বিভেদ রাজনীতিঃ নাগরিকত্ব এখন বিজেপির কাছে ভোট জেতার অন্যতম সোপান




দীপেন্দু চৌধুরী

এ –মাটি আমারও মাটি

সে কথা সবার সামনে

কীভাবে প্রমাণ করব আজ  

মাটি, শঙ্খ ঘোষ   

অনেকেই বলছেন কথাটা। এবং ঠিকই বলছেন। অনেকবার পুনরুক্তি তবু বার বার আমাদের বলতে হবে। ভোট দেওয়ার আগে পর্যন্ত আপনি হিন্দু, মুসলিম, দলিত, মতুয়া, রাজবংশী, গোর্খা, ভুটিয়া। ভোট মিটে গেলে রাজনৈতিক দল বিশেষত বিজেপি নেতৃত্বের কাছে আপনার কোনও পরিচয় নেই। ‘নাগরিকত্ব’ দেওয়া নামক এক মিথ্যে প্রতিশ্রুতি ফেরি করে বেড়াচ্ছেন বিজেপি নেতৃত্ব। ভোট আসলেই সোনার পাথরবাটি করে ভোটারদের সাজিয়ে দেওয়া হয় ‘নাগরিকত্ব’ নামক এক বিভেদকামী নীতির গল্প। ভোটের পরে বিজেপির মিথ্যে প্রতিশ্রুতির মোটা ঢোল ফেটে গিয়ে দেখবেন আপনাকে নিজের পরিচয় অর্থাৎ এক অসহায় গরিব মানুষ হিসেবেই বেচে থাকতে হবে। অসম রাজ্যের পরে এটাই এখন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভোট রাজনীতি।

বাংলার ভোট চলাকালীন বিভাজনের রাজনীতির ফায়দা তুলতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বিজেপির অন্যতম হাতিয়ার। সঙ্গে রাখা হচ্ছে অনুপ্রবেশ নামক পুরনো ইস্যুকে। যাতে সহজেই মানুষকে বোকা বানান যায়। বিজেপি বলতে চাইছে, বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু অনুপ্রবেশকারী নাকি আমাদের রাজ্যে ঢুকে পড়ছে। ভোটের মেরুকরণ করে আসলে বাংলার মসনদ দখল করাটাই বিজেপির প্রধান উদ্দেশ্য। গত তিন বছর আগে অসমে এনআরসি করার সময় অসমের বিজেপি নেতৃত্ব একই ইস্যু তুলেছিল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশ থেকে আসা  অনুপ্রবেশকারীদের ‘উইপোকা’ বলে দেগে দিয়েছিলেন। এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেদিনই ঘোষণা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি করে ২ কোটি বিদেশীকে চিহ্নিত করে ফেরত পাঠাবেন। আমার এক বরিষ্ঠ সাংবাদিক বন্ধু বলেছিল, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ থেকে মানুষ অসম বা পশ্চিমবঙ্গে আসতে আগ্রহী নয়। তাঁরা আসছেও না। কারণ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি আর্থসামাজিকভাবে অনেক উন্নত দেশ। গত কয়েক বছরে ভারতের বিকাশের হারকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ

এই কথার সত্যতা পাওয়া গেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রিপোর্ট থেকে। নিবিড় বিকাশের কারণে মাথাপিছু আয়ে ভারতকে পিছনে ফেলে দিয়েছে বংলাদেশ নামক একটি নতুন অনুন্নত রাষ্ট্র গত সাত বছরে মোদীর নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবনয়ন হয়েছে। উল্টোদিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাপকাঠিতে ভারতের থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অনুপ্রবেশকে সামনে রেখে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ফায়দা তুলতে পশ্চিমবঙ্গের তেহট্টের জনসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, মতুয়ারা বহু কাল পশ্চিমবঙ্গে ‘শরণার্থী’র মত জীবনযাপন করছেন, ভোটের পর বিজেপি তাদের নাগরিকত্ব দেবে। ভোট রাজনীতির পুরনো তাস ব্যবহার করে মতুয়াদের কাছে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চেয়েছেন তিনি। কিন্তু হাটে হাড়ি ভেঙে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা হাবড়ার একটি জনসভা থেকে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘’তার মানে দাঁড়ায় মতুয়ারা এখন নাগরিক নন। সেটা কি করে ঠিক হয়?’’ প্রশ্ন তুলেই তৃণমূলনেত্রী নিজেই উত্তর দিয়েছেন, ‘’১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত যাঁরা এসেছেন, তাঁরা সবাই এ দেশের নাগরিক।‘’

অমিত শাহ যে ঠিক কথা বলছেন না, এই বিষয়টা উদাহারণ দিয়ে অনেকেই প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। যেমন, সিএএ ২০১৯-র কোনও ধারায় মতুয়া উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে এমন কথা আলাদা করে কোথাও বলা নেই। ‘ভোট বাংলায়’ প্রচারের উদ্দেশ্যে ৩০ শতাংশ মতুয়াদের কথা মাথায় রেখে অমিত শাহ এই কথা বলছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে পাহাড়ে গিয়ে গোর্খা ভোটারদের কথা মাথায় রেখে সিএএ নিয়ে উল্টো কথা শোনাচ্ছেন। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে পাহাড়ের আসন বিজেপি জিতলেও সিএএ নিয়ে বেশি কথা বলেননি। আবার কোচবিহারের প্রচারে অমিত শাহ ‘রাজবংশী’ ভোটারদের কথা মাথায় রেখে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন সরকার গঠন করলে বাংলায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন লাগু হবে।       

২০১৬ সালে মোদী সরকার একটি একটি সংশোধনী বিল এনে ভারতের নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তনের চেষ্টা করে। ওই সংশোধনী বিলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা অ-মুসলিম উদবাস্তুদেরকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়। ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক এই আইন স্পষ্টতই সংবিধান বিরোধী। কারণ ভারতীয় সংবিধান ধর্ম, জাতি, ভাষা, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলকে সমান অধিকার দিয়েছে। বিজেপি সরকার যুক্তি হিসেবে বলছে, যে এর মাধ্যমে প্রতিবেশি দেশগুলির অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের ভারতে আশ্রয় দেওয়া যাবে। যদি সত্যিই সেটা হতো, তাহলে এটাও আমাদের বলতে হবে, ধর্ম, জাতি, ভাষা নির্বিশেষে সমস্ত নিপীড়িত শরণার্থীদের ভারতে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলা হল না কেন?

ওই তিনটি প্রতিবেশি দেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, খ্রীস্টান বা পারসিরা নিপীড়িত হলে তাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে অথচ মুসলমান সম্প্রদায়ের কেউ নিপীড়িত হয়ে আশ্রয় নিলে তারা ‘’অনুপ্রবেশ কারী’’। এই যুক্তি কোনও সমাজ সচেতন যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব? যেমন মায়ানমার বা শ্রীলঙ্কার মতন প্রতিবেশি দেশের অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের এই আইনের আওতার বাইরে রাখাটাই বা কতটা যুক্তিসঙ্গত? আরও একটা বিষয় বিশেষঞ্জরা বলছেন, সাবেক পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছেন এমন কোনও উদ্বাস্তু নতুন এই আইনের কথা মাথায় রেখে আবেদন করলে তিনি আইনের বাধ্যবাধকতার আওতায় এসে যাবেন। যেমন, সেই ব্যক্তি মেনে নিতে বাধ্য হবেন যে, তিনি এতদিন ভারতে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে বসবাস করে আসছেন। তারপরে আরও সমস্যা ধেয়ে আসবে। ভবিষ্যতে এনপিআর- এনআরসি প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু হলে অনেককেই সহজেই ‘সন্দেহজনক নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে কতৃপক্ষ।               

 ২০১৬ সাল থেকে ‘কাগজ আমি দেখাব না’ স্লোগানকে সামনে রেখে ব্যপক বিরোধিতা হয় এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের। বিভিন্ন রাজ্যে মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রতিবাদ সংগঠিত করে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। ২০১৯ সালে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি দ্বিতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করে বিরোধীশুন্য আইনসভার দুটি কক্ষে বিল পাশ করিয়ে নিতে সক্ষম হয়। বিলে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করার পর এখন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু সরকার সেই আইন প্রয়োগে দ্বিধা করছে কেন? এই বিষয়টা পরিষ্কার হবে অসমের দিকে তাকালে। অসমে চারবছর ধরে ১৬০০ কোটি টাকা খরচ করে নাগরিকপঞ্জি তৈরির যে প্রক্রিয়া সরকার চালিয়েছিল সেই তালিকা সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে। ২০১৯ সালের ৩১ অগস্ট প্রকাশিত সেই চূড়ান্ত তালিকায় বাদ পড়েছিল ১৯ লক্ষ নাগরিকের নাম। প্রায় ১২ লক্ষ বাঙালি হিন্দুর নাম চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। বাদ পড়েছেন ৫ লক্ষ বাঙালি মুসলমান। এই তালিকায় নাম আছে বিহারি, গোর্খা, দলিত এবং আদিবাসীদের। অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপি নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দু’রকমের কথা বলছে। যেটাকে ইচ্ছাকৃত দ্বিচারিতা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে দাবি বিভিন্ন বিজেপি অসমের ভোট শেষ হতেই বিদেশী নোটিশের আতঙ্ক শুরু হয়েছে অসমের বিভিন্ন অঞ্চলে। সংবাদের প্রকাশ বঙ্গাইগাঁও সহ নিম্ন অসমের বিভিন্ন জেলায় ফের ইস্য করা হচ্ছে বিদেশি চিহ্নিতকরণের কর্মসূচীকে। সংশোধিত আইনকে সামনে রেখে হিন্দু বাঙালিকেও চিহ্নিত করার চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে বাঙালি অধ্যুষিত অসমের বিভিন্ন জেলায়। এই নোটিশ ধরানোর জন্য বাড়িতে কাউকে না পেলে তার বাড়ির সামনের লাইটপোস্টে লটকে দেওয়া হচ্ছে বেদেশি নোটিশ। কংগ্রেস সহ বিভিন্ন রাজনোইতক দলের বক্তব্য, এই ঘটনায় ১৯৬৪ সালের বিদেশি ট্রাইব্যুনাল অর্ডার যেমন লঙ্ঘিত হচ্ছে, তেমনি বিভিন্ন মামলায় দেওয়া হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশও অমান্য করা হচ্ছে। কারণ বিদেশি বলে যাকে সন্দেহ করা হচ্ছে তার হাতে নোটিশ পৌঁছে দেওয়ার কথা আদালত বহুবার বলেছে।

বিজেপি পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি দখল করতে চাইছে মূলত বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতিকে আক্রমণ করে। এবং মনুবাদী দল হিসেবে দলিত আদিবাসীদের নিম্নবর্গের নাগরিক হিসেবেই রেখে দিতে চাইছে তাঁরা। তাই অসম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ সহ পূর্ব ভারতের গণতন্ত্রপ্রিয় ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে নিজেদের স্বার্থে সতর্ক হতে হবে। ‘গোদী মিডিয়া’-র প্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেদের দায়িত্বের কথা ভাবতে হবে। বিজেপির দ্বিচারিতাকে চিহ্নিত করার দায়িত্ব সকলের। এক ভাষা, এক জাতি, এক ধর্মের রাষ্ট্র নয়। ভারত নামক একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে সমস্ত জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের  মানুষ একসঙ্গে থাকবে। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য এই অধিকার ভারতীয় সংবিধান আমাদের দিয়েছে।   

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?