বিজেপিকে আটকাতে আপনারা যাকে মনে করবেন তাঁকে ভোট দেবেনঃ টিকায়েত
দীপেন্দু চৌধুরী
কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে অনড় সংযুক্ত কিসান মোর্চার লড়াই চারমাস
অতিক্রম করেছে। আরও দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন সংযুক্ত কিসান
মোর্চা নেতৃত্ব। আন্দোলন দীর্ঘ হবে সেই কথা মনে রেখে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের
আগে নন্দীগ্রামে সংযুক্ত কিসান মোর্চার সভায় কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেন,
‘আমাদের আনাজ, রুটি সরকারি গোডাউনে বন্ধ করে রাখতে দেব না। কৃষিতে যেমন বড় বড়
ব্যবসায়ীদের আনা হচ্ছে, ঠিক তেমনি সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য বড় বড় ব্যবসাদার বাংলায়
আসছে। কালা আইন বাতিলের দাবিতে সারা দেশে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বিজেপি সরকার
দেশকে অম্বানি-আদানির কাছে বিক্রি করতে চাইছে। যতদিন তিন কালা আইন বাতিল না হবে
কৃষক বাড়ি যাবে না।’ তিনি ১৩ মার্চ নন্দীগ্রাম কৃষক-মজুর মহাপঞ্চায়েতের সভায় আবেদন
করেন, বিজেপিকে একটাও ভোট নয়, বিজেপি হঠাও বাংলা বাঁচাও। নন্দীগ্রামে সভার আগে
কলকাতার মেয়ো রোডে কেন্দ্রীয় কৃষি আইন বিরোধী সভা করেন রাকেশ টিকায়েত।
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে হারাতে কিসান মোর্চার নেতৃত্ব
১২-১৪ মার্চ তিন দিনের বাংলা সফরে এসে প্রচার কর্মসূচীতে অংশ নিলেন। রাজ্যে এসেছিলেন
হান্নান মোল্লা, রাকেশ টিকায়েত, বলবীর সিংহ রাজেওয়াল, যোগেন্দ্র যাদব, গুরনাম সিং
চাড়নি, দর্শন পাল, রাজারাম সিং, জুধবীর সিং, সংবীর সিং (হরিয়ানা)। ১২ মার্চ
কলকাতা প্রেসক্লাবে কিসান মোর্চা নেতৃত্ব আবেদন করেন, কেন্দ্রে জন-বিরোধী ও
ফ্যাসিবাদী সরকার চালাচ্ছে যে বিজেপি, তাদের যেন বাংলার মানুষ ভোট না দেন। বিজেপি
ছাড়া পরিস্থিতি বিচারে অন্য যে কোনও দলকে সমর্থন করার আবেদন করেছেন সেদিন
প্রেসক্লাবে উপস্থিত কৃষক নেতৃত্ব। একান্ত সাক্ষাৎকারে যোগেন্দ্র যাদবের কাছে
প্রশ্ন ছিল, বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার আবেদন নিয়ে সিঙ্গুর-নদীগ্রামে প্রচারে
যাওয়ার মানে দাঁড়ায়, পরোক্ষে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে বার্তা দেওয়া। উত্তরে
যোগেন্দ্র বলেন, আমাদের সফরসূচী কিসান মোর্চার স্থানীয় নেতৃত্ব ঠিক করেছেন। বোঝাই
গেল তিনি কৌশলে জবাব এড়িয়ে গেলেন।
বিধানসভা ভোটকে সামনে রেখে পাঁচ রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন
করার কথা আগেই ঘোষণা করেছেন সংযুক্ত কৃষক মোর্চা নেতৃত্ব। যাদের নেতৃত্বে দিল্লিতে
কৃষক আন্দোলন চলছে। সেই কর্মসূচীর অন্যতম রাজ্য হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। কলকাতায় এসে
হান্নান মোল্লা, যোগেন্দ্র যাদব, বলবীর সিংহ রাজেওয়ালেরা ১২ মার্চ কলকাতা
প্রেসক্লাবে বক্তব্য রাখেন। সঙ্গে ছিলেন মেধা পাটকর। কৃষক নেতৃত্ব বলেন, ‘’কৃষিকে
কর্পোরেটের হাতে তুলে দিচ্ছে বিজেপি সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাকে বেচে দিচ্ছে।
আন্দোলনকারীদের উপরে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ চলছে। এই বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার
আবেদন জানাচ্ছি।‘’ প্রশ্ন ছিল বিজেপিকে না দিয়ে তাঁরা কাকে ভোট দিতে বলছেন?
যোগেন্দ্র যাদব, মেধা পাটকর উত্তরে জানান, ‘’বিজেপি বাদ দিয়ে মানুষের যাকে পছন্দ,
তাকেই ভোট দেবেন।‘’ একই ভাবে এন্টালির রামলীলা ময়দানে ‘কিসান ও মজুর
মহাপঞ্চায়েত’ সভাতেও কৃষক নেতৃত্ব বিজেপির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। নন্দীগ্রামের কৃষক
মহাপঞ্চায়েতে রাকেশ টিকায়েত বলেন, ‘’দুধের উপর বিল আসছে। গোয়ালারা আর দুধ বিক্রি করতে পারবে না। সব বড় বড় ব্যবসায়ী কিনে
নেবে। মুনাফা ওঁদের ঘরে যাবে। ২০২২ সালে রেলে সাড়ে চার লাখ কর্মচারি কাজ হারাবে।
কেন্দ্রের বেসরকারিকরণ নীতির জন্য। ৪০ টি নতুন বিল আসছে।‘’
১৪ মার্চ সংযুক্ত কিসান মোর্চার সভা ছিল সিঙ্গুর এবং আসানসোলে। সিঙ্গুরের
কৃষি জমি রক্ষা আন্দোলনের কথা মনে রেখে সিঙ্গুরের সভায় মেধা পটকর উল্লেখ করেন,
রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের নাম। তিনি বলেন, ‘’যে রবীন্দ্রনাথবাবু সিঙ্গুর
আন্দোলনের জনতার সঙ্গে ছিলেন তিনিও এখন
হিন্দু-মুসলিম ভাগাভাগিতে থাকবেন। এখন তাহলে কি তিনি জমি রক্ষার বিরুদ্ধে হয়ে
গেলেন?’’ ওই দিন আসানসোলের সভায় যেমন রাজ্যের বিদায়ীমন্ত্রী মলয় ঘটককে মোর্চা
নেতৃত্বের সঙ্গে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ করতে দেখা গেছে। ঠিক একইরকমভাবে সিঙ্গুরের সভায়
হাজির ছিলেন সিঙ্গুর কৃষি জমি রক্ষা কমিটির আহবায়ক তথা সিঙ্গুর বিধানসভা কেন্দ্রের
প্রার্থী বেচারাম মান্না। এই দুটি সভায় তৃণমূল রাজ্য নেতৃত্বের উপস্থিতি দেখে
রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ওঠে, তাহলে কি পরোক্ষে রাজ্যে তৃণমূলকেই ভোট দেওয়ার আবেদন
করছেন সংযুক্ত কিসান মোর্চা? এই জল্পনার অবসান ঘটাতে মুখ খোলেন মোর্চা নেতা
তেজেন্দার সিংহ। তিনি বলেন, ‘’আমাদের সংগঠনটি অরাজনৈতিক। সারা দেশে কোথাও আমাদের
সভায় রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত কাউকেই মঞ্চে তোলা হয়নি। এ রাজ্যে বিজেপি জিতলে
গোটা দেশে দ্রুততার সঙ্গে কৃষি আইন বলবৎ করবে কেন্দ্র। তাই এখানে বিজেপিকে
হারানোটা দরকার।‘’
টানা চারমাস ধরে কৃষকদের অনড় আন্দোলনের ধৈর্য দেখে বিজেপির কেন্দ্রীয়
নেতৃত্ব নড়েচড়ে বসেছে। দলের অন্দরের খবর, কৃষক আন্দোলনের কারণে বিজেপির গ্রামীণ
ভোট ব্যাঙ্কে বিরাট ভাঙন ধরতে চলেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি গ্রামীণ
ভোট যত শতাংশ পেয়েছিল সেটা কতটা যন্ত্রের সাহায্যে পাওয়া, সেটা যেমন দলীয় নেতৃত্ব
ভাবছে, পাশাপাশি লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোট কি স্থায়ী হবে এটাও চিন্তায় রেখেছে
রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বকে। এমতবস্থায় দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠছে, কৃষক
আন্দোলনের নেতৃত্ব রাজ্যের সব কটি জেলা ধরে ধরে কৃষিভিত্তি আছে, এমন সব অঞ্চলে বিজেপিকে
ভোট না দেওয়ার আবেদন করতে পারে। এটা বাস্তবে হলে বিজেপি দল বিরাট ক্ষতির মুখে পড়তে
পারে। বিজেপি দলের নির্বাচন সমীক্ষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী অমিত শাহকে জানিয়েছেন,
রাকেশ টিকায়েতের টিমের প্রচার আটকাতে না পারলে বিজেপির আসন ৩০ এ নেমে আসতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আরও ব্যাখ্যা, কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বের বিজেপিকে ভোট
না দেওয়ার আহ্বান এবং একই ভাবে এনআরসি বিরোধী আন্দোলন বিজেপির পক্ষে উত্তরবঙ্গে
কঠিন লড়াই হতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র চারমাস আগে বিজেপিতে যোগ
দিয়েছেন। তাঁর আশঙ্কা, কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আটকাতে
না পারলে, এবারের নির্বাচনে আবারও ক্ষমতার মাখন খেয়ে নেবে তৃণমূল। বিজেপির শীর্ষ
নেতৃত্বের কাছে তিনি আবেদন করেছেন, শুধু হিন্দু ভোটের উপর নির্ভর করে কিছু হবে না।
কারণ বিজেপির ‘হিন্দুত্ব’ ভোটের মেরুকরণ
রাজনীতির অবসান হয়েছে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেই। এ বছর থেকে বিজেপির ‘হিন্দু’
ভোট কমার পালা। অতীতে ‘সফট হিন্দু ভোট’ বলতে যা বোঝায় সেগুলো তৃণমূল থেকে বিজেপিতে
গিয়েছিল। এই বছরের বিধানসভা নির্বাচনে সেই ভোট তৃণমূলে ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা
দিয়েছে। এটার অন্যতম কারণ বামফ্রন্ট। বামেরা বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কংগ্রেস
এবং আইএসএফের সঙ্গে ‘সংযুক্ত মোর্চা’ নামে জোট করে।
সদ্য গড়ে ওঠা নতুন এই জোট বিজেপির কাছে অত্যন্ত অপরিচিত এক রাজনৈতিক কৌশল।
বিজেপি রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। ‘হিন্দু কার্ড’ খেলতে না পারলে বিজেপির লড়াই আরও
কঠিন হয়ে উঠবে। তাই দলের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের উপদেশ শুনে সহজ রাস্তা বেছে নেওয়া
হয়েছে, প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে কৃষক
আন্দোলনের নেতৃত্বের সফরের খবর আটকানো। দলের অন্দরের খবর, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের
তরফে সেই মোতাবেক নির্দেশ গেছে, সংবাদ সংস্থাগুলির পরিচালকমণ্ডলীর কাছে। কৃষক
নেতৃত্বের সফরের খবর করলে ভবিষ্যতে তাঁদের সমস্যায় পড়তে হতে পারে। মোদীর নেতৃত্বে
কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কৃষক আন্দোলন আরও শিরঃপীড়ার কারণ কৃষকদের দীর্ঘস্থায়ী
আন্দোলনের প্রস্তুতি।
আন্দোলন যে দীর্ঘদিন ধরে চলবে এটা বুঝেই দিল্লির সীমানায় ঘর তৈরি শুরু
করেছেন কৃষকরা। হাড় কাঁপানো কন কনে শীতে ট্র্যাক্টরের মাথায় ত্রিপল চাপিয়ে
আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন আন্দোলনরত কৃষকরা। আসন্ন গ্রীষ্মে উত্তর ভারতের গরম থেকে
বাঁচতে দিল্লি সীমান্তে টিকরি, সিংঘু-তে বিভিন্ন জায়গায় ইটের পাকা ঘর তৈরি করা
হচ্ছে। দিল্লি সহ উত্তর ভারতের তীব্র গরমের কথা ভারতবাসীর জানা আছে। সেই কথা মাথায়
রেখেই এই ঘরের পরিকল্পনা। সংযুক্ত কৃষক মোর্চা নেতৃত্বের বক্তব্য, তাঁদের অভিযোগ,
এই অস্থায়ী পাকা ঘর তৈরিতে বিজেপি সরকারের পুলিশ-প্রশাসন বিভিন্ন কৌশলে বাধা
দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আটকাতে পারেনি। তাই আমাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা
দায়ের করেছে। আমরা ভয় পাই না। আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে চলবে তাই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা
হচ্ছে।
Comments
Post a Comment