আর কতজন নিরীহ মানুষের মৃত্যু হলে ভোট শেষ হবে!





 

দীপেন্দু চৌধুরী

প্রাক নববর্ষের উৎসবের আগে চারটে রাজ্যে ‘ভোট উৎসব’ শেষ হয়েছে। বাংলা  নববর্ষ এবং ‘বৈশাখী’ উদযাপনও শেষ হল। আমাদের বাংলায় এখনও চলছে ভোট বৈশাখী। আমরা এখনও গণতন্ত্রের উৎসবে সৌৎসাহে করোনা বিধিকে উপেক্ষা করেই অংশগ্রহণ করছি। ক্ষমতা দখলের এক সম-অসম অসদৃশ্য লড়াই, রাজনৈতিক দলগুলির নেতানেত্রীদের ভোট রাজনীতির ময়দানে টেনে এনেছে। একটা করে নির্বাচনী তারিখ পার হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি ‘নির্বাচনী হিংসা’-র মানচিত্রে নাম তুলে নিচ্ছে। শীতলকুচি নবতম সংযোজন। ১০ এপ্রিল রাজ্যে চতুর্থদফা ভোটের দিন নির্বাচন চলাকালীন সশস্ত্র কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চলল। এবং পাঁচজন নিরীহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীর মৃত্যু দেখতে হল আধুনিক ভারতের বহু চর্চিত, বহু আলোচিত গণতন্ত্রের উৎসবে।

এদের মধ্যে চারজনের মৃত্যু কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে। এদের প্রত্যেকের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তরতাজা তরুণ তাঁরাপ্রথম বার ভোট দিতে এসেছিল আরও একজন ১৮ বছরের এক কিশোর। দু’টি রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গিয়ে দুষ্কৃতির গুলিতে মৃত্যু হয় ১৮ বছরের ওই যুবকের। ওঁর দু’চোখে ছিল অচেনার আনন্দকে জয় করার এক উজ্জ্বল উদ্ভাস। প্রথমবারের ভোট উচ্ছ্বাস। গণতন্ত্রের উৎসব তাঁর নতুন জয় করা সেই উদ্ভাসিত আলো চিরকালের জন্য কেড়ে নিয়ে গেল। এ কোন উপত্যকা আমরা গড়ে তুলতে চাইছ? এখনও আমাদের বলতে হবে, নতুন সূর্য আলো দেখাও! আলো দাও...... আলো দাও! ভারতীয় ঐতিহ্যের সংস্কৃতি আমাদের মৃত মানুষের ধর্ম খুঁজতে শেখায়নিবহু সংস্কৃতির সমাজ আমাদের শিখিয়েছে, যে কোনও মৃত্যু দুঃখের। কিন্তু যখন কারও আচম্বিতে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তাঁর ধর্মীয় পরিচয়, সামাজিক পরিচয় খুঁজতে নেই। তাই কি আমাদের উচ্চারণ করতে হবে, আধুনিক গণতন্ত্রের ভোট রাজনীতির বলি হল পাঁচজন। বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া কোচবিহারের শীতলকুচির জোড়াপাটকা  গ্রামের পাঁচজন নিরীহ ভারতীয় ভোটারের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতির চাপানউতোর শুরু হয়েছে।

অমিত শাহ দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন কেনো মুখ্যমন্ত্রী সিআইএসএফ-এ গুলিতে নিহত চার জনের জন্য শোকপ্রকাশ করছেন, কিন্তু দুই দলের সংঘর্ষে নিহত রাজনবংশী যুবক আনন্দ বর্মণের জন্য শোক প্রকাশ করছেন না? অমিত শাহ্‌র এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। মুখ্যমন্ত্রী ঘটনার দিনই বলেছেন, ওখানে পাঁচজন শহীদ হয়েছেন। তিনি ১৪ এপ্রিল মাথাভাঙ্গায় গিয়েছিলেন। সিআইএসএফ-র গুলিতে নিহতদের বাড়ির মানুষেরা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। আনন্দ বর্মণের দাদু এসে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। আনন্দের বাবা ও মা আসেননি। তাঁরা জানিয়েছেন যে তাঁরা বিজেপির সমর্থক হতে পারে, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। অমিত শাহ বিভাজনের জন্য রাজবংশী কার্ড খেলেছেন। কিন্তু তিনি কোচবিহার-জলপাইগুড়ির গ্রামীণ সমাজ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ওই জেলার মুসলমানরাও নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে রাজবংশী। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি এক ও অভিন্ন। উল্টোদিকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ খোলাখুলি হুমকি দিয়েছেন আরও শীতলকুচি ঘটানো হবে। আর এক নেতা বলেছেন, গুলিতে ৪ জন কেন ৮ জনের মারা গেলে ভালো হতো। এই ধরণের কথা বার্তা সম্পর্কে অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চুপ।                        

সূত্রের খবর, শীতলকুচি বিধানসভা অঞ্চলে দু’টি সম্প্রদায়ের ৮০০ পরিবারের বসবাস। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই এলাকা কতটা স্পর্শকাতর হতে পারে সেই খবর নির্বাচন কমিশনের কাছে ছিল না কেন?  কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্রের পাতায় লেখা হচ্ছে, আশঙ্কাজনক হল,  ১০ এপ্রিল শীতলকুচির ১২৬ নং বুথ অঞ্চলে ‘বিজেপি এবং তৃণমূল-উভয় দলের কর্মীরাই কিছু কিছু গ্রামবাসীকে ভোট দেওয়া আটকাচ্ছিলেন। দু’পক্ষই নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিভাজনকে মাথায় রেখে গ্রামবাসীদের আটকাচ্ছিল। উত্তেজনার প্রাথমিক কারণও দু’দলের নির্দিষ্ট ধর্মীয় হিসাব মাথায় রেখে হাঙ্গাম চালানো।’ কিন্তু এর থেকে এটা প্রমাণিত হয় না, যে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রী আধাসামরিক বাহিনীকে গুলি চালাতে হবে সাধারণ, নিরস্ত্র, নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর। যারা ভোট দিতে এসেছিল। পুলিশের কাছে ময়নাতদন্তের যে রিপোর্ট জমা পড়েছে তাতে বলা হয়েছে, দু’জনের বুক-পিঠ ফুঁড়ে গিয়েছে গুলি। তৃতীয়জনের হাত ছুঁয়ে ফুঁড়ে গিয়েছে পেট। চতুর্থ জনের শরীরে বুলেটের চিহ্ন নেই। তাঁর কোমরের দিকে ক্ষতের পাশাপাশি মাথার পিছনে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করার চিহ্ন রয়েছে। কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী আক্রান্ত হলে, নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালাতেই পারে। ভোট চলাকালীন শীতলকুচি বিধানসভার জোড়াপাটকির আমতলি মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের ১২৬ নম্বর বুথে ১০ এপ্রিল উত্তেজনা দেখা দেয়। বুথে পোলিং এজেন্ট বসতে দেওয়া নিয়ে গণ্ডগোলের সূত্রপাত। এই গণ্ডগোল মিটতে না মিটতেই ওই এলাকার কিশোর জাহেদুলের উপরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর হামলার অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে। ১৩ এপ্রিল সংবাদে প্রকাশ, মাথাভাঙা মহকুমা হাসপাতালের বেডে শুয়ে জাহেদুল অভিযোগ করেছে, জওয়ানরা সবাইকে তাড়া করছিল। তাকেও এসে ধরে। সে কাকুতি মিনতি করেকিন্তু তাতে কাজ হয়নি। একজন তাঁকে ছোট ছেলে বলে ছেড়ে দিতে বলেছিল। আরেকজন জওয়ান সেটা না শুনে জাহেদুলকে তুলে আছাড় মারেন। এর পরের ঘটনা সবাই আমরা জানি।        

সেদিনের ঘটনার পরম্পরার পৃষ্ঠা উল্টে মেনে নেওয়া গেল সেদিন ওই বুথে উত্তজনা চরমে উঠেছিল। সেটা পরিকল্পিত উত্তেজনা হোক অথবা অপরিকল্পিত। প্রথম প্রশ্ন উত্তেজিত জনতাকে বাগে আনতে লাঠি দিয়ে পেটাতে পারত আধাসামরিক বাহিনী। কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করতে পারত। সেসবের কিছুই করেনি কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানরা। তাঁরা প্রথমেই গুলি চালায়। আমরা ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে জানতে পেরেছি যে তিনজন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, তাদের গুলি লেগেছে বুকে এবং পেটে। এর থেকেই প্রশ্ন উঠছে বাহিনীর জওয়ানরা মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই কি গুলি চালিয়েছে? অথচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত মহিলাদের গুলি লেগেছে কোমরের নিচে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া বয়ান থেকে জানা যাচ্ছে, ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের উপর গুলি চালান হয়। সূত্রের খবর, ১৫ রাউন্ড গুলি চলেছে সেদিন। কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানরা আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালিয়েছে বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষক বিবেক দুবের দাবি, ‘পরিস্থিতি, অনুকুল থাকলে বিধি মেনে চলা হয়। কিন্তু এ দিন পরিস্থিতি অনুকুল ছিল না। বাহীনী আত্মরক্ষায় গুলি চালিয়েছে। বেশ উত্তম কথা। সরকারি আমলারা তোতাপাখির মত যে কথা বলে থাকে, দুবে সাহেব আপনিও সেই কথা বলছেন। জানতে চাইছি আপনার বাহিনী উত্তেজিত জনতার পায়ে গুলি চালাল না কেন? আহত করেওতো উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। সংবাদ মাধ্যমও প্রশ্ন তুলছে, কেন পরিস্থিতি অনুকুল ছিল না? প্রশাসনের নজরদারি থাকা সত্বেও ‘বেআইনি’ জমায়েত কি ভাবে হল? এই প্রশ্নের জবাব বিবেক দুবে দিতে পারেন নি। আমরা আরও একটা বিষয় জানতে চাইছি  ১২৬ নম্বর বুথে রাজ্য পুলিশের কোনও জওয়ান বা অফিসার ছিল না কেন? বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে, নির্বাচনের দু’তিন দিন আগে কোচবিহারের পুলিশ সুপারকে বদলি করে নতুন সুপার নিয়োগ করে নির্বাচন কমিশন। এই বিষয়টাও অনেককে ভাবাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের সপ্তদশ নির্বাচনের এক বছর আগে থেকে বিজেপি এবং তৃণমূল দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা প্ররোচনামূলক কথা বলছেন। বাংলা নিউজ চ্যানেলগুলিতে সারাদিন ধরে সেই উবাচ শোনানো হচ্ছে। সেই ভাষা শুনে নিজেদের দলের কর্মীসমর্থকরা উত্তেজনার রসদ পাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানদেরকেও কি প্ররোচিত করল? বিশেষ করে বিজেপি নেতা শায়ন্তন বসু প্রকাশ্যে বলেন, আধা সামরিক বাহিনীকে বলে দেওয়া হয়েছে, মাথা লক্ষ করে গুলি চালাতে। রাজনৈতিক প্ররোচনা ছিল কি ছিল না সেটা ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে আসছে। নির্বাচনকে আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে ‘ধর্মীয় মেরুকরণ’-র তাস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে? বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের ভাষা শুনলে বোঝাই যাচ্ছে, তাঁরা মেরুকরণ করতে চাইছে। এবং এই ধরণের ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে দলগত প্রস্তুতি শুরু করেছিল বিজেপি,  ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে ১৮ টি আসন জেতার পর থেকেই।

যে প্রশ্নগুলি উঠে এসেছে  সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ কোথায়? সিআইএসএফ জওয়ানদের গুলি চালানোর নির্দেশ কে দিয়েছিল? ম্যাজিস্ট্রেট পদমর্যাদার কোনও আধিকারিক কি ১২৬ নম্বর বুথে সেদিন উপস্থিত ছিলেন? নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে শীতলকুচির ১২৬ নম্বর বুথ স্পর্শকাতর বুথ ছিল। মেনে নেওয়া গেল, তাহলে অবশ্যই এই বুথে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। অথবা নির্বাচন শুরু হওয়া থেকে গণ্ডগোল চলাকালীন এবং গুলি চালানোর ফুটেজ থাকবে। সেই ফুটেজ নির্বাচন কমিশনের কাছে আছে কি?             

৯ এপ্রিল ‘সপ্তাহ’ পত্রিকার লেখায় আমরা এই প্রশ্নটাই তুলেছিলাম। ‘আগের দফা থেকে ১৭৫ কোম্পানি বেশি বাহিনী মোতায়েন করা হবে। রাজ্যে এখন ১০০০ কোম্পানি বাহিনী রয়েছে। ভোট চলাকালীন পরবর্তী কয়েক দফার জন্য আরও ৬৮ কোম্পানি বাহিনী আসার কথা আছে। জানতে ইচ্ছে করছে এর পরে কি কোথাও গণ্ডগোল হবে না? ‘ভোট সন্ত্রাস’ হবে না? কোনও মানুষের মৃত্যু হবে না? এমন আশ্বাস কি নির্বাচন কমিশন দিতে পারবে?’

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?