। আমাদের সবার হ্রদয়ে রবীন্দ্রনাথ মুখে ১৯ মে।
আরও একবার ১৯৬১ সালের ১৯ মে গর্বিত বাঙালির, শোক সন্তপ্ত বাঙালির বরাক
উপত্যকা থেকে চলুন ঘুরে আসি আমরা। যে ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করে স্বাধীনতা
সংগ্রামী উল্লাসকর দত্ত শহিদদের স্মৃতিতে পুস্পস্তবক পাঠিয়েছিলেন। ওই বছরের ১৯ মে
বরাক উপত্যকার বাঙালিদের উপর অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে এক বিরাট
প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত হয়। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘কাছার গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠন
হয়। সিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলকান্দী অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষি নাগরিকদের নিয়ে গঠিত
‘বরাক উপত্যকা’। অন্যায় ভাবে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ১৯৬১ সালের ১৪
এপ্রিল বরাক উপত্যকায় জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ভাষাভাষি মানুষ
স্বতঃস্ফূর্তভাবে ‘সংকল্প দিবস’ পালন করেন। ২৪ এপ্রিল গণসংগ্রাম পরিষদ এক
পদযাত্রার ডাক দেয়। বাঙালি অধ্যুষিত বিভিন্ন গ্রামের মধ্যে দিয়ে এই পদযাত্রা ২০০
মাইল রাস্তা পরিক্রমা করে। ২ মে সিলচরে
এসে এই পদযাত্রা শেষ হয়। মিছিল শেষে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের তরফে রথীন্দ্রনাথ সেন
ঘোষণা করেন, অসম সরকার যদি ১৯৬১ সালের ১৩ এপ্রিলের মধ্যে ‘বাংলা ভাষা’-কে স্বীকৃতি
না দেয় তা হলে ১৯ মে বরাক উপত্যকায় হরতাল পালন করা হবে। পরিষদ সেদিন অন্যান্য
সংখ্যালঘু ভাষার স্বীকৃতিও দাবি করে।
১৯৬১ সালের ১৯ মে সকাল থেকে মহকুমা শহর সিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলকান্দিতে
পিকেটিং শুরু হয়ে যায়। করিমগঞ্জে বিক্ষোভকারীরা সরকারি অফিস, কোর্ট চত্বরে বিক্ষোভ
দেখায়। সিলচরে রেল স্টেশন অবরোধ করে বিক্ষোভ চলতে থাকে। বিক্ষোভ কর্মসূচী ভণ্ডুল
করতে অসম পুলিশ লাঠি চার্জ করে। সাত মিনিট পরে আধা সামরিক বাহিনী এসে বেপরোয়া গুলি
চালায়। কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীর গুলিতে ১৯ মে ঘটনাস্থলেই ৯ জনের মৃত্যু হয়।
পরে গুলিবিদ্ধ আরও দু’জনের হাসপাতালে মৃত্যু হয়। ১৯ মে ১৭ রাউন্ড গুলি চলেছিল। ২০
মে সিলচর শহরে মৃতদের নিয়ে মিছিল হয়। সিলচরে পুলিশের বর্বর এই আক্রমণকে ব্রিটিশ
শাসনের জালিয়ানাওয়ালবাগের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বর্তমান বাংলাদেশের ২১ ফেব্রুয়ারির
ভাষা আন্দোলনের সঙ্গেও তুলনায় আসে।
বাংলা ভাষার সরকারি স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোনের পরেই তৎকালীন অসম সরকার বরাক
উপত্যকার বাঙালি অধ্যুষিত তিনটে জেলায় বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি ফিরিয়ে
দিতে বাধ্য হয়। অসম আইনের ‘Section 5 of Assam Act
XVIII, 1961’ ধারায় বলা হয়েছিল, ‘’Without prejudice to the provisions contained in section 3, the
Bengali Language shall be used for administrative and other official purposes
up to and including district level.’’
শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করছি বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার জন্য যারা
আত্মবলিদান দিয়েছিলেন সেই ১১ জন ভাষা শহিদের নাম...... কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ
সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী
দেবনাথ, সচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকমল পুরকায়স্থ ও কমলা
ভট্টাচার্য।
অসম রাজ্য প্রশাসনের বাংলা ভাষা এবং বাঙালিদের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে
সিলচরের ১০টি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের যুক্ত সমিতির কর্মকর্তা প্রদীপ দত্ত
রায়, নিখিল পাল, গৌতম দত্ত, স্বর্ণালী চৌধুরী রাজীব কর, সুব্রত ভট্টাচার্য, কমল
চক্রবর্তী এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। পরে তাদের পক্ষ থেকে জানান হয়েছে, ১৯
মে বরাক উপত্যকায় ভাষা শহিদ দিবস হিসেবে পালন হয়ে আসছে। এই দিনটার সঙ্গে বরাকবাসীদের
আবেগ জড়িয়ে আছে। রাজ্য প্রশাসন বরাকের বাঙালিদের আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চাইছে।
১৯ মে স্কুলের পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানিয়েছে, বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও
সংস্কৃতি সম্মেলন সহ বিভিন্ন গণ সংগঠন। কিন্তু অসম মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ ও অসম
উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা পরিষদ কোনও রকম গুরুত্ব দিতে আগ্রহী নয়। অসম সরকারের শিক্ষা
দফতর এবং সংস্কৃতি দফতর আরও সুপরিকল্পিতভাবে এগতে চাইছে। পয়লা বৈশাখ বাংলা
নববর্ষের দিন ‘বরাক উপত্যকা’-য় নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতির পরিবর্তে অসমীয়া
সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চাইছিল রাজ্য প্রশাসন। এই বছরের পয়লা বৈশাখ বরাক উপত্যকার
বাঙালিদের আবেদন ছিল, আজ চৈত্র বিদায়ের শোভাযাত্রা আর সব অনুষ্ঠান সূচী, আমাদের
অসমীয়াকরণের প্রতিরোধ করতে হবে। আমাদের ‘লাল সাদা’ গামছা পরা শোভাযাত্রার অংশীদার
হতে হবে।
পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে শুধু ‘এসো হে বৈশাখ’-এর সঙ্গে লাল পেড়ে শাড়ি পরা
ছোট্ট শিশুর নাচের অনুষ্ঠান নয়। এই সঙ্গে শক্ত চোয়ালে শপথ নিতে হবে। আমাদের
ঐতিহাসিক অনিবার্যতার ১৯ মে-র অগ্নিবলয় মনে রেখে। অমর উনিশের
উপত্যকায়, বারে বারে সরকারি নির্দেশিকায় অসমীয়াকরণের প্রতিবাদে বরাকের বাঙালি
গর্জে উঠেছে। আমরা উনিশের ভাষা শহিদের উত্তর প্রজন্ম। ভাষা শহিদরা চিরজাগ্রত আছে।
জয়ী হবে সব মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষ চিরকাল। বিশ্বের আপামর বাংলা ভাষাভাষি মানুষ
পদাতিক মূর্ছনায় বলছে। অসমের বরাক উপত্যকায় উনিশের উত্তরাধিকারেরা লড়াই করেই
নিজেদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। কালো ছায়ার ভ্রুকুটিকে ভয় পেলে হবে না। ‘যদি
তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও/ তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি’।
Comments
Post a Comment