সূর্যস্নাত রঙিন বেলা শেষে বৈশাখী আমন্ত্রণ
সূর্যস্নাত রঙিন বেলা শেষে বৈশাখী আমন্ত্রণ
দীপেন্দু চৌধুরী
মৃত্যু মিছিলের
সরণী পার হতে হতে আমরা আজও চৈত্র শেষে বৈশাখী শপথে, জীবনের গান শুনতে চাইছি। থমকে
যাওয়া জীবনের গান। সৃষ্টির গান, প্রলয়ের গান। বিজয়ের সঙ্গীত। মৃত্যু তুমি জিততে
চাইছ কেন? যৌবনের বারান্দায় সকালের রোদ দুরন্ত গতিতে লটোপুটি খেলছে। দেখ দেখ, ভালো
করে নয়ন খুলে দেখ। রোদ বলেছে, আমি ছিলাম, আমি আছি। কালো কালো মেঘের আড়াল
থেকে আমি মুচকে হাসি। আমি থাকি। তোরা দক্ষিণের জানলা দিয়ে আমার দিকে চেয়ে দেখ।
সকাল আটটা নটার আকাশে আমি থাকব অভিভাবকের প্রশ্রয়ে। সারা দিন প্রখর আলোয় আমি জ্বল
জ্বল করব। আমি তরুণ, আমি যৌবনের দূত। ক্লান্ত মানুষকে আমি প্রশ্রয় দিয়ে শিমূল
পলাশের নিচে পৌঁছে দেব। লাল গোলাপের সুবাস এনে দেব। সন্ধ্যার বিদায় বেলায় সাদা
রজনীগন্ধাকে বলে যাব। বিভেদ, ভেদাভেদ নয়। বিচ্ছিন্নতা নয়।
বেহালার তানে ঐক্যের ঐকতান বাজাতে হবে। বিষাদের সুর নয়, আনন্দের সুর। সম্প্রীতির গান
গাইতে হবে আমাদের। আলোর বাগানে সব ফুল ফুটুক। ভালো করে চেয়ে দেখ, আচমকা কাল বৈশাখী
আমাকে আজও শান্ত করতে পারেনি। আমি অশ্রান্ত, আমি অক্লান্ত, আমার প্রশ্রয়ে আদিগন্ত
নীল আকাশে শিশুর দল লুটোপুটি খেলছে অনন্তকাল। মহামারীর ভ্রুকটিকে ভয় পেলে কেন হবে?
কবি বলে গেছেন, এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।
মানব সভ্যতা
ক্লান্ত হয় না। মানব সভ্যতা বেঁচে থাকে নতুন সভ্যতার আহ্বানে, সৃষ্টির আহ্বানে।
মানুষ ভরসা খোঁজে, অভিভাবক খোঁজে। সেদিন প্রখর সূর্যের প্রশ্রয়ে দু’চোখ খুলে
আকাশের দিকে চেয়ে ছিলাম। চোখ দু’টো জ্বল জ্বল করে উঠল। কোন অপরাধে জানি না। আধুনিক
সমাজে চার চারটে বছর একটা চোখে আলো ছিল না। না কেউ এগিয়ে আসেনি। ছিল, অনেকেই পাশে
ছিল। কিন্তু কেউ সাহস পাচ্ছিল না। ভয়ংকর এক আক্রমণাত্বক শত্রুর দাপটে। করুণার হাত
অপমান করে ‘তুই’ সম্বোধনে ‘সমাজ সেবা’ করতে চাইছিল। ২০ বছরের ছোট এক ডাক্তার তর্পণ
খান নাম সম্ভবত। সে নাকি সমাজ সেবক। সমাজে, সংবাদ মাধ্যমে যারা আমার থেকে ১০-২০
বছরের ছোট তাঁদেরও শেখানো হয়েছিল। আমাকে নাম ধরে ‘তুই’ বলে ডাকতে। তথাকথিত এক
অসহিষ্ণু সমাজসেবীর দল এভাবেই সৎ,
সৃষ্টিশীল মানুষদের আঘাত করে, আক্রমণ করে। মানবতা হারিয়ে যায় না। মানবতার আহ্বানে
সৃষ্টিশীল মানুষ বারে বারে ফিরে আসে। ‘আজি দক্ষিণ দুয়ার খোলা...... এসো হে এসো হে এসো হে’।
আজও আমার
আত্মসম্মান আছে। আমি আত্মসমর্পণ করিনি। হুতোমের পরামর্শে আমি চোখের আলো ফিরে
পেয়েছি। ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। চৈত্রের শেষ সকালে
আকাশের দিকে চেয়ে ছিলাম। বলে গেল ছুঁয়ে গেল সূর্যের আলো। হঠাতই কথাগুলো শুনলাম,
রোদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে। আমাদের বাড়ির পাশে একটা শিমূল গাছের তরতাজা সবুজ পাতা
ঝরে পড়ল আমার গায়ে। শিহরণ দিয়ে উঠল আমার সমস্ত শরীরে। আমি রোদের আশ্রয়ে আত্মসমর্পণ
করলাম। সূর্যের আলোয় অবগাহণ করলাম।
গত একটা বছর মানব
সভ্যতা থমকে আছে। থমকে গেছে। স্পন্দন কিন্তু থেমে যায়নি। যৌবন আপন প্রশ্রয়ে ছুটছে।
ওরা লড়াই করছে। যৌবন ছুটতে জানে। জীবনশিল্পী বেঁচে থাকার গান গাইতে জানে। কয়েকদিন
আগে সন্ধ্যেয় ছাদে বসে আছি। হুতোম এলো। অনেক অনেকদিন পরে। হুতোম বলল, ‘কিরে হেরে
গেলি? বন্ধু নেই, আত্মীয় নেই, প্রেম নেই, কবিতা নেই, সাহিত্য নেই, গান নেই, সমাজ
নেই তোর। কোথায় যেতে চাইছিস?’ আমি বললাম, ‘তুমি কেমন আছ?’
হুতোম বলল, ‘সকাল
থেকে ওই পাখিটার গান শুনতে পাচ্ছিস? পাখিটার গলা চিনতে পারছিস না? তাইত?’
উত্তর দিলাম,
‘হ্যা ঠিক বলেছ, গত এক দেড় মাস পাখিটা ভাঙা গলায় ডাকছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম কোন
বেয়াড়া কাক চেল্লাচ্ছে। কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে।’
‘না রে ও আমার
বন্ধু। আমার থেকে বয়সে বড়। ওর নাম লতা। বসন্ত এসেছে। ওইতো তোদের গান শোনাবে। প্রৌঢ়
কোকিল বলে ওর গলা ভেঙে যায়নি। করোনা দৈত্যও ওর গলা ভেঙে দেয়নি। আমার বন্ধু লতা
অসুস্থ। ওষুধ খাচ্ছে। বসন্ত এসেছে কোকিল গান গাইবে না? জীবনের গান, ভালোবাসার গান।
প্রেমের গান। সামাজিক বন্ধনের গান। তোর মতো হেরে যাওয়া ‘গ্রাম্য মোরগ’ হয়ে বেঁচে
থাকবে?’
হুতোম চলে গেছে।
আমি মনে মনে বিড় বিড় করছি ‘ব্যাতিক্রম’। বয়স জীবনকে ক্লান্ত করতে পারে না। বুড়ি
কোকিলের কথা বলে হুতোম আমাকে সাহায্য করে দিল। গত প্রায় এক দেড় মাস আমরা বুড়ি কোকিলটার
ডাক শুনছি। অক্লান্ত অবহেলাতেও সে থামেনি। তাঁর গান গেয়েই যাচ্ছে। আজ হুতোম না
বললে আমিও জানতাম না। আমার অখন্ড অবসরে। তিন দশকেও ‘আত্মপরিচয়’ খুঁজে না পেয়ে স্তব্ধ
হয়ে যেতে চাইছে আমার মন, আমার সত্তা। শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। অনুভূতি পাচ্ছি না। ‘পরিবার’
খান খান। বন্ধু-আত্মীয়রা আপন আত্মার খোঁজে নিজ নিজ ভূখন্ড বেছে নিয়েছে। বুড়ি কোকিল
আমার কাছে ‘ব্যতিক্রম’ মনে হল। দেহ মনের বিদায় বসন্তেও সে থামতে জানে না। গাইতে
জানে। অসুস্থ গলা নিয়েও সে নির্জনে বসে জানান দিচ্ছে রঙিন বসন্তের। বৈশাখ এসে
গেছে। সূর্যস্নাত রঙিন বেলা শেষে বৈশাখী আমন্ত্রণের গান শুনতে পাচ্ছি। বুড়ি কোকিল
গান গাইছে।
Comments
Post a Comment