উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগঃ এক যুগ আগের লড়াই আজও চলছে







দীপেন্দু চৌধুরী

এক যুগ আগের কথা, আমি বেশ মনে করতে পারছি একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের ব্যস্ত সাংবাদিক হিসেবে ঘন ঘন ফোন পেতাম ওদের কাছ থেকে। ওরা ‘পিটিটিআই’ প্রশিক্ষণের পরে চাকরি পাচ্ছেন না। পিটিটিআই আন্দোলনের নেতা কর্মী। নামগুলো আর উল্লেখ করছি না। বিশেষত দু’জন নেতার নাম। যারা সামনের সারিতে ছিলেন। তারা বর্তমানে রাজ্যের শাসকদলের নেতা এবং সুপ্রতিষ্ঠিত। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তারা তাদের অতীত হয়ত ভুলে গেছেন। যে সময় তারা ‘পিটিটিআই’ আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন। আমার সঙ্গেও তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল।

বামফ্রন্টের শেষ দশক। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা কলকাতা সহ বিভিন্ন জেলায় আন্দোলন করছে। আমারা সংবাদ মাধ্যমে খবর করছি। কয়েকটি অবাঞ্ছিত আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে। তারপর ‘পরিবর্তন’-র সরকার এল। সেই আন্দোলনের সামনের সারির নেতারা নিজেদের মত করে গুছিয়ে নিলেন কিন্তু তাদের পরের প্রজন্ম যে তিমিরে থাকার সেই তিমিরেই থাকলেন। সম্প্রতি বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ ২ ডিসেম্বর শীত ঋতুতে রাত একটার সময় আন্দোলনরত কয়েকজন কর্মপ্রার্থীকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে শিয়ালদহ স্টেশনের সামনে নামিয়ে দেয়। উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষকপদের প্যানেলভুক্ত বিক্ষোভকারীদের এমনটাই অভিযোগ।

দৃশ্য- ১ কর্মপ্রার্থীদের আরও অভিযোগ, ছয় বছর আগে টেট দিয়েছেন তারা। কিন্তু উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষকপদে নিয়োগপত্র এখনও পাননিতাই গত ১ ডিসেম্বর সল্টলেকে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-র প্রধান দফতরের সামনে বিক্ষোভ অবস্থান করছিলেনরাত ১২ টার সময় পুলিশ আসে। সেই দিন জলকামান দিয়ে উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশপুলিশের টানাহেঁচড়ায় কয়েকজন আন্দোলনকারীর জামা ছিঁড়ে যায়। কয়েকটা পুলিশ ভ্যানে আন্দোলনকারীদের কয়েকজনকে তুলে শিয়ালদহ স্টেশনে নিয়ে গিয়ে ছেঁড়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ সাত বছর ধরে টানপড়েন চললেও উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষকপদে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি।

রাজ্য শিক্ষা দফতর ২০১৪ সালে প্রথম আবেদনপত্র গ্রহণ করে। টেট পরীক্ষা হয় ১৬ অগস্ট, ২০১৫ তে। টেটের ফল প্রকাশ হয় ২০১৬ সালে। সাক্ষাৎকারের আবেদন গ্রহণের বিঞ্জপ্তি প্রকাশ হয় ২০১৬ সালে। প্রথম দফা নথি ভেরিফিকেশনের ফল প্রকাশ হয় ২০১৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া পর্ব শুরু করা হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। প্রভিশনাল মেরিট তালিকা প্রকাশ হয় কোর্ট অর্ডারের পরে। কোর্টের অর্ডারের তারিখ ৪ অক্টোবর, ২০১৯। এসএসসি কমিশন কোর্ট অর্ডারের বেঁধে দেওয়া  সময়সীমা ২১ দিন ধরে অভিযোগ নিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর। দীর্ঘ ১ বছর ৩ মাস কেটে গেলেও নিয়োগ অধরা থেকে গেল। ২ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করার পরে উচ্চ প্রাথমিকের ভবিষ্যৎ শিক্ষকদের আসামীর মত পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হল।

অবস্থান বিক্ষোভকারীদের দাবী, ১)অতি দ্রুত গেজেট বিধি মেনে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত না করে আপার শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ২) গেজেট বিধি বা আইন অনুযায়ী ইন্টারভিউ সম্পন্ন হয়েছে যে সব প্রার্থীদের Subject Category Wise ratio Maintain  করতে হবে। শূন্যপদের সংখ্যা, আদালত ঘোষিত শূন্যপদ ৫০০১ টি। এবং সরকারের ঘোষণা মত  ৫১০৮ টি নতুন স্কুলের শিক্ষকের শূন্যপদেও নিয়োগ করতে হবে।      

দৃশ্য- ২ মাদ্রাসার শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে লড়াই করছে আন-এডেড মাদ্রাসা টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন। এই সংগঠনের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে মাদ্রাসা শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীরা। ২৩৫ টি মাদ্রাসা স্কুলের শিক্ষকরা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে টানা কয়েকদিন অনশন ধর্মঘট করে। তাদের দাবি, রাজ্যে ২০১১ সালে ১০, ০০০ মাদ্রাসা তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ‘পরিবর্তন’-র সরকার এসে। গত সাড়ে ন’বছরে মাত্র ২৩৫ টি মাদ্রাসা তৈরির কাজ শেষ করেছে রাজ্য সরকার। সে সব স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ হয়নি সরকারি নিয়ম অনুসারে। মাদ্রাসা পরিচালন কমিটি শিক্ষক নিয়োগ করেছে। শিক্ষকদের মাইনে কীভাবে দেওয়া হবে সেই বিষয়টা আজও ঝুলে রয়েছে। ২০১৩ সালে মাদ্রাসায় নিয়োগের পরে শিক্ষকদের বেতন কত হবে সেই বিষয়টা জানতেই টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন আবেদন করেছিল।

তাদের অভিযোগ ২০২০ সাল পর্যন্ত কোনও বেতন তারা পাননি। একটানা ৯৬ দিন আন্দোলন করেছে মাদ্রাসার শিক্ষকরা। ১ ডিসেম্বর সংগঠনের পক্ষ থেকে কলকাতায় গাঁধী-মূর্তির কাছ থেকে নবান্ন অভিযানের ডাক দীয়েছিল। সেদিনের মিছিলের শুরুতেই পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে লালবাজারে তুলে নিয়ে যায়। শিক্ষক-শিক্ষিকারা জামিন নিতে অস্বীকার করে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ৫ জন প্রতিনিধি মাদ্রাসা দফতরের সচিব গোলাম আলী আনসারীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়। মাদ্রাসা সচিবের কাছে তারা দাবি জানায় ৮২ টি মাদ্রাসা বিল্ডিং গ্রান্ট দিতে হবে। এবং প্রায় ৪০০০০ ছাত্রছাত্রী, ২৫০০ শিক্ষক শিক্ষিকার দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান করতে হবে।  শিক্ষকবন্ধু শিক্ষামন্ত্রী বা সংখ্যালঘু দরদী সরকার শিক্ষকদের কথা কানে তুলতেই আগ্রহী নন।

 দৃশ্য-৩  জুলাই, ২০১৯-এ কলকাতায় আরও একটি অবস্থান বিক্ষোভ হয়। সেই বিক্ষোভে সারা রাজ্যে ১৭ টি প্রাথমিক স্কুলের কয়েক হাজার টেট শিক্ষক-শিক্ষিকা তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি এবং স্থায়ী চাকরির দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করে। একটি পোস্টার নিয়ে সন্তান কোলে শিক্ষিকা প্রার্থী বসে আছে। তার হাতের পোস্টারে লেখা ‘অনশনরত নবমশ্রেণি-দ্বাদশশ্রেণি, কর্মশিক্ষা এবং শারীর শিক্ষা প্রার্থীদের চাকরি সুনিশ্চিত করতে হবে।’  অনির্দিষ্টকালের জন্য তারা অনশন ধর্মঘটে নামে। কলকাতায় বিধাননগরে শিক্ষামন্ত্রীর দফতরের কাছে ফুটপাথে ১৪ দিন টানা অনশন করার সময় কয়েকজন আন্দোলনকারী অসুস্থ হয়ে পড়েনবিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেকেই ধর্নাস্থলে গিয়ে আন্দোলনকারীদের নৈতিক সমর্থন জানায়।

প্রয়াত জনপ্রিয় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীকে আবেদন জানিয়েছিলেন অনশনকারী আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করে সমস্যার সমাধান করতে। এবং সহমর্মীতা জানাতে। বছর দেড় দু’য়েক আগে চাকরিপ্রার্থী শিক্ষকদের আরও একটি অবস্থান আন্দোলনের কথা আমার মনে পড়লেও নির্দিষ্ট তারিখ মনে পড়ছে না। কলকাতা প্রেস ক্লাবের পাশের ফুটপাথে দিন-রাতের টানা বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন একদল কর্মপ্রার্থী শিক্ষক-শিক্ষিকাআমরা প্রেসক্লাব যাতায়াতের পথে সেই আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছি। শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী সমাজের বিভিন্ন শাখার প্রতিনিধিরা এই আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। সংবাদ মাধ্যমেও নিয়মিত খবর প্রকাশ হতে থাকে। সামাজিক চাপে শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিক্ষোভ মঞ্চে যান। এবং আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেন। তারপরেও ডিসেম্বরের শীতে রাজ্য সরকারের পুলিশ হবু শিক্ষকদের উপর অমানবিক আচরণ করল বলে অভিযোগ। উচ্চারণ করতে হয় ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে’।

এক একটি স্কুলে ১৬০০-১৭০০ ছাত্র। অনুপাত অনুযায়ী শিক্ষক মাত্র ১২ জন। কোন কোনও স্কুলে তাও নেই। মাত্র ৫-৬ জন শিক্ষক দিয়ে স্কুল চালাতে হয়। শিক্ষকের অভাবে রাজ্যের বহু স্কুলের অবস্থা বলার মত নয়। রাষ্ট্রসংঘের পরামর্শ, বিশ্বের প্রতিটি দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় গুরুত্ব বাড়াতে হবে। দেশের সমস্ত শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার ( ''Elementary Education for all'' ) আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দেশের সংবিধান আমাদের শিক্ষার অধিকার আইন দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারকে সুপ্রীম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, শিক্ষার অধিকার যেন ভারতের সমস্ত নাগরিকদের ঘরে পৌঁছে যায়। রাজ্যের শিক্ষা দফতর কি এই নির্দেশ অনুসরণ করে?

উল্লেখিত তিনটে দৃশ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার চালচিত্র আমাদের সামনে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। স্কুলগুলির পরিকাঠামোর অবস্থাও অত্যন্ত সাধারণ মানের। কোনও স্কুল বাড়ির প্রয়োজনীয় শিক্ষাকক্ষ (ক্লাস রুম) নেই। কোনও স্কুলে শৌচালয় নেই। বিভিন্ন সমস্যা আছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গেলে এমন ছবি আমরা দেখতে পাব। রাজ্যের স্কুলগুলিতে হাজার হাজার শিক্ষকপদ খালি। অথচ সরকার নিয়োগ করছে না। পেইড সংবাদ মাধ্যম এবং বিঞ্জাপনে সরকার দাবি করছে, কয়েক লক্ষ বেকারের চাকরি হয়েছে রাজ্যে। গত সাড়ে নয় বছরে। বাস্তবের ছবি অন্য কথা বলছে।   

চাকরির দাবিতে প্যানেলভুক্ত শিক্ষকরা যে আন্দোলন করছে তার ন্যায্যতা মেনে নিয়েছে রাজ্যের বেশ কয়েকটি শিক্ষক সংগঠন এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল। প্রত্যেকেই বলছে, বিধাননগরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যে আচরণ সরকার করেছে সেটা অত্যন্ত নিন্দনীয়। কারণ যারা আন্দোলন করছিল তারা শিক্ষক পদে সরকারি তালিকার প্যানেলভুক্ত। তারা চাকরি না পেয়ে গণতান্ত্রিক অধিকারবলে আন্দোলন করছিল। সেই আন্দোলন পুলিশ দিয়ে দমন করা ঠিক হয়নি,  এমন দাবি উঠছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় যে গয়ংগচ্ছ অবস্থা গত কয়েক বছর ধরে চলছে তার দায়িত্ব শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একার নয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। ১১ ডিসেম্বর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য তাঁর রায়ে উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করে দিয়েছেন। 

      (এই লেখাটি ১১ ডিসেম্বর ‘সপ্তাহ’ পত্রিকায় প্রকাশিত)                   

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?