ভিক্ষা নয় কৃষকরা সম-মর্যাদা চায়






দীপেন্দু চৌধুরী

বুধবার (৯ ডিসেম্বর) বেলা গড়াতেই টুইটারে প্রথম ব্রেকিং পাওয়া গেল, ক্রান্তিকারী কিসান ইউনিয়নের সভাপতি দর্শন পালের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সরকারের দেওয়া সমঝোতা প্রস্তাব খারিজ করছি।’ অবস্থান বিক্ষোভস্থল থেকে  আন্দোলনের নতুন স্লোগান উঠেছে ‘’সরকার কি আসলি মজবুরি-আদানি, আম্বানি জমাখোড়ি’’। তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে প্রবল শীতে ১৪ দিন ধরে টানা দিল্লির পথ অবরোধ করে রেখেছে ভারতীয় কৃষকদের ৫০০ সংগঠনের কয়েক লাখ কৃষক।

তিন কৃষি আইনের ২০ পৃষ্ঠার যে পোশাকী সংশোধনী মোদী সরকারের তরফে ৯ ডিসেম্বর দেওয়া হয়, তাতে দেখা যায় সরকার নতুন কথা কিছু বলেনি। আইনে সংশোধন করতে সরকার রাজি বলে গত কয়েকটি বৈঠকে কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমর এবং খাদ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল জানিয়েছিলেন। কিন্তু রিপোর্ট আসার পরে দেখা যায়, কৃষকদের দাবি সমূহের কোনও কিছুই মোদীর সরকার নতুন সংশোধনীতে সংযুক্ত করেনি। এমএসপি-র থেকে কম দামে বহুজাতিক সংস্থার প্রতিনিধিই হোক অথবা ফোড়ে পণ্য কিনতে পারবে না। এদিন সরকারের পাঠানো পোশাকী প্রস্তাবেও এই বিষয়টা আইনে নথিভুক্তি করতে সরকার রাজি হয়নি। নতুন আইনবলে প্যান কার্ড থাকলেই যে কেউ ব্যবসা করতে পারবে। সরকারের দাবি এই সব ব্যবসায়ীদের নথিভুক্ত করে স্থানীয় পরিস্থিতির মানদণ্ডে বিধি তৈরির অধিকার রাজ্য সরকারকে দেওয়া হতে পারে। কৃষক নেতৃত্বের আশঙ্কা এই ধারাতেও গলদ আছে।

কারণ নতুন আইনে কৃষকদের দেওয়ানি আদালতে মামলা করার অধিকার দেওয়া হয়নি। কৃষকদের কোনও অভিযোগ থাকলে শুধুমাত্র মহকুমা শাসকের অফিসে নিষ্পত্তির জন্য অভিযোগ জানাতে পারবে। যদিও কেন্দ্র বলেছে, আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে দেওয়ানি আদালতে মামলার অধিকার কৃষকদের দিতে সরকার রাজি আছে। কেন্দ্র আরও বলেছে, চুক্তি চাষের কারণে কৃষকের জমি বেহাত হতে পারে এমন আশঙ্কা যে তৈরি হয়েছে সেটা ঠিক নয়। তবু কৃষক সংগঠনগুলি চাইলে, সরকার আইনে লিখে দেবে কৃষি জমির ভিত্তিতে কৃষি পণ্যের কোনও ক্রেতা ঋণ নিতে পারবে না। কৃষকদের মাথাতেও এই ধরণের কোনওরকম শর্ত চাপানো যাবে না।

সরকারের প্রস্তাব খতিয়ে দেখে কৃষক নেতৃত্ব বলছে, এই প্রস্তাবেও সরকারের কৌশলী অবস্থান খুব পরিষ্কার। বলা হচ্ছে, চুক্তি চাষের জন্য চিহ্নিত জমিতে কোনওরকম নির্মাণকাজ করা হলে তার জন্য ঋণ পাওয়া যাবে না। পরের  পরিচ্ছেদেই বলা হচ্ছে, চাষির সঙ্গে চুক্তি চাষের মেয়াদ শেষ হলেই ওই নির্মাণে চুক্তিকর্তার কোনওরকম অধিকার থাকবে না। কৃষক নেতাদের অভিমত, ঋণ নেবার পরিচ্ছেদেই এই ধারাকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। আসল ঘটনা হচ্ছে, চুক্তি চাষের ক্ষেত্রে যে কোন সময় শর্ত পরিবর্তনের সুযোগ আইনে দেওয়া আছে। সেই শর্ত পরিবর্তন এমন কৌশলে করা হবে কৃষক বাধ্য হয়েই জমি ছেড়ে দেবে। ছোট জোতে চুক্তি চাষ সম্ভব নয়, তাই বহুজাতিক সংস্থাগুলি অধিক পরিমাণ জমি নিয়েই চুক্তিচাষে আগ্রহী। এর থেকে অনুমান করা যায় বৃহৎ সংস্থাগুলির লক্ষ কৃষকের জমি গ্রাস করার।

সরকারের মোদ্দা কথা, যৌথ তালিকার ৩৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী চুক্তি চাষ, রাজ্যের মধ্যে এবং আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য নিয়ে আইন করার অধিকার কেন্দ্রের আছে। সংগঠনের নেতাদের একটা আশা জন্মেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকের পরে। কৃষক নেতা শিবকুমার কাক্কা জানিয়েছেন, ‘’আমরা মঙ্গলবার রাতের বৈঠকে অমিত শাহকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনারা অধ্যাদেশ আনলেন, সংসদে বিল আনলেন, তার আগে কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করলেন না কেন? উনি বলেন, ‘’ভুল হয়ে গিয়েছে। এখন সবাই মিলে ভুল শোধরাতে হবে।‘’ ৯ ডিসেম্বর বেলা আড়াইটা নাগাদ কৃষি মন্ত্রকের যুগ্মসচিব বিবেক আগরওয়ালের পোশাকী সংশোধনীর চিঠি কৃষক নেতারা পায়। 

সূত্রের খবর, কৃষিবিল সংসদে পাস হওয়ার আগেই আদানি গোষ্ঠী দেশের সমস্ত রাজ্যে কৃষিপণ্য মজুত করারা জন্য আগাম রেজিস্ট্রেশন করিয়ে রেখেছে। যাতে বিনা বাঁধায় নতুন কৃষি আইনবলে কৃষিপণ্য মজুত করা যায়। তিনটি আইনের মধ্যে অত্যাবশকীয় পণ্য আইন প্রসঙ্গে সরকার একেবারে নীরব। এই আইনের কোনও ধারায় সরকারের পোশাকী প্রস্তাবে সংশোধনী আনার পরিকল্পনার কথা বলা হয়নি। এমনভাবে আইন আনা হয়েছে, যার ফলে বিপুল পরিমাণ মজুতদারি এবং কালো বাজারির সুযোগ থেকে গেছে। আন্দোলনের নেতৃত্বের সংশয় এরপরে মোদী সরকার নতুন কৃষি আইন বাতিল করার মত সাহস দেখাতে পারবে? কারণ আদানি-আম্বানী গোষ্ঠীর সঙ্গে অলিখিত বোঝাপড়া হয়েই রয়েছে।            

৯ ডিসেম্বর বুধবার থেকে কৃষক আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে। নতুন উদ্যোগে আন্দোলনের ডাক দিল কৃষকরা।  আন্দোলনের  কৃষক সংগঠনের নেতৃত্ব জানাচ্ছেন, বহুজাতিক সংস্থা অম্বানী-আদানি গোষ্ঠীর মতো যে সব সংস্থাকে বিশেষ ফায়দা পাইয়ে দিতে কৃষি আইন আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আরও তীব্র আন্দোলনে যাচ্ছি আমরা। ৯ ডিসেম্বরের ডাক শুনে মনে হচ্ছে আন্দোলনরত কৃষকদের অনড় মনোভাবের কথা প্রবল শীতেও তারা বিক্ষোভ  আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করতে চাইছে। ১২ ডিসেম্বর সারা দেশের টোলপ্লাজাগুলোকে টোল মুক্ত প্লাজা করে দেওয়ার ডাক দেওয়া হয়েছে। টোল প্লাজায় কোনও রকম পথকর নিতে দেবেন না আন্দোলনরত কৃষকরা। ওই একই দিনে দিল্লি জয়পুর হাইওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে।

১৪ ডিসেম্বর উত্তর ভারতের সমস্ত চাষিদের ‘দিল্লি চলো’-র ডাক দেওয়া হয়েছে। কৃষক নেতৃত্বের ঘোষণা, রিলায়্যান্স, আদানি গোষ্ঠীর সুপার মার্কেট, শপিং মল, পেট্রল পাম্পের সামনে পিকেটিং করা হবে। জিয়ো গোষ্ঠীর মোবাইল পরিষেবা বয়কটের ডাকও দেওয়া হয়েছে। সারা দেশের বিজেপির জেলা এবং রাজ্য অফিস ঘেরাও করবে কৃষকরা।  কেন্দ্র ভারতীয় ‘অন্নদাতা’-দের পেটে লাঠি মেরে তিনটে কৃষি আইন আনতে পারবে না বলে জানাচ্ছেন কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব। কৃষক সংগঠনের পক্ষে দাবি করা হয়েছে, সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না আইন প্রত্যাহারের আশ্বাস দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন তুলে নেওয়া সম্ভব নয়। তারা আলোচনা করলেও পরিস্থিতি যেখানে পৌঁছেছে আম- কৃষকেরা সমঝোতা মানতে চাইবে না। গত ১৪ দিনে আন্দোলন চলাকালীন পাঁচজন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। ৯ ডিসেম্বরের প্রবল শীতে দিল্লি-হরিয়ানার সিংঘু সীমানার বিক্ষোভস্থল থেকে মৃতদেহ পাওয়া গেল এক কৃষকেরহরিয়ানার সোনীপতের ৩২ বছরের কৃষকঅজয় মোরে প্রবল শীতে মারা যান। গত ১০ দিন ধরে দিল্লির প্রবল শীতে অজয় শুচ্ছিলেন জাতীয় সড়কে রাখা একটি ট্রলির উপরে। সোনীপতের চিফ মেডিক্যাল অফিসার জানাচ্ছেন, প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে, প্রবল শীত সহ্য করতে না পেরেই অজয়ের মৃত্যু হয়েছে। সাধারণ গরিব কৃষকদের এইতো শারীরিক হাল। তবুও সরকারের টনক নড়ছে না। সেই কারণেই  ৮ ডিসেম্বরের বৈঠকে কৃষক নেতারা অমিত শাহকে বলেছিলেন, ‘আপনি গিয়ে কৃষকদের বোঝান আন্দোলন তুলে নেওয়ার জন্য।’   

কেন্দ্রের তরফে আশ্বাস, কৃষকদের আশঙ্কার বিষয়গুলি খোলা মনে বিবেচনা করতে সরকার তৈরি আছে। কৃষকরা আন্দোলন প্রত্যাহার করুন। কেন্দ্রের পোশাকী প্রস্তাব খারিজ করে কৃষক সংগঠনগুলি জানিয়ে দিয়েছে, তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে হবে। এবং বিদ্যুৎ বিল নিয়ে এগনো চলবে না।

পাশাপাশি ৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের কাছে কৃষি আইনের বিরোধিতা সংক্রান্ত স্মারকলিপি জমা দিতে যান বিরোধী জোটের পাঁচজন প্রতিনিধি। এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ার, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআইয়ের ডি রাজা, ডিএমকের ইলানগোভান এবং কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি। রাষ্ট্রপতিভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের রাহুল বলেন, ‘’আমি কৃষকদের বলেছি, যদি আজ আপনারা দৃঢ় না থাকেন, তা হলে আর কখনও সুযোগ পাবেন না। আমরা আপনাদের সঙ্গে রয়েছি। আপনারাই হিন্দুস্থান।‘’

পঞ্জাবের অর্থমন্ত্রী মনপ্রীত সিংহ বাদল ৯ ডিসেম্বর বলেন, ‘’মোদী সরকার ভাবতেই পারে তারা অনেক ভালো কিছু করছে। কিন্তু ভারতীয় কৃষকদের যেন কৃষি-খামার বিষয়ে শেখাতে না আসে। ভিক্ষা নয় কৃষকরা সম-মর্যাদা চায়।‘’  

 

                                              (এই লেখাটি ১১ ডিসেম্বর ‘সপ্তাহ’ পত্রিকায় প্রকাশিত)                   

                       

                                                

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?