কৃষক আন্দোলন ভাঙার বিভিন্ন কৌশল নিচ্ছে মোদী সরকার






দীপেন্দু চৌধুরী

কেন্দ্রের আনা তিনটি কৃষি আইন বাতিলের আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। সম্প্রতি তার নিজের রাজ্য গুজরাতে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে একই অভিযোগ করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘’দিল্লির পাশেপাশে কৃষকদের বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে। আমি কৃষক ভাই-বোনদের বলছি, তাঁদের যে কোনও আশঙ্কা দূর করতে সরকার ২৪ ঘণ্টা তৈরি।‘’ প্রধানমন্ত্রী ষড়যন্ত্রের গন্ধ দেখলেও আন্দোলনরত কৃষক নেতৃত্বের দাবি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে রাজ্যের মাটিতে দাঁড়িয়ে ষড়যন্ত্রের কথা বলে এলেন সেই রাজ্যে নিজেই কৃষকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছেন। যে কথা তার ‘গোদী মিডিয়া’ প্রচার করছে না।

গুজরাতের কচ্ছের তালুকা অঞ্চলে ১৫ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী একাধিক বৈঠক করেছেন। তারমধ্যে ওই অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে বৈঠকের কথা গুজরাত সরকারের তরফে প্রচার মাধ্যমকে জানান হয়। রূপানী সরকারের তথ্য সংস্কৃতি দফতর থেকে কচ্ছের তালুকা অঞ্চলের কৃষকদের আমন্ত্রণপত্র পাঠান হয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তাঁদের আমন্ত্রণ জানান হয়। ‘গোদী মিডিয়া’ এই অনুষ্ঠানের প্রচার ঢক্কানিনাদ সহ প্রচার করলেও আসল তথ্য চেপে গেছে। কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কচ্ছের যে কৃষকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে জানান হয়েছে, সেই কৃষকদের একসময় জমি অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন তিনি নিজেই। তখন তিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আমন্ত্রণে একদল শিখ সম্প্রদায়ের কৃষক কচ্ছের অনুর্বর জমিতে বসবাসের জন্য আসেন। নিস্ফলা জমিকে ঘাম ঝরিয়ে নিজদের শ্রমে উর্বর জমিতে রূপান্তরিত করে চাষের কাজ শুরু করেন তারা। প্রবাদ আছে পঞ্জাবীরা উর্বর অথবা অনুর্বর জমি খালি দেখলেই তারা চাষ আবাদ শুরু করে দেবেন। সম্প্রতি দিল্লির বিক্ষোভস্থলের পাশে ফুলকপি, বাধাকপি চাষ করছেন আন্দোলনরত পঞ্জাবের কৃষকরা। যে ছবি টুইটারে পোস্ট করা হয়েছে।  

প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী শিখ কৃষকদের কচ্ছের তালুকা অঞ্চলে থাকার জন্য শুধুমাত্র আমন্ত্রণ জানিয়েই নিজের দায়িত্ব থেকে সরে  আসেননি। একজন যোগ্য এবং জাতীয় অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছিলেন। প্রত্যেককে নিজের নিজের জমির মালিকানার স্বত্বাধিকারীর কাগজের বা লিজ দলিলের ব্যবস্থা করে দিয় গিয়েছিলেন। সেই ভিত্তিতে ওই অঞ্চলে বহু শিখ কৃষক পরিবার বসবাস শুরু করেন। এবং চাষের কাজও শুরু করেন। নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী সেই সময় কচ্ছের তালুকার কৃষকরা নিজেদের জমি থেকে উচ্ছেদের নোটিস পান। তৎকালীন গুজরাতের মোদীর সরকার শিল্পপতিদের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিল। কৃষকরা গুজরাত হাইকোর্টে মামলা করেন। মামলায় রাজ্য সরকার হেরে যায়। হাইকোর্ট কৃষকদের পক্ষে রায় দেয়। হাইকোর্টের রায়ের পরে গুজরাত সরকার মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পরামর্শে সুপ্রীম কোর্টে মামলা করে।

নিজের রাজ্য গুজরাতের কচ্ছে গিয়ে শিখ কৃষকদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি যে ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন, সেটা যে আদৌ ঠিক নয় সেই খবর সম্প্রতি ফাঁস করে দিয়েছে একটি তদন্ত রিপোর্ট। হিন্দি ওয়েবসাইট জুনপুথ ও ন্যাশন্যাল হেরাল্ড যৌথভাবে তদন্ত করে আসল তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর ন্যাশন্যাল হেরাল্ড পত্রিকার পলিটিকাল ব্যুরো অন লাইন যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল, সেই রিপোর্টের কিছুটা অংশ তুলে দিলাম।     

A joint investigation by a Hindi website Junputh and NH revealed that those who met the PM during his Kutch visit were BJP activists from Sikh community, not farmers. And the topic of the discussion was not even related to the protest but the construction of a Gurudwara in Lakhpat Taluka in Kutch region.

The person who led the delegation of the so-called farmers is BJP general secretary of Kutch zone – Raju Bhai Sardar. Donning an orange turban, Raju Sardar can be seen sitting in front of the PM in the picture tweeted out by the news agency ANI on December 15.

১৬ ডিসেম্বর আজতক টিভি একটি খবর করেছিল প্রধানমন্ত্রীর গুজরাত সফর নিয়ে। ১৭ ডিসেম্বর টুইটারের সেই খবরের একটি অংশ আমারা দেখি। খবরে দাবি করা হয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছিল এমন একজন কৃষক জানায়, ১৫ ডিসেম্বরের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী তিনটি কৃষি আইন নিয়ে কোনও আলোচনাই করেননি। নতুন একটি গুরুদ্বার তৈরি করার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এই খবরটির সঙ্গে আমরা একটি ভিডিও ফুটেজও দেখি।    

প্রধানমন্ত্রী সেদিনের অনুষ্ঠানে যে দাবি করেছেন, সেটা খুব কিছু নতুন নয়। এর আগে একাধিকবার তিনি কৃষক আন্দোলনে বিরোধীদের উস্কানি আছে বলে অভিযোগ করেছেন। তাঁর সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা এবং বিজেপি নেতারা কৃষক আন্দোলনে খালিস্তানি যোগ, টুকরে টুকরে গ্যাং, পাকিস্তান, চিন এবং অতি বামদের তথা মাওবাদী প্রভৃতি শক্তির হাত আছে বলে দাবি করেছেন। একেকজন বিজেপি নেতা একেকরকম ভাবে অভিযোগের ধারাপাত শুনিয়েছেন।

দিল্লি-সিঙ্ঘু সীমান্তে আন্দোলনরত কৃষক নেতারা প্রধানমন্ত্রীর কথাকে গুরুত্ব দিতে চাননি। তাঁদের বক্তব্য, ‘প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন কি বাত’ বলছেন। কিন্তু চাষিদের কথা শোনার সময় তাঁর নেই। ফিকির বার্ষিক সভায় গিয়ে শিল্পমহলকে কৃষিতে লগ্নির আহ্বান জানাচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘শিল্পপতিদের লগ্নির জন্য কৃষি ক্ষেত্র খুলে দেওয়া হয়েছে।’ এই ঘটনা থেকে কী বোঝা যায়? কৃষকরা ষড়যন্ত্র করছেন না প্রধানমন্ত্রী নিজেই আন্দোলন ভাঙার বিভিন্ন কৌশল নিচ্ছেন? কৃষক সভার নেতা হান্নান মোল্লা অভিযোগ করছেন, সরকার কৃষকদের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে। পঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকরা একসঙ্গে আন্দোলন করছেন বলে তাঁদের মধ্যে ফাটল ধরাতে শতদ্রু-যমুনা সংযোগকারী খালের বিতর্কিত প্রসঙ্গও ফের সামনে আনা হচ্ছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি বলেছেন, ‘’মোদী সরকারের কাছে আন্দোলনকারী ছাত্রেরা দেশদ্রোহী, উদ্বিগ্ন নাগরিকেরা শহুরে নকশাল, পরিযায়ী শ্রমিকেরা কোভিড বহনকারী, ধর্ষণে নির্যাতিতারা কেউ নন, আন্দোলনকারী চাষিরা খালিস্তানি। প্রিয় বন্ধু হল মুনাফাখোর শিল্পপতিরা।‘’

আন্দোলনরত কৃষকদের আরও অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী মোদী লোকদেখানো একাধিক বৈঠক করতে পারেন। মধ্যপ্রদেশের কৃষকদের সঙ্গে ভিডিও-বার্তা করতে পারেন। গুজরাতে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। তাঁর অনুগত ‘গোদী মিডিয়া’ সেই বৈঠকের খবরও করে। দিল্লির ৩.৪ ডিগ্রির কনকনে ঠান্ডায় যে কৃষকরা তিন কৃষি বিল বাতিলের দাবিতে দিন-রাত্রি রাস্তায় বসে আছেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করার সময় পান না। ঠান্ডায় ৩০ জন কৃষকের মৃত্যুর পরেও প্রধানমন্ত্রী মোদী আন্দোলনরত ভারতের ‘অন্নদাতা’-দের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন না। গুজরাতের যে কৃষকদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করলেন বলে দাবি করা হয়েছে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় সেই কৃষকদেরই তিনি জমি থেকে উচ্ছেদের নোটিস ধরিয়েছিলেন। এর থেকে কী প্রমাণ হয় না কে বা কারা ষড়যন্ত্র করছে? আন্দোলনরত কৃষকদের সঙ্গে?   

                            (লেখাটি ২৫ ডিসেম্বর ‘সপ্তাহ’ পত্রিকায় প্রকাশিত)                    

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?