কোর্টের রায়ে কী আমাদের ভবিষ্যৎ খুঁজে পাব, প্রশ্ন হবু শিক্ষকদের






দীপেন্দু চৌধুরী

সেদিন ছিল ১২ ডিসেম্বর। ফোনটা পেলাম। সুবীর মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) নামে একজন ফোন করেছিল। আমি সুবীরকে ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে রাখার কথাও নয়। কারণ সে তিন-চার বছর আগে একদিন আমার বাড়ি এসেছিল। সঙ্গে আরও দু’জন ছিল।  সুবীর ফোনে বলল, ‘দাদা এখন আপনি বিশ্বাস করছেন তো? হাইকোর্টের রায়ের পরে। আমরা যখন আপনাকে বলতে গিয়েছিলাম আপনি হয়ত বিশ্বাস করতে পারেননি। আপনার মনে আছে? আমি আরও দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে আপনার বাড়ি গিয়েছিলাম। প্রাথমিক স্কুলে চাকরির জন্য আমারা ঘুষ দিয়েও চাকরি পাইনি।’ সুবীরকে বলেছিলাম, খবরটা পড়লাম।

আমি মনে করতে পারছি বছর চারেক আগে সুবীর দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। যদি ওদের জন্য আমি কিছু করতে পারি। সুবীরদের অনুযোগ বা অভিযোগ ছিল ওরা বছর চারেক আগে স্থানীয় এক নেতাকে প্রাথিমক স্কুলে চাকরির জন্য কয়েক লক্ষ টাকা দিয়েও চাকরি পায়নি। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের ওরা ১০-১২ জন যৌথভাবে টাকা দেওয়ার অভিযোগ করে। শাসক দলেরই এক মাঝারিস্তরের নেতা ওদের থানায় অভিযোগ জানাতে বলে। ওরা থানায় গেলে অফিসার বলেন, আপনারা ঘুষ দিয়ে আবার থানায় এসেছেন অভিযোগ জানাতে? সুবীররা কয়েকদিন পরে ফের আবার থানায় যায়, এবার সবাই একসঙ্গে যায়। থানার আইসি ওদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। একটা প্রাথমিক অভিযোগ লিখিতভাবে থানা সেদিন নেয় এবং তদন্তও শুরু করে। তৃণমূল কংগ্রেসের ব্লকস্তরের যে নেতা টাকা নিয়েছিল তাকে থানায় ডেকে জিঞ্জাসা করা হয়। সে অভিযোগ কবুল করে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় টাকা ফেরৎ দিয়ে দেবে।

সুবীর সেদিন আমাকে বলেছিল, ওই দিনের পরে থানার আইসির কাছে দু’জন বড় বড় কেন্দ্রীয় নেতার             ফোন আসে। তারপর তদন্ত বন্ধ হয়ে যায়। সুবীরের মুখের কথায় বিশ্বাস করা কঠিন কারণ ও কোনও প্রমাণ আমাকে দেখাতে পারেনি। সম্প্রতি হাইকোর্ট রায় দিয়েছে, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া অবৈধ। ১১ ডিসেম্বর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য নির্দেশ দিয়েছেন, প্যানেল ও মেধা তালিকা বাতিল করতে হবে। ২০১৬ সালের বিঞ্জপ্তি অনুযায়ী ফের ‘ভেরিফিকেশন’ বা তথ্য যাচাইয়ের কাজ শুরু করতে হবেআগামী বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে এই প্রক্রিয়া রাজ্য সরকারকে শেষ করতে হবে।

একটি সংবাদ পত্রের খবরে প্রকাশ, রায়গঞ্জের হেমতাবাদ করণদিঘির তৃণমূল নেতাদের ফোন বন্ধ, তারা বাড়িতেও নেই। রায়গঞ্জ থেকে সাংবাদিক বিশ্বনাথ সিংহ লিখছেন, ‘চার বছর আগেই আপার প্রাইমারিতে চাকরির জন্যে বামনগ্রাম, আটকড়া, কেশবপুরের শতাধিক যুবক জমি বিক্রি করে টাকা দিয়ে রেখেছিলেন। ভোটের আগেই শিক্ষকতার চাকরি হবে। সেই আশায় দিন গুনছিলেন। শুক্রবার বিকেলে রাজ্য সরকারের গালে আবার বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়। আপার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগের প্যানেল ও মেধা তালিকা সম্পূর্ণ বাতিল করল কলকাতা হাইকোর্ট। এই খবরের পরেই কেশবপুরের কয়েক জন চাকরিপ্রার্থী এলাকার তৃণমূল নেতার বাড়িতে গিয়েও দেখা পেলেন না। হতাশ হয়ে হন্যে হয়ে খুঁজেছেন ওই নেতাকে। চাকরি তো হবে না, অন্তত জমি বিক্রির টাকাটা ফেরতের আশায় ছুটে গিয়েছেন।‘’

উচ্চ প্রাথমিকের নিয়োগে যে দুর্নীতি হয়েছে সেই বিষয়ে অনেক অনেক মামলা হয়েছে। ২০১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নিয়োগ বিঞ্জপ্তিতে বলা হয়েছিল, টেট পাশ, স্নাতক স্তরে ৫০% নম্বর ও বিএড ডিগ্রি বাধ্যতামূলকভাবে লাগবে। শিক্ষক প্রার্থীদের টানা আন্দোলনের পরে ২০১৯ সাল থেকে নিয়োগ শুরু হয়। কিন্তু এর পরেই আবারও হয় মামলা। মামলা চলাকালীন স্কুল সার্ভিস কমিশন মেধা তালিকা প্রকাশ করে।

২০১৭ সালের মে মাসে একটি মামলায় কলকাতা হাইকোর্টে সমালোচনার মুখে পড়েন রাজ্য স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য। বিচারপতি রাজীব শর্মা সেই মামলার শুনানিতে বলেছিলেন, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে একাধিক মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন। তবুও কমিশন কোর্টের নির্দেশ ঠিকমতো মানছে না। আদালতের নির্দেশ কমিশন না মানায় মামলার নিষ্পত্তিও করা যাচ্ছে না। বিচারপতি শর্মা স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানকে তিরস্কৃত করে বলেন, আদালতে মামলার সঙ্গেই ঝুলে রয়েছে পরীক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ।  

কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য উচ্চ প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে ১১ ডিসেম্বর যে রায় দিয়েছেন তার মূল বক্তব্য, যে সব প্রার্থী ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল স্কুল সার্ভিস কমিশন’ ( সিলেকশন ফর অ্যাপয়েন্টমেন্ট টু দ্য পোস্টস অব টিচার্স ফর আপার প্রাইমারী লেভেল অব স্কুলস) ১২ (২) ধারা ২০১৬ অনুযায়ী যোগ্যতা পরীক্ষায় পাস করেছে তাদেরই ডাকতে পারবে রাজ্য শিক্ষা দফতর।

বিচারপতি ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণ , "This Court is of the view that a selection process where the irregularities are stark and have not been accounted for, cannot be permitted to proceed or reach closure. This would mean that candidates whose academic and professional credentials have not been fairly evaluated or have not been evaluate or have not been evaluated at all, would be excluded from a fair process till the next State Level Selection Test, whenever that is announced," ( Courtesy: Live Law.in)

 উচ্চ প্রাথমিকে যে সব মামলা হয়েছিল, সেই মামলার আবেদনকারীদের আইনজীবী ছিলেন দু’জন। বিকাশ ভট্টাচার্য এবং সুদীপ্ত দাশগুপ্ত। হাইকোর্টে তারা সওয়াল করেন। আবেদনকারী দু’ই আইনজীবীর অভিযোগ, পুরো প্রক্রিয়ায় কোথাও ঠিকমত নিয়ম মেনে কাজ হয়নি। যোগ্য প্রার্থীদের সুযোগ দেওয়াই হয়নি। কারও কারও বিএড সার্টিফিকেট নেই তবু সুযোগ পেয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে টেটের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে

পুরনো প্যানেল এবং মেধা-তালিকা বাতিল করে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ ২০২১-র ৪ জানুয়ারি আবার নতুন করে ‘ভেরিফিকেশন’ বা যাচাই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এবং ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। মহামান্য আদালত এই রায় দিয়েছে। কিন্তু সামনে বিধানসভা ভোট থাকার জন্য এই প্রক্রিয়া কি আদৌ  সম্ভব হবে? প্রশ্ন তুলছেন অনেক প্রার্থীই। উচ্চ প্রাথমিকে শূন্য পদের সংখ্যা ১৪, ৩৩৯ । প্রার্থীদের কেউ কেউ  বলছেন, নতুন করে যাচাই (ভেরিফিকেশন) প্রক্রিয়া শুরু হলে প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার প্রার্থীর তথ্য যাচাই করতে হবে। পুরো প্রক্রিয়া করোনা আবহে অন-লাইনে সম্ভব হবে না। কারণ গ্রামাঞ্চলে নেট-ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়াই যায় না। এই ক্ষেত্রে যে সব প্রার্থী রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকেন তারা কি করবেন?  একাধিক উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের দাবি,  আগামী বছরের হয় ফেব্রুয়ারি না হলে মার্চের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে পারলে ভালো মামলা এবং দুর্নীতির কানা ডোবায় জেরবার চাকরি প্রার্থীরা। তাঁদের নতুন করে আশঙ্কার কালো মেঘ ঘনাচ্ছে, রাজ্য সরকারের এসএসসি কতৃপক্ষ কি এই রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে যাবে?  আট আটটা বছর নবান্নের পাশের গঙ্গা দিয়ে জল বয়ে গেছে অনেক। শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। হাইকোর্টের রায়ের পরে নতুন করে আশার আলো দেখছেন উচ্চ প্রাথমিকের শিক্ষকপদ প্রার্থীরাহাইকোর্টের ঐতিহাসিক এই রায় কি তাঁদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে? দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ছেয়ে আছে তাঁদের মনে। স্কুল সার্ভিস কমিশন ডিভিশন বেঞ্চে যাবে কি যাবে না সেটা এ পর্যন্ত জানা যায়নি।

বিধানসভার ভোটকে পাখির চোখ করে এগচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। স্বাস্থ্য সাথী সহ গুচ্ছ নতুন সামাজিক প্রকল্প ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই ভোটের আগে শিক্ষকদের বিরাগভাজন হয়ে আবার একটা মামলার সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবসম্মত হবে সেটা সরকার এবং দলকেও নিশ্চয়ই ভাবাচ্ছে আশা করা যায় 

                           (এই লেখাটি ১৮ ডিসেম্বর ‘সপ্তাহ’ পত্রিকায় প্রকাশিত)         

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?