কৃষক আন্দোলনের নব জাতক ‘ট্রলি টাইমস’




 

দীপেন্দু চৌধুরী

বহুবার উচ্চারিত, আলোচিত, তবু আবার নতুন করে বলতে হয়, সংবাদমাধ্যম হচ্ছে, সমাজের অভিভাবক।  সংবাদ মাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তিগত জীবনের উর্ধে উঠে দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশন করা। এই মাধ্যমের একজন সম্পাদক, সাংবাদিক, চিত্র সাংবাদিক, ডেস্কের কর্মী এবং কতৃপক্ষ সকলকেই দায়িত্ব নিতে হয়, সমাজের ঘটমান অনিয়মগুলি নিজেদের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করার। বলতে হবে সমাজের দায়বদ্ধতার কথা।

হিকির গেজেট প্রকাশের পরে এতগুলি বছর আমরা চর্চিত ঞ্জানের আলোয় নিজেদের সমৃদ্ধ করেছি। সংবাদ মাধ্যম আধুনিক থেকে আধুনিকতর হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের ভাষায় পরিবর্তন এসেছে। পরিবেশনের গভীরতায় পরিবর্তন লক্ষণীয়ভাবে বদলে গেছে। আফিসের আঙ্গিকে নতুনত্ব এসেছে। ছোট পরিসরের অফিস থেকেই সংবাদপত্র প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে। ডিজিটাল শব্দ, অক্ষর, ছবির গতিশীলতায় উত্তর আধুনিকতার ছাপ। কিন্তু একুশ শতাব্দীর উত্তর আধুনিক সভ্যতায় প্রশ্ন উঠছে, সংবাদ মাধ্যম কতটা স্বাধীন? কতটা নিরপেক্ষ?

ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ স্তম্ভ নিজেদের দায়িত্ব কতটা পালন করছে? সংগঠিত সংবাদ মাধ্যম সংস্থা, যাদের কর্পোরেট বা বহুজাতিক সংস্থাও বলা যেতে পারে। তাঁরা আজ নিজেদের দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছে বলে মনে হয়। বহুল প্রচারিত যে কোনও ভাষার দৈনিক সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেলে দেখা যাবে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের খবরের রমরমা। রাজনৈতিক দলাদলি, হিংসা-বিদ্বেষ নিয়ে খবর করতে বিশেষভাবে উৎসাহী তাঁরা উন্নয়ন প্রকল্পের খবরের সঙ্গে কারও বিরোধ করার কথা নয়। কেউ বিরোধ করছেও না। কিন্তু সংবাদ মাধ্যম থেকে ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে, বেকারত্ব, অনাহার, অপুষ্টি, দারিদ্র, শিশুমৃত্যু, নারীদের সমস্যা, মানব পাচার, কৃষকদের দুর্দশা,  পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি বিষয়ক খবর। সংবাদ মাধ্যম কি এই সব দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে?

প্রশ্নটা আবার আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল, কেন্দ্রের আনা তিন কৃষি বিলের বিরুদ্ধে দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে ৪০টি কৃষক সংগঠনের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। অভিযোগ উঠে আসছে, কৃষক আন্দোলনের সব খবর দেশের মূল ধারা তথা ‘মেন স্ট্রীম’ সংবাদ মাধ্যম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে না। সরকারের পক্ষে যতটা খবর করা হচ্ছে, সেই তুলনায় আন্দোলনকারীদের জন্য বরাদ্দ থাকছে অনেক অনেক কম কলামের খবর। বা টিভিতে অনেক কম সময়ের ফুটেজবর্তমান সময়ে সারা দেশে সংবাদ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ‘গোদী মিডিয়া’। গোদী মিডিয়া গোষ্ঠীভুক্ত সংবাদ মাধ্যম কেন্দ্রের বা রাজ্যের বিজেপি সরকার বিরোধী খবরের ক্ষেত্রে উপেক্ষার নীতি অবলম্বন করে চলছে। স্বরাজ ইন্ডিয়ার প্রধান যোগেন্দ্র যাদব বলছেন, ‘সরকার ‘মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট’ করছে। ৮ ডিসেম্বর ছিল বিরোধী দলগুলির ডাকা ভারত বনধ। সেদিনের বনধে সারা দেশ জুড়ে ব্যপক সাড়া পাওয়া গেলেও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম সে ভাবে খবর করেনি। সেদিন অমিত শাহ কয়েকজন কৃষক নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেই খবর টিভিতে সারাদিন দেখানো হয়েছে। পরেরদিন প্রভাতি দৈনিকেও সেই খবর বড় করে ছাপা হয়েছে। ভারত বনধের খবর সেখানে গৌণ হয়ে গিয়েছিল। এটাই হচ্ছে মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট। কেন্দ্রীয় সরকার এই ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করছে।’   

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমিত ভাদুড়ি ‘সপ্তাহ’ পত্রিকার ৮ জানুয়ারি সংখ্যায় লিখেছেন, ‘’............... সাধারণ মানুষ এসব দেখে শুনে প্রাচীন স্বর্ণযুগের কল্পনার সঙ্গে ধর্ম নামক আফিমের মিশ্রনের মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েশুরু হয় ফ্যাসীবাদী আদর্শের জয়যাত্রা। এই আদর্শ লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আধুনিক গণমাধ্যমগুলি এক বিরাট ভূমিকা নেয়। একদিকে ভুঁয়ো খবর তৈরি করা হয়, অন্যদিকে খবরকে ঝাড়াই বাছাই করে ও দরকার মত কেটে ছেঁটে বদলিয়ে দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ ছড়ানোর কাজ অবাধে চলে। যে খবরে জাতীয়তাবাদের উগ্রতা কমে যায়, যেমন বেকারত্ব, কৃষকের দুর্দশা, ধর্মের ভিত্তিতে হত্যা, দলিত মেয়েদের ধর্ষণ ইত্যাদিকে যথাসম্ভব আড়ালে রাখা হয়, যেন সেগুলি তুচ্ছ খবর।‘’         

এই পরিস্থিতিতে দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে আন্দোলনরত কৃষকরা নিজেদের সংবাদপত্র প্রকাশ করল। নাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্রলি টাইমস’। প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হয় ১৮ ডিসেম্বর, তিন কৃষি আইন বিরোধী কৃষকদের আন্দোলনের ২৩ দিনের দিন। প্রকাশের প্রথম দিন ২০০০ কৃষককে বিনামূল্যে পত্রিকা দেওয়া হয়। চারপাতার ‘ট্রলি টাইমস’ শুরুতে ‘গুরুমুখী’ (পঞ্জাবী) এবং হিন্দি ভাষায় প্রকাশ করা হয়। পরে ইংরেজি ভাষাতেও প্রকাশ হচ্ছেউদ্যোক্তারা এমনটা জানাচ্ছেন। ইংরেজি সংস্করণের প্রথম পাতায় শহীদ ভগৎ সিংহের উদ্ধৃতি লেখা হয়েছে, ‘’The sword of revolution is sharpened on the whetstone of ideas.’’ আমরা জানি ভগৎ সিংহ বলে গেছেন, পিস্তল, বোমা বিপ্লব আনতে পারে না। ইনকিলাব আনতে পারে মানুষের আন্দোলন। গুরুমুখী এবং পঞ্জাবী সংস্করণের প্রথম পাতায় লেখা আছে, ‘জুড়েঙ্গে, লড়েঙ্গে, জীতেঙ্গে’। চার পাতার পত্রিকা প্রকাশে খরচ পড়ছে পাঁচ টাকা।

বীর সিংহের সঙ্গে আরও ৬০ জন মিলে এই পত্রিকা প্রকাশ করছেন। ট্রলি টাইমাস পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী জানাচ্ছেন, ‘ট্রলি টাইমস’ সংযুক্ত কিসান মোর্চার মুখপত্র নয়। এক ছাতার তলায় যে ৪০-৪৫টা কৃষক সংগঠন একত্রিত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে থেকেই স্বেচ্ছাসেবকরা এই পত্রিকা প্রকাশ করছে। ট্রলি টাইমস প্রকাশ করছেন সমাজকর্মীদের একটি দল। সেখানে কয়েকজন সাংবাদিকও আছেনযারা স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করেন। সিনেমার চিত্র নাট্যকার আছেন একজন। একজন ভিডিও পরিচালক, দু’জন তথ্যচিত্রের সঙ্গে যুক্ত এমন চিত্র শিল্পী আছেন সম্পাদকমণ্ডলীতে।      

ম্যাগসাইসাই পুরষ্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক রবীশ কুমার বলছেন, ‘ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ‘ট্রলি টাইমস’ প্রকাশ। ভারতীয় মিডিয়া সরকারকে বেছে নিয়েছে। কৃষক আন্দোলন মানুষের কাছে পৌঁছতে বেছে নিয়েছে কৃষকদের জন্য সংবাদপত্র। ভবিষ্যতে ভারতে এই ঘটনা আরও দেখা যাবে। সরকার মানুষের কথা না শুনতে চাইলে। সরকার প্রভাবিত সংবাদ মাধ্যম মানুষের খবর না করলে মানুষ নিজেদের খবর আম জনতার কাছে পৌঁছে দিতে সংবাদপত্র প্রকাশ করবে।’               

ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবন্ধকতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেই আলোচনা আমরা করলাম। মনে পড়ছে উনবিংশ শতাব্দীর কথা। ‘তত্ববোধিনী’ পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৮৪৩ সালের ১৬ অগস্ট। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ দশজন উজ্জ্বল যুবনায়ক এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তৎকালের জ্বলন্ত সামাজিক সমস্যা বাল্য বিবাহ, বিধবা বিবাহ সহ একাধিক সামাজিক খবর করেছে ‘তত্ববোধিনী’ পত্রিকা। সময়ে সময়ে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধেও পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী গর্জে উঠেছে।

পশ্চিমের সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যমের প্রতি তুলনায় দেখব, আমাদের দেশের গোদী মিডিয়া নিজের স্বত্বা হয় বিক্রি করে দিয়েছে। না হলে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীন আদর্শ এবং স্বত্বার কথা ভুলে গিয়ে অর্থের বিনিময়ে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। নির্ভীক, নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যমের অস্তিত্ব অস্বীকার করে।   আমেরিকার বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন দেশের সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু  সম্প্রতি আমেরিকার ক্যাপিটল ভবন আক্রমণের  ঘটনায় মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ট্রাম্পকে রেয়াত করেনি। দেশের বৃহত্তম গণতন্ত্রকে সম্মান জানিয়েই প্রায় সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে এই খবর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। বৈদ্যুতিন মাধ্যমেও গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ হিসেবেই খবর দেখিয়েছে। আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে পশ্চিমের সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা বিষয়ে তুল্যমূল্য আলোচনা করলে ‘গোদী মিডিয়া’-র আত্মসমর্পণের কথা প্রমাণ হয়ে যায়।

ইতিহাস প্রমাণ করেছে, আন্দোলন সংবাদ পত্রের জন্ম দেয়। ভারতের একাধিক ভাষায় প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমের গৌরবময় ইতিহাস আছে। প্রাক স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে কংগ্রেস এবং বামপন্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলন যেমন হয়েছে, পাশাপাশি নতুন নতুন পত্রিকার আবির্ভাবও হয়েছে। সাংবাদিক রবীশ কুমারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমাদের বলতে হচ্ছে, ‘ট্রলি টাইমস’ আমাদের নতুন করে পথ দেখাচ্ছে। নির্ভীক কণ্ঠস্বরের। হয়ত একটা সময় আসবে,  ভারতে উপেক্ষিত খবরের জন্য প্রতি জেলায় নতুন নতুন সংবাদপত্র প্রকাশ করে সরকারের কাছে স্থানীয় দাবি পৌঁছে দিতে হবে। মনে করতে হবে, আন্দোলনের নবজাতকের কথা।              

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?