দল বদলের নয়, দিন বদলের কথা বলছেন ওরা






দীপেন্দু চৌধুরী

আরো কত ছোটো হব ঈশ্বর

ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে!

আমি কি নিত্য আমারও সমান

সদরে, বাজারে, আড়ালে?

      ভিড়, শঙ্খ ঘোষ

কবিতার এই চারটি লাইন আজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। বর্তমান সময় কালের সঙ্গে পরম্পরাগত আলোচনা করলে। কাল-সময়কাল আমাদের মানুষের ভিড়ে এসে দাঁড়াতে আহ্বান করে। যে বিষয়ে আত্মীক উচ্চারণ করতে হবে সেটা আমাদের ভাবতে শিখিয়েছে। ভাবতে শেখাচ্ছে। সোভিয়েত রাশিয়া সহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে যখন আভ্যন্তরীন পরিবর্তন নজরে পড়ছে, সেই সময় একটি কার্টুন জনপ্রিয় হয়েছিল। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস মস্কোর রাস্তায় টুপি হাতে ভিক্ষা চাইছেন, ছবির নীচে লেখা আছে ‘কিন্তু আমাদের তত্ত্বটা ভুল ছিল না’। বামপন্থী রাজনীতি বা সংগঠন করে যারা বড় হয় তাদের মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব যেমন পড়তে হয়। সেই সঙ্গে শিখতে হয় আত্মসমালোচনা করার অভ্যাস। আত্মসমীক্ষা করার অভ্যাস।

পশ্চিমবঙ্গ নামক একটি রাজ্য ২০২১ সালে এসে নতুন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছে। একদিকে মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানবতার অবনয়ন পাশাপাশি জাতপাত এবং ধর্মের নামে পরিবার, সমাজকে ভেঙে দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র। এখানে দাঁড়িয়ে রাজ্যের বাম গণতান্ত্রিক শক্তির জোড়ালো উপস্থিতির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যার নেতৃত্ব দিতে পারে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম।

ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও ভোগবাদী সমাজ বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়। মানুষকে করে তোলে আত্মকেন্দ্রিক।        

একটা সময় বাম রাজনীতির সর্বগ্রাহ্য গ্রহণযোগ্যতার কারণ ছিল সমাজের বিভিন্ন সমস্যাকে বামপন্থী নেতাকর্মীরা অত্যন্ত আন্তরিকভাব দেখতেন। মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সংগঠিত আন্দোলনের ফসল নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারতেন তাঁরা। সরকার বা প্রতিষ্ঠানে না থাকার কারণে বামপন্থীদের ভাবনাচিন্তা ছিল প্রগতি ধারার পক্ষে। সংসদীয় গণতন্ত্রে ব্যবহার যোগ্য নীতি কৌশলকে কাজিয়ে লাগিয়ে তাঁরা এই আন্দোলন সংগঠিত করতেন। তৎকালে মতাদর্শগত আদর্শই ছিল অন্যতম পুঁজি। মলিন, ধূসর ঘামে ভেজা জামা প্যান্ট পড়ে, আধবেলা খেয়ে একমুখ হাসি নিয়ে সেই সময়ের তরুণ প্রজন্ম সমাজকর্মী হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তথাকথিত পুঁজিবাদী শক্তির বিরোধিতা করে মানুষের বিশেষত শ্রমিক, কৃষকদের কাছে পৌঁছে যেতেন বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী আদর্শবাদী ছাত্র-যুবদের দল। আমাদের যা বয়স সেখান থেকে গত শতাব্দীর ষাট-সত্তর দশকের বিভিন্ন আন্দোলনে কলেজ বিশ্ব-বিদযালয়ের বুদ্ধিদীপ্ত, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের আমরা সামনে থেকে দেখেছিতাঁরা ‘কেরিয়ার’ নামক এক শব্দের মোহ ভেঙে ‘মানব সেবা’-র আদর্শকে সামনে রেখে রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। যারা বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাস করেন তাঁরা এবং প্রায় সব মতাদর্শের মানুষের কাছে ষাট সত্তরের প্রজন্মের ছাত্র-যুবদের নিঃস্বার্থ আন্দোলন আজও গ্রহণযোগ্য।

গত শতাব্দীর সত্তর দশকেই এই বাংলা পেয়েছিল ‘বামফ্রন্ট’ সরকার। টানা ৩৪ বছর সরকারে থাকার কারণে বামপন্থী ছাত্র-যুবদের প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলন রাজ্যস্তরে গড়ে তুলতে দেখা যায়নি। এটাই ছিল তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতা। যে বাস্তবতা দেশের প্রথমসারির বামপন্থী দলগুলি মেনে নিয়েছে। তবে শ্রমিক-কৃষক বিরোধী, জাতপাত বিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে বামপন্থী ছাত্র-যুবদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। গত বছর আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার প্রতিবাদে আমাদের দেশেও ব্যাপক প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে ওঠে। এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার হাটু দিয়ে গলা চেপে নৃশংসভাবে জর্জকে হত্যা করে। সারা বিশ্বের মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। ভারত সহ আমাদের সংস্কৃতির শহর, প্রতিবাদের শহর, সত্যজিৎ, মৃণাল সেন ঋত্বিক ঘটকের শহর কলকাতার ছাত্র-যুবরা রাস্তায় নেমে আসে। দিনের পর দিন আন্দোলন চালিয়ে যায় তাঁরা। বর্ণ বিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গ পুলিশের বিচারের দাবিতে আমেরিকার ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের সমর্থনে ভারতেও বামপন্থী ছাত্রযুবরা সোচ্চার হয়। তাঁরা জাতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিবাদী বিবেকের সঙ্গে সোচ্চারে গলা মেলায়। শাসকের রক্ত চক্ষুকে ভয় না পেয়ে গর্জে উঠেছিল তাঁরা। এটাকেই বলে তারুণ্যের স্পর্ধা।         

২০১১ সালে বামফ্রন্টের পতনের পরে ফের রাজ্যস্তরে সুযোগ আসে। গত বছর আমপান ঝড় এবং করোনা আবহে বামপন্থী ছাত্র-যুবদের আন্তরিক ভূমিকা ইতিহাসে লেখা থাকবে। ২০২০ সালের ৪ নম্বর পার্টি চিঠিতে ব্যাখ্যা করেছিল দেশের সর্ববৃহৎ বামপন্থী দল সিপিআইএম। পার্টি চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, এই দুইটি দিকের (তরুণ ও মহিলা) প্রতি নজর দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুতর ত্রুটি বিরাজ করছে। ৩১ বছর বয়সী পার্টি সদস্যদের শতাংশ হার ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ সালেও ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অথচ এই সময়কালে আন্দোলন-সংগ্রামে এদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। মহিলা ও তরুণ সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি সমগ্র পার্টির কাছে অগ্রাধিকার দাবি করছে।’ ছাত্র ও যুব ফ্রন্টের কাজে যে ভাল সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, সেই বিষয়েও উল্লেখ রয়েছে দলের মূল্যায়ন রিপোর্টে।

ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও ভোগবাদী সমাজ বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়। মানুষকে করে তোলে আত্মকেন্দ্রিক। আজ দেখা যাচ্ছে সমাজ থেকে বৃহত্তর আত্মীয়তা, সামাজিকতা হারিয়ে গেছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ও স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে পারে, সাহস দেখাতে পারে তরুণ প্রজন্ম। সেই স্বাধীনতা আন্দোলের সময় থেকে এটাই বাংলার ঐতিহ্য। আজ একদিকে রাজ্য প্রশাসনে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, অপরদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় আসীন একটি আপাদমস্তক কু সংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্মান্ধ কর্পোরেট পুঁজির সেবাদাস একটি দল। যারা দেশের সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প, ব্যাঙ্ক, সব কিছু অকাতরে বেচে দিচ্ছে পুঁজিপতিদের কাছে। এর বিরুদ্ধে লড়বে কারা?     

সিপিআইএম নামক দলটি ২০২০ সালে সমস্ত ভারতে মনুষ্যত্বের অপমান-লাঞ্চনার কথা ভেবেই সম্ভবত এই মূল্যায়ন করেছিল। যার ফল পাওয়া গেল ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচনে। বামপন্থী ছাত্র-যুবদের একঝাঁক তরুণ মুখ আমাদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে ওরা। বলিষ্ঠ কন্ঠে তথাকথিত ধর্মের নামে ভন্ডামীর বিরুদ্ধে এবং কাটমানি তোলাবাজি, সিণ্ডিকেট ব্যবসা নামক এক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বাংলার মানুষকে ভরসা জোগাচ্ছে। বামপন্থীদের এক ঝাঁক উজ্জ্বল তরুণ মুখ। যারা বর্তমান সময়ে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।

তারা বলছে, আমরা দল বদলের কথা বলছি না। আমরা দিন বদলের কথা বলছি। উচ্চশিক্ষিত, উজ্জ্বল মুখগুলিকে দেখে সারা বাংলার বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষ বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসছে। ‘কালবৈশাখী আহ্বান’ শুনতে পাচ্ছে তাঁরা। নন্দীগ্রামে বামেরা প্রার্থী করেছেন ডিওয়াইএফআই-র রাজ্য সভানেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে মীনাক্ষী ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় বামপন্থী তথা জননেত্রী হিসেবে সামনের সারিতে এসে গেছেন। সিঙ্গুরে প্রাথী করা হয়েছে এসএফআই-র রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্যকে। বালি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন এসএফআই-র সর্বভারতীয় যুগ্ম সম্পাদক দীপ্সিতা ধর। দীপ্সিতার কাছেও প্রত্যাশা অনেক। জেএনইউয়ের ফেলো দীপ্সিতা বহুজাতিক সংস্থার লোভনীয় চাকরি ছেড়ে রাজনীতির প্রধান সড়কে এসে দাঁড়িয়েছেন। মানুষ ভরসা খুঁজে পাচ্ছেন তার কাছে। অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ডঃ শুভম বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সোনারপুর দক্ষিণ কেন্দ্র থেকে। শুভম নভার্টিসের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে এসেছে। কসবায় পরিচিত মুখ যুবনেতা শতরূপ ঘোষ।, ডায়মণ্ডহারবারে প্রার্থী করা হয়েছে, এসএফআই-র রাজ্য সভাপতি প্রতীক উর রহমানকেকামারহাটিতে প্রার্থী হয়েছেন ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র। সায়নদীপও বাম-গণতান্ত্রিক জোটের মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন পরিচিত মুখ। সাংবাদিকতার স্নাতকোত্তর সায়নদীপ যুব সমাজের ভবিষ্যৎ অগ্রদূত হতে পারেনজামুড়িয়ায় প্রাথী হয়েছেন জেএনইউ-র ছাত্রনেত্রী ঐশী ঘোষ। বর্ধমান দক্ষিণের প্রার্থী পৃথা তা। নাটাবাড়িতে আকিকুর হাসান, ঝাড়গ্রামে মধুজা সেন রায়।

সংসদে তাত্বিক গঠনমূলক আলোচনা হোক, এটা চাইতেন পশ্চিমের আলো দেখা উচ্চ শিক্ষিত ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নিজে এবং তিনি ট্রেজারি বেঞ্চের থেকে বিরোধী দলের বেঞ্চের সাংসদদের কাছ থেকে আলোচনা শুনতে বেশি পছন্দ করতেন। পণ্ডিত নেহরু সংসদে বিতর্ক আহ্বান করতেন। বিরোধী সাংসদদের সেই তালিকায় উল্লেখযোগ্য নাম হীরেন মুখোপাধযায়, ভূপেশ গুপ্ত, জ্যোতির্ময় বসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, রেণুকা চক্রবর্তী ইত্যাদি আরও অনেকের নাম বলা যায়। রাজ্য পরিষদীয়স্তরে উজ্জ্বল নাম জ্যোতি বসু। জ্যোতিবাবু নিজেও বিধানসভায় গঠনমূলক সুস্থ বিতর্ক হোক চাইতেন। এই তালিকায় উত্তর নেহরু ভারতীয় সংসদে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নাম আমাদের মনে রাখতে হবে।           

সমাজতত্ববিদরা বলছেন, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে স্থিতাবস্থার পরিবর্তন না হলেও নতুন নেতৃত্বের জন্ম দিতে পারে। সংসদীয় গণতন্ত্রে যে নেতৃত্বের প্রয়োজন অপরিসীম। সংসদে, বিধানসভায় মেধাবী, তাত্বিক, তর্কপ্রিয় নেতাদের স্থান দখল করে রয়েছেন বাহুবলীদের সংগঠিত গোষ্ঠী। তাদের সরাতে উচ্চ শিক্ষিত, সংস্কৃত সম্পন্ন মেধাবী তর্কপ্রিয় তরুণ মুখ সংসদ, বিধানসভায় বর্তমান সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তার কাব্যজিঙ্গাসা কবিতার ষষ্ঠ স্তবকে লিখছেন, ‘আমরা দেব বোবাকে ধ্বনি,/ খোড়াকে দ্রুত ছন্দ/ লক্ষ বুকে রয়েছে খনি, / কুঁড়িতে ঢাকা গন্ধ/ আমরা নই প্রলয় ঝড়ে অন্ধ।’                       

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?