অক্টোবর-নভেম্বর মাস পর্যন্ত আমরাও বসে থাকব। গ্রীষ্মবর্ষায় টানা আন্দোলন চলবেঃ রাকেশ টিকায়েত








 

দীপেন্দু চৌধুরী

সারা ভারত হাড় কাঁপুনি ঠাণ্ডায় কাঁপছে? কৃষক মহা পঞ্চায়েতের পর কৃষকের গর্জনে নতুন করে কাঁপছে দিল্লির গাজিপুর সীমান্ত। এই লেখা যখন লিখতে বসেছি সেদিন ছিল পয়লা ফেব্রুয়ারি। ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখলাম। জয় কিসান আন্দোলনের নেতা যোগেন্দ্র যাদবের। তিনি লিখছেন, ১ ফেব্রুয়ারি সকালে রোহতক গামী ফিরোজপুর মুম্বাই পঞ্জাব মেল ঘুরিয়ে দেওয়া হয় বেওয়ারির দিকে। যাতে ১০০০ কৃষক দিল্লি পৌঁছতে না পারে। ২ ফেব্রুয়ারি এনডিটিভি ইন্ডিয়ায় দেখলাম দিল্লি-গাজিপুর সীমানা ‘সিল’ করে দিয়েছে পুলিশএই সময় কেউ মনে করলে বাংলাদেশ বা পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে বৈধ কাগজ নিয়ে যাতায়াত করতে পারবে। কিন্তু গাজিয়াবাদ যাওয়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ। আন্দোলনের রাশ নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ রেল গার্ড দিয়ে অস্থায়ীভাবে রাস্তা বন্ধ রাখে সেই ব্যবস্থা যেমন আছে পাশাপাশি লোহার রেল গার্ডের উপরে দুটো স্তরে তার কাঁটার বেড়া চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমনটা প্রতিবেশি দেশের সীমানায় থাকে। গাজিপুর সীমানায় এবং কোথাও কোথাও সিমেন্টের কংক্রীট দেওয়াল তোলা হয়েছে। লোহার বিশাল ব্যারিকেড দিয়ে গড়ে তোলা দুর্ভেদ্য প্রাচীর। ভিন রাজ্যের কৃষকরা যাতে ধর্নাস্থলে ঢুকতে না পারে।  

গাজীয়াবাদ যাওয়ার জন্য গাজিপুরের স্থানীয় মানুষ প্রতিদিন পাকা রাস্তা ব্যবহার করে না। দূরত্ব কম হওয়ার সুবিধার জন্য অন্য একটি বিকল্প কাঁচা রাস্তা ব্যবহার করে থাকে। দিল্লি পুলিশ সেই রাস্তাও বন্ধ করে দিয়েছে। গাজিপুর সীমান্তের বিভিন্ন দিকে আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা পাহারায় রয়েছে। একটা মাছিও সীমান্ত টপকে দিল্লির দিকে যেতে পারবে না। কৃষকদের আন্দোলন ঠেকাতে সব রকমের ব্যবস্থা করছে সরকার। আড়াইশো টুইটার অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হয়েছে। দিল্লির তিন প্রতিবাদ স্থলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখার মেয়াদ আরও বাড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। অথচ বাজেট পেশ করার পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলছেন, ‘এই বাজেটের কেন্দ্রে রয়েছে গ্রাম এবং কৃষক’।      

কৃষকদের পরবর্তী কর্মসূচী ছিল সংসদ অভিযান। সেই কর্মসূচী কৃষক নেতৃত্ব স্থগিত রেখেছে অহিংস আন্দোলনের সমর্থনেলালকেল্লায় অপ্রত্যাশিত ঘটনার পরে তিন কৃষি বিল প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষকদের আন্দোলন ব্যাকফুটে চলে যায়। এমনটা ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু  ২৬ জানুয়ারি পরে দিল্লির মুহ্যমান কৃষকদের আন্দোলনে আবার নতুন করে কৃষকরা আসছেন কেন? ২৬ জানুয়ারির লাল কেল্লার অবাঞ্ছিত ঘটনার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তের ছবিটা আবার বদলাতে শুরু করেছে। সাধারণতন্ত্র দিবসের দিন রাতে কৃষক আন্দোলন ‘দুর্বল’ হয়ে যাচ্ছে এমনটা অনেকেই মনে করেছিল। কিন্তু বাস্তবে অন্য ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েতের নেতৃত্বে তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকরা আরও বেশি সংখ্যায় জড়ো হচ্ছেন। দিল্লির সীমানায় পুলিশ, বিজেপি এবং আরএসএসের হুমকিতে রাকেশ টিকায়েত কেঁদে ফেলেছিলেন। তার পরেই মিছিলের অভিমুখ আবার দিল্লির পথে।

উত্তরপ্রদেশের মুজফফর নগরে কৃষকদের মহাপঞ্চায়েতের পরে কাতারে কাতারে মানুষ আসছে। গাজিপুর সীমানায় দিল্লি-মেরঠ জাতীয় সড়কের উপরে প্রতিবাদী কৃষক ও গ্রামবাসীরা কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে জড়ো হচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশ থেকে যেমন মানুষ আসছেন, আবার হরিয়ানার জিন্দ, রোহতক, হিসার, ভিওয়ানি, সোনিপতের কৃষকরা এসে পৌচেছেন। রাষ্ট্রীয় লোক দলের নেতা জয়ন্ত চৌধুরী কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে ধর্নাস্থলে রাকেশ টিকায়েতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সমাজবাদী পার্টির একজন প্রতিনিধি ঘুরে গেছেন। আপ দলের সাংসদ সঞ্জয় সিংহ এবং দিল্লির উপ-মুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসোদীয়া গাজিয়াবাদে পৌঁছে কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। শিবসেনা সাংসদ সঞ্জয় রাউত গাজিপুর সীমান্তে গিয়ে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে দাড়িয়েছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধিও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের এক ইঞ্চি জমি না ছাড়তে অনুরোধ করেছেন।   

২ ফেব্রুয়ারি কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেন, ‘’সরকার ভয় পাচ্ছে। আমদের ঘিরে রাখছে গাজিপুর সীমান্তকে দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে। আসলে আমাদের ঘিরে রাখছে এটা ঠিক নয়, সরকার ভয় পাচ্ছে। কৃষকরা যদি দিল্লি ঢুকে যায়। আমরা দিল্লি ঢুকব না। অক্টোবর- নভেম্বর মাস পর্যন্ত আমরা বসে থাকব। গ্রীষ্ম-বর্ষায় টানা আন্দোলন চলবে।‘’ এই ঘটনায়, বাজেট অধিবেশনের শুরুতেই সরকারের রাতের ঘুম ছুটেছে সম্ভবত।

২৬ জানুয়ারি সরকারের কাছে অনুমতি নিয়ে ট্র্যাক্টর মিছিল করেছে কৃষক নেতৃত্ব।  জাতীয়তাবাদের স্লোগান লেখা, ভগত সিংহ, গাঁধিজি, নেতাজির ছবি লাগিয়ে কৃষকরা ট্র্যাক্টর মিছিল করে। তবু বহু খবর মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমে কভার করা হয়নি। কৃষকদের অভিযোগ, ‘গোদী মিডিয়া’ নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই সেদিনের কৃষকদের বর্ণাঢ্য মিছিলের জাতীয়তাবাদী অংশ বাদ দিয়ে টিভিতে সম্প্রচার করেছে বিভিন্ন টিভি সংস্থাবর্তমান সময়ের গতিশীল ‘সোশ্যাল মিডিয়া’-র যুগে প্রকৃত খবর আড়াল করা সম্ভব নয়, সেটা হয় ‘গোদী মিডিয়া’ ভুলে গেছে অথবা সাময়িকভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেএই বক্তব্য আমি বলছি না। বলছেন, ম্যাগসাইসাই পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক রবীশ কুমার। তাঁর বক্তব্য, ইউটিউবের মাধ্যমে বিভিন্ন স্বাধীন নিউজ পোর্টালে আমরা এই সব খবর পেয়ে যাচ্ছি।

২৮ জানুয়ারি থেকে কৃষকদের নতুন করে শক্তিবৃদ্ধি সরকারের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মনোবল আরও বাড়িয়ে নতুন ভাষায় সমর্থনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ গাজিপুর সীমানায়। কেন্দ্র ভেবেছিল কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলে কৃষক আন্দোলন ‘দুর্বল’ হয়ে পড়বে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছবিটা বদলে গেল কৃষকদের অভিযোগ, ২৮ জানুয়ারি সিংঘু সীমানা, গাজিপুর সীমানা এবং হরিয়ানার বিভিন্ন প্রান্তে পথে নেমেছিল বিজেপির নেতা কর্মী সমর্থকরা। স্থানীয় গ্রামবাসীদের একটা অংশকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা হুমকি দিতে থাকে আন্দোলন তুলে নেওয়ার জন্য। কৃষকদের সঙ্গে বিজেপির কর্মীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ বেঁধে যায়। বিক্ষোভকারীদের আটকাতে লাঠি চালায় পুলিশ। ছোড়া হয় কাঁদানে গ্যাসের শেল। প্রায় মিনিট কুড়ি ধরে রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল সিংঘু সীমানা। একজন  পুলিশের ছবি সংবাদ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেই পুলিশকর্মী এক কৃষকের মুখের উপর বুট দিয়ে চেপে ধরেছে। একটি টিভি চ্যানেলে দেখা গেল যোগেন্দ্র যাদবের বাড়ির সামনে কয়কেজন রাস্তায় যোগেন্দ্র যাদবের ছবি ফেলে পা দিয়ে ঘসছে। আর স্লোগান দিচ্ছে ‘দিল্লিকো গদ্দারোকো গোলি মারো’।

যোগেন্দ্র যাদব ২৯ জানুয়ারি বলছেন, গাজিপুর, সিংঘু সীমানায় পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কথা আমরা আগেই বলেছিলাম। বিজেপির একজন এমএলএ ছিল সমর্থকদের নিয়ে। আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণ করা হয়। যোগেন্দ্র যাদব আরও বলেন, ‘’ধর্মের নামে বিজেপি দেশকে ভাগ করতে চাইছে। কৃষক ঐক্য ভাঙতে চাইছে। আমরা সেটা করতে দেব না। গাঁধিজি দেশের ঐক্যের জন্য জীবন দিয়েছেন। আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার।‘’   

এনডিটিভি ইন্ডিয়ায় দেখা গেল, গাজিয়াবাদের বিজেপি বিধায়ক নন্দকিশোর গুর্জর বলছেন, ‘’আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি দিয়েছিভারতীয় প্রজাতন্ত্রের দিন দেশের গর্ব করার মতো প্রতীক লালকেল্লার অপমান করার জন্য ফার্স্ট ট্র্যাক আদালতে তুলে আইনি ব্যবস্থায় ফাঁসি দেওয়া হোক, দেশদ্রোহী কৃষক নেতাদের রাকেশ টিকায়েত, যোগেন্দ্র যাদব, দর্শন পাল সহ আরও কয়েকজনকে গুলি করে মেরে দেওয়া উচিত। এরা আতঙ্কবাদী। অমিত শাহ আমাকে হুকুম দিলে আমার লোকদের নিয়ে এদের জুতোপেটা করে ভাগিয়ে দেব‘’ নন্দকিশোর একই বক্তব্য টুইটও করেছেন।

সংবাদ মাধ্যমের একাংশের বক্তব্য, বিজেপি বিধায়ক নন্দকিশোরদের নামে কোনও অভিযোগ হয় না। অথচ বরিষ্ঠ সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই, মৃণাল পান্ডে, জাফর আগা সহ ছ’জন সাংবাদিকের নামে এফআইআরের পাশাপাশি দেশদ্রোহের মামলাও হয়েছে।  এই সব সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে এডিটর্স গিল্ড। এবং কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি। পরে মনদীপ পুনিয়ার নামে একজন সাংবাদিককে গ্রেফতার করে তিহার জেলে পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে সাংবাদিক রবীশ কুমার টুইট করেছেন, ‘No prison is big enough to contain free speach.’ ‘কোনও কারাগারই বড় হতে পারে না স্বাধীন বক্তব্যের কাছে’মনদীপ পুনিয়ার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়েছে, কংগ্রেস-সিপিএম দলও।

সংসদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে ‘কিসান কি মৌত, কালা কানুন বাপস লো’, ‘ম্যায় কিসান, ম্যায় খেত মজদুর হুঁ, মুঝ সে ধোকা মত করো’। কালো জামা পড়ে বুকে প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে কংগ্রেস সাংসদরা বিক্ষোভ দেখায়। এই প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা এবং সাংসদ রাহুল গাঁধিও      

পঞ্জাব সরকার কৃষকদের আইনি সাহায্যের জন্য ৭০জন আইনজীবীর একটি টিম তৈরি করেছে। গত ৭০ দিন কৃষক আন্দোলনে দিল্লি পুলিশ যাদের গ্রেফতার করেছে বা আটক করে রেখেছে তাঁদের সব রকমের আইনি সাহায্য করবে পঞ্জাব সরকারের গড়ে দেওয়া এই আইনজীবীর দল। এ ছাড়া আন্দলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা যে সব ব্যক্তিরা নিখোঁজ হয়েছেন তাঁদের খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে এই দল। পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহ ২ ফেব্রুয়ারি এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, তিনি নিজে বিষয়টি দেখবেন। বিশেষত যে সব আন্দোলনকারী কৃষকদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁদের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলবেন পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি এই বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ওই সব ব্যক্তি যাতে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করবে তাঁর সরকার। সহযোগিতা নেওয়ার জন্য পঞ্জাব  সরকারের ১১২ টোল ফ্রি নাম্বারে ফোন করতে পারেন যে কেউ।   

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?