বিজেপির মারীচপত্র-ইস্তেহার
বিজেপির সোনার বাংলার মারীচপত্র-ইস্তেহার
দীপেন্দু চৌধুরী
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
আদর্শ ছেলে, কুসুমকুমারী দাশ
সম্প্রতি একটি বিঞ্জাপন বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি বিভিন্ন সংবাদ পত্রের পাতায়
নজরে পড়ছে। ওই একই বিঞ্জাপণ সোশ্যাল
মিডিয়াতেও দেখা গেল। বিঞ্জাপণে একজন সাধারণ মহিলার ছবি পাশে প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদীর ছবি। ছবি দু’টির উপরে লেখা প্রধানমন্ত্রী আপনাকে ধন্যবাদ। প্রধানমন্ত্রী
আবাস যোজনায় আমি আমার বাড়ির ছাদ পেয়ে গেছি। ‘নিউজলন্ড্রি’ নামে একটি নিউজ
পোর্টালের একজন মহিলা সাংবাদিক বিঞ্জাপণের পত্রিকা হাতে করে সেই মহিলাকে খুঁজে বার
করেছেন। যার ছবি দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়েছে। সাংবাদিকের কাছ
থেকে জানা গেল, মহিলার নাম লছমী। লছমীকে সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘এই ছবি আপনার ?’ লছমী
বেশ গর্বিত মনে হল। কারণ ‘পেপার মে ফোটো’ এসেছে। লছমী সাংবাদিক দিদির প্রশ্নের
উত্তরে বলছেন, ‘আমার ফোটো কখন তুলেছে আমি জানি না। ১৫ ফেব্রুয়ারি আমি বাবুঘাট,
সাগরে সাফাইয়ের কাজ করছিলাম। সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করেন, ‘এই ঘর আপনি
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় পেয়েছেন? এই ইস্তেহারে সেটা লেখা আছে।’
লছমীর কাছে বিষয়টা ভীষণ উপভোগ করার মতো মনে হল। কারণ জুমলা। ঝুট। লছমী
ঠোটে একটা মৃদু হাসি ঝুলিয়ে উত্তর দেয়, ‘না না আমি কোনও ঘর পাই নি। আমি যে ঘরে
থাকি সেটা ভারার ঘর। ঝুপড়ি ঘর। ৫০০ টাকা ভাড়া।’
২১ মার্চ বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিজেপির
ইস্তেহার ‘সোনার বাংলা-সঙ্কল্পপত্র ২০২১’ প্রকাশ করেছেন। গুচ্ছ গুচ্ছ প্রতিশ্রুতির
ফুলঝুরি রয়েছে বিধানসভা নির্বাচনের আগে কলকাতার ইজেডসিসি-তে প্রকাশিত বিজেপির
ইস্তেহারে। ক্ষমতায় এলে বিজেপি ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে কি কি কাজ করবে সেই
ফিরিস্তি। কিন্তু প্রথম থেকেই যে প্রশ্নটা উঠছে, এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করতে
প্রচুর টাকার প্রয়োজন হবে। পশ্চিমবঙ্গের বিদায়ী সরকারের ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’ অবস্থা।
কয়েক লক্ষ কোটি টাকার ঋণের বোঝা নিয়ে চলছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার।
এটা জেনেই ‘বানিয়া’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজেই বলেছেন, ‘’এর পরে
কোনও সাংবাদিক হয়তো জিঞ্জাসা করবেন, এত টাকা কোথায় পাওয়া যাবে? আমি বলছি, আমি
বানিয়া। আমার উপর ভরসা রাখুন। বাজেটের ১৫ শতাংশ টাকাতেই এই সব কাজ হয়ে যাবে।‘’ তিনি
এবং তাঁরা বানিয়াদের দলের সদস্য। সেটা মানুষ জানে। মাত্র কয়েকজন তথাকথিত শিল্পপতি অথবা মদ, সোনা,
রূপো, হিরে জহরতের ব্যবসাদার গত সাত বছরে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্কের লক্ষ
লক্ষ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেশ থেকেই উধাও হয়ে গেলেন। আজও তাঁদের
কেন্দ্রীয় আইন প্রয়োগ করে দেশে ফেরৎ আনতে পারলেন না বানিয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
বিজেপি নামক একটি বানিয়া দলের কেন্দ্রীয় সরকারের আমলে এই ঘটনার সাক্ষী হলাম
আমরা। বিজেপি আমলেই বিদেশ থেকে কালো টাকা ভারতে ফিরিয়ে আনার জন্য বানিয়াদের দল ‘নোটবন্দি’
করেছিল। দেশবাসীর প্রত্যেকের ব্যঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ করে টাকা জমা করা হবে,
বিদেশের কালো টাকা উদ্ধার করে। এটাই ছিল প্রকল্পের উদ্দেশ্য। পরের চেনা-অচেনা
গল্প-উপখ্যান সংবাদ পত্রের পাতায় আমরা দেখেছি। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি বলেছিলেন,
স্যুট-বুটের সরকার কয়েকজন বন্ধু শিল্পপতির সুবিধা করে দেওয়ার জন্য ‘নোটবন্দি’
প্রকল্প এনেছিল। নোটবন্দির জন্য অনেক ক্ষুদ্র, ছোট-মাঝারী শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে।
সঙ্গে আছে মন্দা।
নির্বাচনের প্রচারে ব্যস্ত বানিয়াদের দল বিজেপির নেতৃত্ব। বাংলার সরকার কোন
দলের নেতৃত্বে গঠন হবে সেটা ২ মে রাজ্যবাসী জানতে পারবে। তার আগে সোনার বাংলার
সোনার হরিণ বা ‘মারীচপত্র’-এ প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলি এক ঝলক দেখে নিতে পারি।
পাশাপাশি বিরোধীদের অবস্থানটাও আমাদের জানতে হবে। বিজেপির ইস্তাহারে আছে, সরকারি
চাকরিতে ৩৩ % মহিলা সং রক্ষণ। বিরোধীরা বলছে, বিজেপি শাসিত কোন রাজ্যে মেয়েদের
শিক্ষা ও পরিবহণ
ব্যবস্থা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়? ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ফ্রিতে মেলে? পুরোহিত, কিরত্তনীয়াদের
তিন হাজার টাকা করে কোন বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকার দেয়? মেয়েদের আঠের বছর বয়স হলেই
দু’লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে সোনার বাংলার ইস্তেহারে। এখানেও একই প্রশ্ন ১৭
টি বিজেপি শাসিত রাজ্যে কোথায় এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে? এই ব্যবস্থা কোনও
বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকার করেনি। কেন্দ্রীয় সরকারও এই দায় নিতে আগ্রহী নয়।
কেন্দ্রীয় সরকারে কর্মরত কর্মচারীদের নারী-পুরুষ হার দেখলেই
ছবিটা পরিষ্কার হবে। বিজেপি দলের মহিলা সাংসদ সংখ্যা দেখলেও বিষয়টা বোঝা যায়।
বিজেপি নামক একটি পিতৃতান্ত্রিক দল কতটা মহিলাদের নিয়ে চিন্তিত। বিজেপি শাসিত
উত্তর প্রদেশ সহ কয়েকটি রাজ্যের দিকে তাকালেই বোঝা যায় মহিলা নিগ্রহের ঘটনায়
সামনের সারিতে আছে এ সব রাজ্য। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লাভ জেহাদ আইন। বিরোধী
বাম-কংগ্রেস, তৃণমূলের দাবি বিজেপি নামক একটি দলের এই বিষয়ে প্রতিশ্রুতি মানে
কুম্ভীরাশ্রু ফেলা। ভোট বৈতরণী পার হতে কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ছদ্মরূপ ‘মারীচ’ হয়ে
সোনার হরিণ সাজা।
সকলের জন্য রেশন ব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতি ইস্তেহারে বলা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলছে। কেন্দ্রীয় সরকার রেশন গ্রাহকের সংখ্যা কমানোর
সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। ইস্তেহারে আছে, বিজেপি সরকারে এলে গম ১ টাকা, ডাল ৩০ টাকা,
নুন ৩ টাকা, চিনি ৫ টাকা কেজিতে রেশনে দেওয়া হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে কেন্দ্রে
দু’দফায় প্রায় সাত বছর বিজেপির সরকার আছে। ১৭ টি রাজ্যে বিজেপি সরকার চালাচ্ছে।
কোন রাজ্যে এই ব্যবস্থা চালু আছে? বিস্ময়
জাগে পশ্চিমবঙ্গের জন্য প্রকাশিত ইস্তাহারে যে সব প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে নিজেদের
রাজ্যে চালু করেনি কেন বিজেপি নামক ‘হিন্দুত্ববাদী’ দলটি।
ফসলের দাম নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলার মারীচ
সংকল্প পত্রে। কেন্দ্রীয় সরকার ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা দিতেই রাজি
নয়। যে দাবি নিয়ে দেশের কৃষকরা গত চারমাস ধরে টানা আন্দোলন করছে। ইতিমধ্যে প্রায়
৩০০ জন কৃষক মারা গেছেন। বিরোধীরা এই জন্যই সংকল্প পত্র-কে ‘জুমলা-পত্র’ নামে
অভিহিত করেছে।
রাজ্যের প্রতিটি পরিবারের একজন সদস্যকে বিজেপি সরকার গঠন করলে চাকরি দেবে।
এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। মোদী সরকারের দু’দফায় বেকারীর হার সর্বোচ্চ। তথ্য
বলছে, শুধুমাত্র এক বছরেই ভারতে কাজ খুইয়েছেন ১৩ কোটি মানুষ। অটো ট্যাক্সি চালকদের
৩০০০ এবং ৫০০০ টাকা করে দেওয়া হবে। কতটা ধাপ্পা দেওয়া যায় বা রসিকতা করা যায়
সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে। কর্পোরেটদের স্বার্থে পেট্রোল ডিজেলের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেওয়া
হয়েছে। অথচ পরিবহণ শিল্পে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারই নীরব।
আদিবাসী অঞ্চলে ‘রেগা’ প্রকল্পে কাজের দিন বাড়িয়ে ২০০ দিন করা হবে বলা
হয়েছে। সারা দেশে বিজেপি শাসিত একটি রাজ্যেও এই ব্যবস্থা চালু হয়নি। শরণার্থী
পরিবারগুলিকে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছে। এই প্রতিশুতি কতটা ফাঁপা
সেটা বোঝা যায় উদ্বাস্তু কলোনীর বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললে। তাঁরা জানাচ্ছেন,
উদ্বাস্তু কলোনীগুলির আইনি স্বীকৃতি পড়ে আছে দীর্ঘদিন। পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী
প্যাকেজই দেয়নি কেন্দ্র। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন চালুর কথা বলা হয়েছে সোনার বাংলা
ইস্তেহারে। পশ্চিমবঙ্গে আইন চালু করা হবে। রাজ্যে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে
বিজেপি রাজনীতির শম্বুক গতি দেখে ক্ষুব্ধ অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের নেতৃত্ব। বিজেপি সাংসদ
শান্তনু ঠাকুরের গোঁসা দেখে দলের সর্বভারতীয় নেতারা তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। শান্তনুর
দাবি মেনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঠাকুরনগরে সভা করে গেলেও, নাগরিকত্ব আইন কবে থেকে
রাজ্যে লাগু হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি অমিত শাহ নিজেও। অসমের
ক্ষেত্রে এই আইন চালু করা হয়নি। ভোট ব্যাঙ্ক ধরে রাখতে নাগরিকত্ব আইন নামক গাজর
আবার ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৬০০ কোটি টাকা খরচ করে অসমের জন্য তৈরি এনআরসি বাতিল
করা হয়েছে।
আমাদের রাজ্যে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট তিন রাস্তার মোড়ে এসে থমকে রয়েছে।
বাংলার রাজনৈতিক ত্রাহ স্পর্শ। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং তৃণমূল কংগ্রেস গত দু’টো
দশক রাজ্যের ভোটার নামক নাগরিক পরিসরে এতদিন ছিল। বিজেপি যে শক্তি নিয়ে এই রাজ্যে
ধাবমান সেখানে বাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। গঠন
হয়েছে সংযুক্ত মোর্চা। তাই বিধানসভা নির্বাচনে পৃথক পৃথক দলের পৃথক পৃথক ইস্তেহার
প্রকাশ হয়েছে। কর্মক্ষেত্র, প্রত্যেক নাগরিকের ন্যুনতম মাসিক আয়, রেশন, নারী
কল্যাণ, কৃষক স্বার্থ, অর্থনীতি এবং শিল্প, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, বাসস্থান প্রভৃতি বিষয়ে সব কটি দলের ইস্তেহারে পৃথক
প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে। প্রদেশ কংগ্রেস সম্প্রতি যে ইস্তেহার প্রকাশ করেছেন তাতেও
বিষয়গুলি রয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদেশ সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী মনে করিয়ে দিতে
ভোলেননি যে, কংগ্রেস সরকারই চালু করেছিল সন্তানসভবা মায়েদের ভাতা, বিধবা ভাতা,
রেশন ব্যবস্থা, মিড-ডে মিল, কৃষকদের ন্যুনতম সহায়ক মূল্য এবং ১০০ দিনের কাজের কর্ম
নিশ্চয়তা প্রকল্প।
গরিবদরদী বিজেপি সরকার রান্নার গ্যাস এবং কেরিসিনে ভর্তুকি বন্ধ করে দিয়েছে। রেল, বিমা সংস্থা, ব্যাঙ্ক, বিমানবন্দর সব বেসরকারি হাতে তুলে
দেওয়া হচ্ছে। রাহুল গাঁধি সহ বাম-কংগ্রেস নেতৃত্ব বলছে, ‘হাম দো- হামারা দো’
সরকারের শিল্পপতিরা রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থায় থাবা বসাচ্ছে। সাধারণ মানুষের করের টাকায়
তৈরি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা মোদী সরকারের উদ্যোগে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। সোনার
বাংলা গড়তে সোনার পাথর বাটির গল্প শুনিয়ে বাংলার মানুষকে বোকা বানান কি অত সহজে
সম্ভব হবে?
Comments
Post a Comment