কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে কৃষি আইন রূপায়ন করতে চাইছে!



দীপেন্দু চৌধুরী

তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে অনড় কৃষক নেতাদের সঙ্গে অষ্টম রাউন্ডের বৈঠকও ব্যর্থ হয়। ৮ জানুয়ারির বৈঠকে সমাধান সূত্র খুঁজে বার করা যায়নি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে কৃষক নেতাদের রীতিমত উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছিলসেদিনের আলোচনা কৃষক নেতারা সিদ্ধান্ত নেন মন থাকার। বিঞ্জান ভবনে দু’পক্ষের আলোচনা একরকম নিষ্ফলা ছিল। দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে অবস্থানে বসে থাকা কৃষকদের হাতে প্ল্যাকার্ডের স্লোগান থেকেই বোঝা যায় তাঁরা অনড় আছে কৃষি আইন প্রত্যাহারে। কোনও প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘ইয়া মরেঙ্গে ইয়া জিতেঙ্গে’ (হয় মরব, নয়ত জিতব)। কারও প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘কানুন ওয়াপিস তো হাম ঘর ওয়াপিস’ (আইন ফিরিয়ে নিলে, তবেই ঘরে ফিরব)। এই আবহে ৮ জানুয়ারির বৈঠক হয়েছিল।

সেদিনের বৈঠকে কৃষকনেতা বলবীর সিংহ বলেন, কেন্দ্রের সাংবিধানিক অধিকারই নেই কৃষি আইন আনার।  কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমর চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছিলেন, আইনের সাংবিধানিক দিক নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছে। কৃষক নেতারা তাহলে তার রায়ের জন্য অপেক্ষা করুন।  

পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক দিল্লি সীমানায় প্রবল শীতে প্রায় ৫০ দিন ধরে অবস্থান কর্মসূচী নিয়ে বসে আছেনঅবস্থানে আসা ৬০জন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এমত অবস্থায় কেন্দ্রের পাশাপাশি দিল্লির পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির বিজেপি নেতৃত্বেরও রক্তচাপ বাড়ছে। ৮ জানুয়ারি পঞ্জাবের বিজেপি নেতারা দিল্লি এসে অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক করেন। ৬ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একদফা বৈঠক করেন। ৮ জানুয়ারি যোগী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টরের সঙ্গে কেন্দ্রের কথা হয়।

মহামান্য আদালতকে সম্মান জানিয়েই বলতে হচ্ছে, বিজেপি শাসিত মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকের পরেই একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, সুপ্রিম কোর্টের রায় কতটা সরকারের পক্ষে যেতে পারে। আমাদের অভিঞ্জতা বলে, সিএএ বিরোধী শাহিন বাগের আন্দোলন তুলতেও সুপ্রিম কোর্টের রায় কেন্দ্রকে সাহায্য করেছিল। বাবরি মসজিদ-রামমন্দিরের রায়ও বিজেপি সরকারের পক্ষে সহায়ক হয়েছে। ‘লাভ জিহাদ’ বিষয়ক মামলাতেও আপাত দৃষ্টিতে যতই মনে হোক শীর্ষ আদালত আইন প্রণয়নকারী রাজ্যগুলির কাছে নতুন আইনের ব্যখ্যা চেয়েছে। পরোক্ষে কি অপেক্ষা করছে সময় বলবে। ১১ জানুয়ারির রায়েই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবডে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন তিন কৃষি আইন রূপায়ন আপাতত স্থগিত রাখার। ওই দিন কেন্দ্র ৪৫ পাতার এফিডেভিট জমা দিয়ে দাবি করে সরকারের আনা তিন কৃষি আইন বিরাট সংখ্যক কৃষক সমর্থন করছে। দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে যে কৃষকরা আন্দোলনে বসে আছেন তাঁরা ভারতীয় কৃষকদের মূল প্রতিনিধি নয়। ওদের সঙ্গে বাইরের লোকও আছে যারা কৃষক নয়। শীর্ষ আদালতের শুনানিতে কৃষকদের হয়ে আদালতে দাঁড়াতে চেয়ে আবেদন করেছিলেন দুস্মন্ত দাভে, প্রশান্ত ভূষণ সহ আরও দু’জন খ্যাতনামা আইনজীবী। কিন্তু প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ তাঁদের আবেদন অনুমোদন করেননি। ১২ জানুয়ারির রায়ে আইন স্থগিত ঘোষণার পাশাপাশি চার সদস্যের একটি কমিটি গড়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট কৃষক নেতৃত্বের অভিযোগ, ‘কৃষি আইন-পন্থী’ চার সদস্যের কমিটিকে কৃষি আইন নিয়ে অভিযোগ শোনার দায়িত্ব দিল শীর্ষ আদালাত। সুপ্রিম কোর্টের গড়ে দেওয়া বিতর্কিত কমিটিতে আছেন দু’জন কৃষি অর্থনীতিবিদ। তাঁরা হলেন, অশোক গুলাটি ও প্রমোদ কুমার জোশী। কমিটিতে রাখা হয়েছে কৃষক সংগঠনের দু’জন বিতর্কিত নেতা ভূপেন্দ্র সিংহ মান এবং অনিল ধনওয়াত। কৃষক নেতাদের অভিযোগ, চারজনেই তিন কৃষি আইনের পক্ষে একাধিকবার সওয়াল করেছেন। কমিটির অন্তর্ভুক্ত দু’ই স্বনামধন্য কৃষক নেতা কৃষিমন্ত্রীর কাছে আইনকে সমর্থন জানিয়ে স্মারকলিপিও দিয়েছেন     

 চার সদস্যের এই কমিটি সরকার পক্ষ এবং কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করে তিন আইনের পর্যালোচনা করবে। কমিটির প্রধান দায়িত্ব কৃষক সংগঠনগুলির তিন কৃষি আইন বিষয়ে তাঁদের আপত্তি শুনবে। এবং সরকারের বক্তব্য শুনে দু’মাসের মধ্যে নিজেদের সুপারিশ জানাবে। ১১ জানুয়ারির শুনানিতে মোদী সরকারের আইনজীবীরা আপত্তি করলেও ১২ জানুয়ারির রায়ে কোনও আপত্তি করেনি। ৮ জানুয়ারি বৈঠকে কৃষিমন্ত্রী তোমরের চ্যালেঞ্জ কেন ছিল, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় থেকেই অনুমান করতে অসুবিধা হয় না।

রায়ের পর সংযুক্ত কিসান মোর্চার পক্ষে যোগেন্দ্র যাদব বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আমরা খুশি। আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই রায়কে। কিন্তু মধ্যস্থতার জন্য যে কমিটি সুপ্রিম কোর্ট গড়ে দিয়েছে আমরা সেই কমিটির কাছে যাব না। অল ইন্ডিয়া কিসান সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশন কমিটি (এআইকেসিসি)-র পক্ষে জাতীয় কর্মসমিতি ১২ জানুয়ারি প্রেস বিবৃতিতে জানায়, শীর্ষ আদালতের রায়ে দিল্লি সীমান্তে আমাদের আন্দোলন বন্ধ করা বা রাস্তা খালি করে দেওয়ার কথা বলেনি। আমরা এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু এটা মীমাংসা নয়। কৃষকদের ইউনিয়ন এই কমিটি গঠনের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেনি। আমরা আবারও দাবি করছি, কেন্দ্র তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করুক। ভারতীয় নাগরিক ও কৃষকরা এই তিন আইনের বিরোধিতা করছে।

মোর্চা জানিয়েছে, দিল্লি-হরিয়ানা সীমানা অবরোধ করে কৃষকদের আন্দোলন যেমন চলছে তেমনি চলবে। কৃষকরা ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে ট্রাক্টর মিছিল করবে। পূর্ব নির্ধারিত ১৫ জানুয়ারি সরকারের সঙ্গে বৈঠকে কৃষক নেতারা যাবেন এবং একই দাবি জানাবে। আইন প্রত্যাহার করতে হবে।  

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কৃষক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সরকারকে একাধিকবার ব্যাখা করে বলেছে, তিন কৃষি আইন বহুজাতিক সংস্থাকে সাহায্য করতে আনা হয়েছে। এই আইন কৃষকদের স্বার্থে কাজে লাগবে না। কৃষি চাষে কৃষকদের উপর আরও বোঝা চাপবে। উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিক্রি করে লাভজনক মূল্য ফেরৎ পাওয়া যাবে না। কৃষকদের ক্ষতি যেমন বাড়বে, এই তিন আইন মেনে নিলে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া নিরাপত্তা হারাতে হবে। পিডিএস ব্যবস্থাও উঠে যাবে। এই কারণে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা আরও বেড়ে যাবে। তাই আমরা তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় আছি। আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন যেমন চলছে তেমন চলবে।

পূর্বঘোষিত ১৩, ১৮ ও ২৩ জানুয়ারি যে কর্মসূচীর কথা আমরা বলেছি সেই কর্মসূচী বহাল থাকছে। ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন দিল্লি সহ সারা দেশে কিসান প্যারেড আমরা করব। কৃষকরা প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করবে। সরকার এই বিষয়েও কেন্দ্রকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। কৃষকরা সরকারের ভূমিকা নিয়েই কথা বলতে আগ্রহী। সুপ্রিম কোর্টের বিষয়ে নয়। কারণ আদালতে আমাদের প্রতিনিধি কেউ ছিল না।

কৃষক নেতারা যুক্তি দিয়ে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট তিন কৃষি আইন স্থগিত রেখেছে। আইন খারিজ বা প্রত্যাহারের কথা বলেনি। সরকার সময় কিনতে চাইছে। নিজেরা না পেরে সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে শিল্পপতিদের স্বার্থে আনা আইন রূপায়ন করতে চাইছে। কিছুদিন টানাপোড়েন করে বিষয়টা ঝুলিয়ে রাখা যাবে। আন্দোলন উঠে গেলে আবার তিন আইন রূপায়ন করার প্রক্রিয়া শুরু হবে। চারজনের যে কমিটি শীর্ষ আদালত করে দিয়েছে, তাঁরা আইনের পক্ষেই দাঁড়াবে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি বলেছেন, ‘’কৃষক বিরোধী আইনকে সমর্থন করা ব্যক্তিদের থেকে কি ন্যায়ের আশা করা যায়?’’                                 

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?