প্ররোচনা উপেক্ষা করে দিল্লিতে সফল ট্র্যাক্টর মিছিল
দীপেন্দু চৌধুরী
তিনটে রাজ্যের পুলিশ, সিআরপিএফ, দিল্লি পুলিশ সব মিলিয়ে প্রায় ৪০,০০০ নিরাপত্তা
কর্মী নামানো হয়েছিল। তবুও ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে কৃষকদের ট্র্যাক্টর মিছিলকে
কেন্দ্র করে বিক্ষিপ্ত অশান্তির ঘটনা ঘটল। একজন কৃষকের মৃত্যু হল। প্রশাসন ব্যর্থ
হল, অথবা পূর্ব পরিকল্পিত চিত্রনাট্য ব্যবহার করা হয়েছে? শান্তিপূর্ণ র্যালিকে
অশান্ত করতে? দীর্ঘ টানা পড়েনের পরে ছত্রিশটি শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। সরকারের তরফে
ট্র্যাক্টর মিছিলের অনুমতি দিতে। সরকারের উদ্যোগে যে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান
ছিল, সেই অনুষ্ঠানের ‘লাইভ’ বেশিরভাগ টিভি দেখাতে ব্যস্ত ছিল। খুব স্বাভাবিক ঘটনা,
জাতীয় স্বার্থ যেখানে জড়িত সেখানে সর্বভারতীয় চ্যানেলগুলি প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন
ঐতিহ্যগতভাবে ‘লাইভ’ অনুষ্ঠান দেখিয়ে থাকে। কিন্তু তারপরেই সকাল ১১টার সময় ছিল
প্রধান ৪০টা ইউনিয়নের যৌথ সংগঠন সংযুক্ত কিসান মোর্চার ‘ট্র্যাক্টর র্যালি’।
কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে ৬৫ দিন ধরে দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে
অবস্থান বিক্ষোভ করছে কৃষকরা। তাঁরা ভারতের প্রজাতন্ত্রের দিন শান্তিপূর্ণ
ট্র্যাক্টর মিছিলের ডাক দিয়েছিল। প্রায় দু’লাখ ট্র্যাক্টর, লাখ লাখ কৃষক, ১৫
হাজারের কিছু বেশি মহিলা ট্র্যাক্টর চালক দিল্লির রিং রোড ধরে মিছিল করছিল।
পুলিশের দেওয়া নির্ধারিত রুট ধরেই মিছিল এগোচ্ছিল।
২৬ জানুয়ারি সকাল থেকে পাওয়া খবর, পুলিশ কতৃপক্ষ অক্ষরধাম হয়ে দিল্লি
যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু ‘ইন্ডিয়া টিভি’-র লাইভ অনুষ্ঠানে দেখা যায় সেই
রাস্তা পেল্লাই বড় এক কন্টেনার দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। কৃষকরা সাংবাদিকদের জানায়,
পুলিশ নাকি বলছে, আনন্দবিহার হয়ে যেতে হবে। কৃষকরা মানতে চায়নি। পূর্ব নির্ধারিত
‘রুট ম্যাপ’ এবং কৃষক নেতৃত্বের নির্দেশ মেনে তাঁরা র্যালি এগিয়ে নিয়ে যায়। ক্ষোভে
ফুটতে থাকা কৃষকরা বিভ্রান্ত না হয়ে সবাই মিলে ভারী কন্টেনার সরিয়ে দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে
ট্র্যাক্টর মিছিল নিয়ে এগতে থাকে। সে দৃশ্য দেখারমতো ছিল। মানুষ, মানুষের
অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা সমস্ত বাঁধন ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে। দেখলাম ২৬ জানুয়ারি
‘কৃষক প্রজাতন্ত্র’-র দিন টিভির সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে। সাংবাদিক হিসেবে প্রত্যক্ষ
ভাবে নিজে হাজির থাকতে পারলে গর্ববোধ করতাম। প্রতিটি ট্র্যাক্টরে ভারতের জাতীয়
পতাকা লাগানো ছিল। কিছু সুদৃশ্য ‘ট্যাবলো’ নজরে পড়ে। ভারতীয় কৃষি সংস্কৃতির ঐতিহ্য
মেনে সাজানো ‘ট্যাবলো’ অক্ষরধাম হয়ে দিল্লির পথে রওয়ানা দেয়। বেলা ১১টার সময় টিকরী
সীমান্ত থেকে প্যারেড শুরু হয়। ট্র্যাক্টরে বসে কৃষকদের হুকো খেতে দেখা যায়।
ট্র্যাক্টর ছাড়াও কৃষকরা নিজেদের সাইকেলে করে মিছিলে অংশ নিয়েছে। সাইকেলে কৃষক
আন্দোলনের সমর্থনে সুদৃশ্য প্ল্যাকার্ড লাগানো ছিল। তখনও আকাশে
বায়ুসেনার প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রদর্শনী চলছে। আর ‘গ্রাউন্ড লেভেল’-এ কৃষকদের
শান্তিপূর্ণ সুদৃশ্য ‘ট্র্যাক্টর মিছিল’। একুশ শতাব্দীর ভারতে আবার একবার ২৬
জানুয়ারি প্রজাতন্ত্রের দিন ‘জয় জওয়ান জয় কিসান’ স্লোগান সার্থকতা পেল। ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্থান হামারা, হামারা’।
ন্যাশনাল হাইওয়ে ৯, এখানে দেখা যায় কৃষকদের ট্র্যাক্টর মিছিলকে স্বাগত
জানানোর জন্য বাড়ির ছাদে স্থানীয় বাসিন্দারা অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ বাড়ির সামনে
দাঁড়িয়ে আছে। সবার হাতেই ফুল। ফুল ছড়িয়ে দিয়ে স্বাগত জানায় তাঁরা, অকুতোভয় কৃষক
প্রজাতন্ত্রের মিছিলকে।
পুলিশ বা প্রশাসন থেকে যে অশান্তির কথা বলা হচ্ছে সেটা কতটা ঠিক? কেউ বলতে
পারবে না। অথবা কোনও প্রামাণ্য দৃশ্য আমাদের নজরে পড়েনি যে, দিল্লিতে একটা দোকান
ভাঙা হয়েছে। অথবা কারও ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙা হয়েছে? কারও বাড়ির সামনে বা রাস্তায়
একটা ফুলও কেউ নষ্ট করেছে এমন অভিযোগ কেউ করতে পারবে? সিঙ্ঘু সীমান্তে দেখলাম টিয়ার
গ্যাসের শেল ফাটছে। গুলি চলছে। জল কামান ব্যবহার করে মিছিল আটকানোর চেষ্টা করছে
নিরাপত্তায় থাকা আধা সামরিক বাহিনী এবং পুলিশ কর্মীরা। অক্ষরধামের কাছে ডিএনডি
উড়াল পুলের উপর থেকে পুলিশ এবং নিরাপত্তা কর্মীদের টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটাতে দেখা
যায়। কেন হঠাত টিয়ার গ্যাস? কেন গুলি? সারাদিন ধরে নংলই (Nangloi) এলাকায় উত্তেজনা ছিল। কৃষকরা রিং রোড ধরে
রাজধানী দিল্লির পশ্চিমদিক বরাবর যেতে চেষ্টা করলে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে পৌঁছয়। মিছিলের
একটা অংশের কৃষকদের লাল কেল্লার দিকে যেতে দেখা যায়। আরেক দিকের কিছু কৃষক কম
সংখ্যায় থাকা কয়েকজন পুলিশ জওয়ানের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়ে। সংবাদ মাধ্যমে যে খবর
উঠে এসেছে।
লাল কেল্লার উপর কিন্তু লাহৌরি গেটের নিচে কেউ একজন একটি শিখ ধর্মের পতাকা
‘নিশান ই সাহেব’ তুলে দিয়ে আসে। এটি শিখদের ধর্মীয় পতাকা। এই পতাকা সব গুরুদ্বারের
উপর উত্তোলন করা হয়। এই পতাকা সেনা বাহিনীর শিখ রেজিমেন্টেরও পতাকা। পুলিশ এবং আধা
সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের সামনে বিনা বাঁধায়! তিনটে রাজ্যের পুলিশ, আধাসামরিক বাহিনীর
জওয়ানরা হাজির থেকেও বিশৃঙ্খলা আটকানো গেল না? ২০-২৫টা ট্র্যাক্টর নিয়ে কয়েকজন লাল
কেল্লায় ঢুকে পড়ল। আমরা জানি লালকেল্লায় ২৬ জানুয়ারি এবং ১৫ অগস্ট অতিরিক্ত
নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে। দিল্লির পুলিশ প্রশাসন এই বিষয়ে সতর্ক ছিল না কেন?
প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠে গেছে। দেশে হিংসার কোনও ঘটনা ঘটলে কেউ চুপ করে বসে
থাকতে পারে না। প্রসাসনের কাছেও আগাম খবর থাকে। তাহলে কি গোয়েন্দ ব্যর্থতা অথবা
একটু গভীরে খোঁজ নিলে পূর্ব পরিকল্পিত চিত্রনাট্যের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে? কারণ
ঘটনার সময় এনডিটিভি ইন্ডিয়া যে অনুষ্ঠান লাইভ দেখিয়েছে, তাতে দেখা গেল লাল কেল্লার
সামনে শীতের দুপুরে একদল পুলিশ নিজেদের মধ্যে গল্প তামাশায় ব্যস্ত। লাল কেল্লায়
ঢুকে পড়া একজন কৃষক বলছে, পুলিশ নির্ধারিত রুট থেকে বিভ্রান্ত করে লাল কেল্লায়
ঢুকিয়ে দিল।
ভূয়ো ইভ-টিজিংয়ের জিগির তুলতে গিয়ে ধরা পড়ে এক যুবক
ইতিমধ্যে একটি চিত্রনাট্যের প্রেক্ষাপট আমাদের সামনে এসেছে। সিঙ্ঘু
সীমান্তে ভুয়ো ইভ-টিজিংয়ের জিগির তুলে অশান্তি পাকাতে গিয়ে কৃষকদের হাতে ধরা পড়ে
এক যুবক। জেরার মুখে সে জানায়, কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত কৃষকদের আন্দোলনকে
ভাঙতে অশান্তি সৃষ্টি করাই ছিল তাঁদের উদ্দ্যেশ্য। প্রয়োজনে কৃষক নেতাদের
খুন করার পরিকল্পনাও ছিল তাঁদের। তাঁর দাবি পুলিশ থেকেই এই ছক করেছিল। এই কাজের জন্য
হরিয়ানার রাই থানার এক পুলিশকর্মী তাঁকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ২৩ জানুয়ারি সিংঘু
সীমান্তের অবস্থানস্থল থেকে পাকড়াও করা হয় সেই যুবককে।
যুবকটি জানায়, আটজন যুবক এবং দু’জন যুবতিকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল অন্তর্ঘাতের
মাধ্যমে কৃষক আন্দোলন ভাঙার একটি স্কোয়াড। প্রজাতন্ত্র
দিবসে দিন ট্র্যাক্টর মিছিলের ভেতর থেকে অন্তর্ঘাত চালানোর পরিকল্পনা ছিল
ওদের। কৃষক আন্দোলন ভাঙার জন্য তিনটে
পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সারা দেশে জাতীয়তাবাদী চেতনা চাগাতে জাতীয় পতাকা মাটিতে
ফেলে সাধারণ মানুষের কাছে হেয় করে দেখানো হবে। কৃষক আন্দোলন ভাঙতে জনমতকে কৃষক
আন্দোলনের বিরুদ্ধে পরিচালনা করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের
‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। ট্র্যাক্টর মিছিলের সময় কৃষকদের মধ্যে মিশে
গিয়ে পেশাদার শুটার গুলি চালাবে পুলিশের দিকে। দুষ্কৃতির গুলিতে একজন পুলিশের
মৃত্যু হলেই মিছিল পরিচালনায় থাকা পুলিশ পাল্টা গুলি চালিয়ে আন্দোলন ভন্ডুল করে
দেবে। ধৃত যুবকের দাবি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। (তথ্যসূত্রঃ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)
বিজেপি থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, কৃষক আন্দোলনে খালিস্থানী এবং প্রতিবেশি রাষ্ট্রের
সন্ত্রাসবাদীরা আছে। ওপরের ঘটনা কিন্তু অন্য কথা বলছে।
যারা গণ্ডগোল পাকিয়েছে তাঁরা মূল ৪০টা ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তই নয়। কেন্দ্র
১১ দফা যে আলোচনা করেছে সেই প্রতিনিধি দলে প্রথম থেকেই এদের কেউ ছিল না। সংযুক্ত
কিসান মোর্চা ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যেয় সিংঘু সীমানায় সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছে,
ট্র্যাক্টর প্যারেডের রুট ঠিক হয়েছিল সরকার এবং সংযুক্ত কিসান মোর্চার মধ্যে
আলোচনা করে। কিন্তু লালকেল্লায় যারা প্রবেশ করেছে, তাঁরা আলাদাভাবে প্যারেড করে থাকতে
পারে। দীপ সিধু নামে একজনকে ২৫ জানুয়ারি রাতে একটি মঞ্চ থেকে প্ররোচনামূলক বক্তব্য
রাখতে দেখা গেছে। সংযুক্ত কিসান মোর্চা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাঁদের প্যারেড দিল্লির
রিং রোডের চার-পাঁচটা অঞ্চল থেকে সকাল ১১টায় শুরু হবে। কিন্তু কিছু বিচ্ছিন্ন কৃষক
সংগঠন সকাল ৮টায় তাঁদের প্রতিবাদ শুরু করে।
সংযুক্ত কিসান মোর্চা নেতৃত্বের আরও অভিযোগ, পুলিশের উদ্যোগে দিল্লি পরিবহণ
নিগমের কিছু বাসকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কারণ প্ররোচনাকারী তথাকথিত কৃষক
নেতৃত্ব তাহলে বাসে ভাঙচুর, আগুন লাগানোর কাজ অনায়াসে করতে পারবে। বিচ্ছিন্ন এই গোষ্ঠীর
নেতৃত্বে ছিল দীপ সিধু। তারাই লাল কেল্লায় ঢুকে পড়ে প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন। এই
দীপ সিধু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে পঞ্জাবে বিজেপি প্রার্থী সানি দেওলের নির্বাচনী
এজেন্ত ছিল। প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং অমত শাহের ছবি ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। আপনারা
ভাবতে পারেন? এই ঘটনা একজন ব্যক্তি বা কোনও একদল মানুষের পক্ষে করা সম্ভব?
নিন্দনীয় এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতি মন্ত্রকের মন্ত্রী কী পদত্যাগ করবেন? কৃষক
নেতা বলবীর সিংহ রাজেওয়াল বলেন, ‘’মিছিল সরকারি ষড়যন্ত্রের শিকার। ৯৯.৯% কৃষক
শান্তিপূর্ণ ছিলেন। তা সত্বেও কিছু ঘটনা ঘটেছে।‘’
কৃষকদের অবস্থান আন্দোলন সমর্থনে, কৃষি কানুন বাতিল, ২৬ জানুয়ারি
শান্তিপূর্ণ ট্র্যাক্টর মিছিল থেকে হিংসা ছড়ানো প্রভৃতি বিষয় কংগ্রেস সহ ২২ টি
বিরোধী দল সংসদের বাজেট (শীতকালীন) অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ বয়কট করেছে। এই
অধিবেশনে বিরোধী জোটকে এক মঞ্চে আনতে কংগ্রেস সভানেত্রী স্নিয়া গাঁধি অন্যান্য বিরোধী
দলের নেতানেত্রীদের সঙ্গে ইতিমধ্যে কথা বলা শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।
Comments
Post a Comment