টিআরপি বাড়াতে সেনাদের জীবনকেও বাজি অর্ণবের!






 

দীপেন্দু চৌধুরী

দেশের নিরাপত্তার গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়া ও নিজের টেলিভিশন টিভি চ্যানেলের টিআরপি বাড়াতে সেই তথ্য ব্যবহারের অভিযোগ উঠল রিপাবলিক টিভির কর্ণধার অর্ণব গোস্বামীর বিরুদ্ধে। গত বছর নভেম্বর মাসে টিআরপি দুর্নীতির অভিযোগে ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল (বিএআরসি), অর্ণব গোস্বামীর টিভি চ্যানেল ও অন্যান্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ১৪০০ পাতার চার্জশীট আদালতে জমা দিয়েছিল মুম্বই পুলিশ। এটি ছিল চার্জিশীটের প্রথম খণ্ড। দ্বিতীয় খণ্ড, চলতি মাসের গত সপ্তাহে ৩৪০০ পাতার অতিরিক্ত চার্জশীট হিসেবে জমা দিয়েছে তাঁরা। আদালতে এই বিষয়ে শুনানী শোনার সময় নতুন করে সামনে আসে প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের একটি টুইট বার্তা। বিএআরসি-র প্রাক্তন সিইও পার্থ দাশগুপ্তের সঙ্গে অর্ণবের হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমে বিনিময় করা কিছু ‘স্ন্যাপশট’ তথা ছবি টুইটে তুলে ধরেছেন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হোয়াটসঅ্যাপে অর্ণব এবং বিআরসির প্রাক্তন কর্তা পার্থের মধ্যে কী কথা চালাচালি হয়েছিল, আদালতে পেশ হওয়া অতিরিক্ত চার্জশীটে ৫০টিরও বেশি পাতা জুড়ে রয়েছে সেই সব

প্রশান্ত ভূষণের টুইট করা ‘স্ন্যাপশট’-গুলিতে আছে অর্ণব দাবি করছেন, প্রধানমন্ত্রীর দফতর (পিএমও), তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রক, এনএসএ এবং অঞ্জাত কোনও ‘এএস’-এর সঙ্গে তাঁর এত ঘনিষ্ঠতা রয়েছে যে, সরকারের অনেক গোপন তথ্য তিনি আগাম জানতে পারেন। আইনজীবী ভূষণের টুইট করা ‘স্ন্যাপশটে’ আরও প্রকাশ করা হয়েছে, অর্ণব গোস্বামী বলছেন, তিনি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বদল অথবা পিএমও থেকে নৃপেন্দ্র মিশ্রের অপসারণের ব্যাপারে আগে থেকেই জানতেন। পার্থ দাশগুপ্তকে অর্ণব বলছেন, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকড় একজন ‘অপদার্থ’। জাভড়েকড় থাকাতে বিভিন্ন বিষয়ে অর্ণবকে অসুবিধের মুখে পড়তে হয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হিসেবে স্মৃতি ইরানি থাকলে তাঁর অনেক সুবিধা হত।

বালাকোট হামলার আগাম খবর নিজের চ্যানেল ‘রিপাবলিক টিভি’-তে সম্প্রচার করতে পারা নিয়ে গর্বিত ছিলেন অর্ণব গোস্বামী। সেই বিষয়টা নিয়ে যখন সারা দেশে বিতর্ক শুরু হয়েছে তখন সামনে এল পুলওয়ামা হামলার প্রসঙ্গ। পুলওয়ামা হামলা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতে দেখা গিয়েছিল সাংবাদিক-সম্পাদক অর্ণব গোস্বামীকে। এই বিষয়টাও ফাঁস করেছেন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ। বিশিষ্ট আইনজীবী লিখেছেন, ‘অর্ণবের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট থেকে স্পস্ট যে পুলওয়ামা হামলায় মৃত্যু হয়েছে ৪০ জন জওয়ানের, সেটা নিয়েও তিনি উচ্ছ্বসিত। উল্লেখ আছে ‘’আমরা বড় জয় পেয়েছি’’। বালাকোট হামলা নিয়ে আগাম খবর ছিল অর্ণবের কাছে। ২০১৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে বার্কের প্রাক্তন সিইও পার্থ দাশগুপ্তকে রিপাবলিক টিভি গোষ্ঠীর কর্ণধার অর্ণব গোস্বামী লিখেছিলেন, ‘সাধারণ হামলার চেয়ে বড় কিছু!’ পার্থ জানতে চেয়েছিলেন দাউদের ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ করবে সরকার? অর্ণবের উত্তর ছিল, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বড় পদক্ষেপ করবে সরকার। পার্থ বলছেন, এটা ‘বিগ ম্যান’-এর পক্ষে ভালই হবে। দেশবাসী খুশি হবেন। তিনি ভোটে বড় জয় পাবেন। টিআরপি জালিয়াতি মামলায় ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএআরসি-র প্রাক্তন শীর্ষকর্তা পার্থ দাশগুপ্ত। পুলওয়ামা হামলার পরে রিপাবলিক টিভি চ্যানেলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের প্রথম সাক্ষাৎকার সম্প্রচারিত হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের বালাকোটে বড়সড় অভিযান চালায় ভারতীয় বায়ুসেনা। অর্ণব এবং পার্থের মধ্যে ‘চ্যাট’ হয়েছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি, তার তিন দিন পরেই বালাকোটে অভিযান হয়। এর থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সরকারের কোন স্তরের শীর্ষ কর্তার সঙ্গে অর্ণব নামক একজন সাংবাদিকের যোগাযোগ থাকতে পারে।   

অর্ণব এবং পার্থের মধ্যে এই বার্তালাপ ফাঁস হতেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এত বড় সার্জিক্যাল হামলার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের মুষ্টিমেয় কয়েকজন পদাধিকারী ছাড়া আর কারও জানার কথা নয়, সেখানে অর্ণব গোস্বামী জানলেন কী করে? আইনজীবী ভূষণের ফাঁস করা টুইটের ‘স্ন্যাপশটে’ ব্যবসায়িক ফায়দার জন্য ‘এএস’-এর সঙ্গে সম্পর্কের অপব্যবহার করা, বিআরসি থেকে নিজের ব্যবসায়ী প্রতিযোগীদের তথ্য জোগাড় করা, অন্য চ্যানেলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গগুলিও আছে। ১৬ জানুয়ারি প্রশান্ত ভূষণ টুইট করেছেন, Arnab’s Whatsapp chat that he rejoiced at the Pulwama bombimg which killed 40 jawans, saying ‘’We won big’’; & had advance info on the Balakote strikes. He says, ‘’people will be elated’’ by strikes. প্রশ্ন উঠছে, অর্ণব গোস্বামী জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সমঝোতা করেছিল? পুলওয়ামা আক্রমণের ২০ মিনিট আগে একমাত্র সর্বভারতীয় চ্যানেল ‘রিপাবলিক টিভি’-র প্রতিনিধি ঘটনাস্থলে ছিল। কি করে এটা সম্ভব? প্রশান্ত ভূষণ জানাচ্ছেন, ‘’আইনের শাসন থাকা যে কোনও দেশে এই ব্যক্তির দীর্ঘমেয়াদি জেল হত।‘’

বাজপেয়ী সরকারের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা ১৮ জানুয়ারি টুইট বার্তায় বলেন, ‘’অর্ণবের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে লোকসভা ভোট বেজেপি জিতেছিল জাতীয় নিরাপত্তাকে বাজি রেখে। অথবা বলা ভালো, ক্ষমতা লাভের জন্য একটি রাজনৈতিক দল পরিকল্পিতভাবে এই কৌশলকে কাজে লাগিয়েছে। দলের মূল উদ্দ্যেশ্যই ছিল যেভাবে হোক দ্বিতীয় বারের জন্য সরকার গঠন করতে হবে।‘’ 

ভারতীয় জওয়ানদের জীবনের মূল্যকে গুরুত্ব না দিয়ে দেশের নিরাপত্তার গোপন তথ্য ফাঁস ও টেলিভিশন চ্যানেলের টিআরপি বাড়াতে সেই তথ্য ব্যবহারের অভিযোগ তুলছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কংগ্রেস, শিবসেনা, এনসিপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস থেকে এই অভিযোগ তোলা হচ্ছেপ্রকৃত তথ্য জানা এবং তদন্তের জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) গড়ার দাবি জানিয়েছে এনসিপি। কংগ্রেস নেতা এবং রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলৌত একটি টুইটে লিখছেন, ‘’মুম্বই পুলিশের চার্জশিট থেকে জানতে পারলাম একটি টিভি চ্যানেলের সম্পাদকের চ্যাট রাষ্ট্রীয় সুরক্ষায় গভীর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। চ্যাট দেখে মনে হচ্ছে, ওই সাংবাদিক-সম্পাদককে দেশের নিরাপত্তা বিষয়ক খবর আগে থাকতে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই কারণে ওই সম্পাদক তথা টিভি সঞ্চালক নিজের চ্যানেলের মাধ্যমে দর্শকদের আগাম খবর পৌঁছে দিতে পেরেছিল। এই মামলার বিচার করে দোষীদের শাস্তি দেওয়া উচিত।‘’

কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি বলেছেন, ‘’এ ধরনের গোপন সরকারি তথ্য দেওয়া আইনি অপরাধ। যিনি তা দিয়েছেন এবং পেয়েছেন, দু’জনের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করতে হবে। জেলে যেতে হবে দু’জনকেই। কে তথ্য ফাঁস করেছেন, তার তদন্ত হওয়া জরুরি।‘’        

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?