নেতাজির জন্মদিবস অনুষ্ঠানে বিজেপি দলের অসংযত আচরণ





 

দীপেন্দু চৌধুরী

যেটা চিরন্তন, সেটা ইতিহাস সৃষ্টি করে। কালের নিয়মেই এই ইতিহাস লেখা হয়। কখনও মুখের ভাষায়। সামাজিক পরিমণ্ডলে মিথ হয়ে ঘুরতে থাকা ব্যক্তির নাম। অথবা সময়ের কাল, পাত্র নির্ণয় করে মানুষ, হ্যা সাধারণ অতি সাধারণ, দীর্ণ, জীর্ণ, অন্তজ মানুষ মনে রাখে। ইতিহাস সৃষ্টি করা মানুষকে। সময়ের নিয়মে ইতিহাস তৈরি করা কালবেলাকে। সময় আহ্বান করে সময়ের ‘কাল-লয়’-কে চিনে নিতে। মনে রাখতে। ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ আমাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত ভাষার সাগর জলে অবগাহন করতে আহ্বান জানিয়ে রেখেছে। আমরাও বলতে জানি পুণ্য হউক, পুণ্য হউক অথবা সত্য হউক সত্য হউক। আরও নিবিড় করে বললে এক হউক, এক হউক। আমরা বিচ্ছেদ চাই না। আমরা ঐক্য চাই।

ভারতীয় গণতন্ত্রে নিজদের আধিপত্য কিছুটা বড় করে বিস্তার করে এবার হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবার বাংলা (উচ্চারণ বিভ্রাটে ‘বংগাল’) বিজয়ে আসছেন। আসছেন কেন, তাঁরা ভাবছেন এসে পড়েছেন। আমরা গণতান্ত্রিক ভারতের উদার, চিরায়ত সাংস্কৃতিক ভাষার সাগর জলে সিনান করেছি। বহু যুগ, বহুকাল আগে। বাংলার আউল বাউল আখড়ার সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে ‘আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে’-র আত্মীয়তা শিখেছি। পরাধীন ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন এক ব্যক্তি। জাত, বর্ণ ধর্মের উর্ধে ছিল তাঁর মনন। তাঁর সামরিক কৌশল। ব্রত ছিল ব্রিটিশ শাসকদের এই দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য করবেন তিনি এবং তাঁর গড়ে তোলা ‘আজাদ হিন্দ বাহিনী’ কাল তথা মহাকালের নির্ণয়ে হ্যা, সাধারণ অতি সাধারণ দীর্ণ, জীর্ণ, অন্তজ মানুষ মনে রেখেছে তাঁকে। ভারতের গণতন্ত্র দিবসের তিন দিন আগে তাঁর জন্ম।  

ব্রিটিশ আমলের কলকাতায় তৈরি এক ঐতিহাসিক সৌধে ছিল অনুষ্ঠান। ২৩ জানুয়ারি, সেদিনই সেই বীর যোদ্ধা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে কলকাতায় এসেছেন বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সামনে বিধানসভা নির্বাচন। তাই বাঙালি মননকে প্রভাবিত করতে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নেতাজি তাঁদের সম্মান প্রদর্শনের নাটক চলছে। মতাদর্শগতভাবে কিন্তু এই সব মনীষিদের সঙ্গে কোনই সম্পর্ক নেই এই হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রাদায়িক সংগঠন বিজেপির। ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মদিন উপলক্ষে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ায়ালের অনুষ্ঠান মঞ্চে বসে আছেন প্রধানমন্ত্রীআমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বক্তা হিসেবে ঘোষিত হতেই ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ বদলে গেল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে। সংকীর্ণ রাজনীতিতে কলুষিত হল নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী সূচনার অনুষ্ঠান। কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক মন্ত্রকের অনুষ্ঠানে ঘন ঘন ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি উঠল। প্রতিবাদে মুখর হলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এই আচরণের প্রতিবাদ করে নিজের পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য রাখতে অস্বীকার করেন।   মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘’সরকারের অনুষ্ঠানের মর্যাদা থাকা উচিত। এটা কোনও রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠান নয়।‘’

প্রশ্ন উঠছে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণপত্র ছাড়া এসপিজির নিরাপত্তা বলয় টপকে অনুষ্ঠানে প্রবেশ অসম্ভব। সেই অনুস্থানে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে থেকে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিলেন কারা? জানা গেছে, যারা ধ্বনি দিয়েছেন তাঁরা এই বাংলার বিজেপি যুব মোর্চার সদস্য। যারা গেরুয়া রঙের পোশাক এবং বিজেপির প্রতীক বা চিহ্ন নিয়েই ‘ভিআইপি’ জোনে বসেছিলেন। কয়েকজন বিজেপি নেতাকে ইঙ্গিতে সমর্থকদের উদ্দ্যেশ্যে নির্দেশ দিতেও দেখা গেছে। পরে সংবাদ মাধ্যমের কাছে বিজেপি নেতৃত্ব বলেছে, সেদিন ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান তুলে ভুল কিছু করেনি আমাদের সমর্থকরা। তথাগত রায় বলেছেন, ‘এই স্লোগানতো রসিকতা করে দেওয়া হয়েছে।’ দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘নেতাজি রাজনীতি করতেন, তাই আমরা তাঁর জন্মদিবসে রাজনীতি ক্রতেই পারি।’ একজন স্বল্পখ্যাত বিজেপি নেতা বলেন, ‘ওটা তো খিল্লি করে বলা হয়েছে’। এই সব মন্তব্য থেকেই এই বিজেপি দলের শিক্ষা দীখা ও সাংস্কৃতিক মান কীরকম তা বোঝা যায়। তবে পরিশীলিত বক্তব্য রাখেন বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এই ধরণের ঘটনা অনভিপ্রেত। তবে অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অভিব্যাক্তি ও শরীরী ভাষা দেখে বোঝা গেল দলীয় কর্মীদের এই ধরণের আচরণ তিনি অপছন্দ করছেন না।         

মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিবাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলও এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, ‘’মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজনীতির লড়াই আছে। কিন্তু সরকারি অনুষ্ঠানে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে অপমান করা হয়েছে, তার তীব্র নিন্দা করছি।‘’ বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, ‘’মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতার আগেই এটা অন্যায় হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীরও মনে রাখা উচিত, সরকারি অনুষ্ঠানে রাজনীতি করা উচিত নয়।‘’ বাংলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরাও এই ঘটনার নিন্দা করেছে।        

নেতাজি কোনও সঙ্কীর্ণ রাজনীতির সঙ্গে আপোষ করেননি কোনোওদিন। হিন্দি বলয়ের মানুষ পরস্পরে দেখা হলে ‘জয় সিয়া রামজি’ কী বা ‘জয় রাম জি’ কী বলে থাকেন ও আমরা তাই শুনতে অভ্যস্ত ছিলাম। উত্তর ভারত, হিন্দি বলয়ে এই শব্দবন্ধ মানুষ ধর্মীয় আবেগ থেকেই উচ্চারণ করেন। কারণ তাঁরা ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেলাতে জানতেন না। কিন্তু সংঘ পরিবার তথা বিজেপি ‘জয় শ্রীরাম’ রাজনৈতিক উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহার শুরু করে ‘বাবরি মসজিদ’ ধ্বংসের সময় থেকে। গুজরাটে দাঙ্গা করার সময়েও এই স্লোগান দিয়ে অভিযান চালানো হয়েছিল। এর সঙ্গে রামচন্দ্রের প্রতি ভক্তি ও ধর্মবোধের কোনও সম্পর্ক নেই। মাত্র তিন দশক হল ‘জয় শ্রীরাম’ রাজনৈতিক উদ্দ্যেশ্য থেকে ব্যবহারের প্রচলন শুরু করেছে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিশ্বভারতীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যে বছর এসেছিলেন, সেই বছরও ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে দেখা গেছে বিজেপির কর্মী সমর্থকদের

নেতাজি সুভাষ বসু আজাদ হিন্দ বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলে বলতে পারে এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন একটি সম্বোধন খুঁজে বার করো তোমরা। রাজপুতন কংগ্রেস-এর সৈনিকরা আবিদ হাসানের সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, ‘জয় রামজি কী’। আবিদের শুনতে ভালো লাগত। আবিদ একদিন সহযোদ্ধাদের বলেন, ‘আমি হায়দরাবাদের গোঁড়া মুসলমান পরিবারের ছেলে। কয়েক দিন, কয়েক রাত ধরে নিজের মনে ‘জয় রাম জি’ কী, বলি। আচ্ছা জয় হিন্দুস্থান কেমন? এটা একটু বড় হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা ‘জয় হিন্দ’ বললে কেমন হয়? পরেরদিন থেকে ‘জয় রামজি কী’-এর দল ‘জয় হিন্দ’ বলতে শুরু করল। সেই সময় থেকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অফিসার, জওয়ানরা পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলে ‘জয় হিন্দ’ বলতেন।

‘হিন্দুরাজ’ প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘’.........হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়া ‘হিন্দুরাজের’ ধ্বনি শোনা যায়। এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা। ......... শ্রমসিক্ত জনসাধারণ যেসব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন, সাম্প্রাদায়িক সংগঠনগুলির তাহার কোনওটির সমাধান করিতে পারিবে কী? কিভাবে বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র প্রভৃতির সমস্যার সমাধান হইবে সে সম্বন্ধে তাহারা কোনও পথ নির্দেশ করিয়াছে কি? (১৪ই জুন, ১৯৩৮, কুমিল্লায় ভাষণ)

যারা বা যে রাজনৈতিক দল নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীকে সামনে রেখে রাজনীতি করতে উদ্যোগী হয়েছেন, তাঁদের জন্য সুভাষচন্দ্র বসুর ৮৩ বছর আগের বক্তব্য উল্লেখ করলাম। মানুষ নিজেদের অভিঞ্জতায় বিভাজনকারী রাজনৈতিক দলকে চিহ্নিত করবে। নেতাজি সেই কথাই আমাদের বলে গেছেন।           

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?