ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন দর্শনে বিশ্বাস করতেন না
দীপেন্দু চৌধুরী
শিল্পের জন্য
জীবন না জীবনের জন্য শিল্প? এই বিতর্ক মানবসভ্যতা যতদিন থাকবে বিতর্কও ততদিন
থাকবে। পণ্যসংস্কৃতি গতিশীল জীবনের হাতছানি দেয়। আলোআঁধারী মায়াবী এক পরিচ্ছেদ
খুলে রাখে নতুন শিল্পীদের জীবন অধ্যায়ে। সিনেমা, নাটক, সাহিত্য প্রতিটি শাখায় এই
প্রলোভন বিপুল অর্থের, সামাজিক প্রতিষ্ঠার ঝলমলে আকাশ খুলে দেয়। হয়ত তারপর মোহ ভাঙে।
কারও ক্ষেত্রে ভাঙে কেউ কেউ তথাকথিত ঝলমলে আলোয় পেন্ট করা জীবনের রঙিন মঞ্চকেই
নিজের মঞ্চ বলে মেনে নেয়। এবং মান্যতা দেয়। না প্রকৃত যারা শিল্পী তারা বাণিজ্যিক
সিনেমা বা নাটকে অভিনয় করলেও ‘মানুষের জন্য শিল্প’ এই মূল্যবোধে বিশ্বাস হারান না।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হচ্ছেন সেই ‘মানুষের জন্য শিল্প’ এই মূল্যবোধে বিশ্বাস করা
শিল্পী। তিনি আমৃত্যু এই বিশ্বাস নিয়ে যাপন করেছেন। সেইজন্যই সৌমিত্র
বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষিত
বামপন্থী’! এই প্রসঙ্গে আমরা আবারও ফিরব।
ব্যক্তিগতভাবে
আমার সঙ্গে তেমন পরিচয় ছিল না। আমি আজ থেকে ৩৮ বছর আগে ‘বাংলার অপু’কে সামনে থেকে
দেখি। তখনও তিনি সারা ভারতের ‘ফেলুদা’ হয়ে ওঠেননি। ‘ক্ষিদ্দা’ হবেন আরও অনেক অনেক
পরে। এবং সত্যি করেই সৌমিত্র অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েও সমাজের ‘ক্ষিদ্দা’ হয়ে
উঠেছিলেন।
অনেকেই বলছেন।
বিশেষত সংবাদ-সাহিত্য জগতের প্রথমসারির ঋত্বিক যাদের বলা হয়। তারা কফি হাউসে সৌমিত্র
চট্টোপাধ্যায়ের আড্ডা দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলছেন। আমি বা আমার সমসাময়িক যারা, তারা কফি
হাউসে মানুষের শিল্পীকে বার কয়েক দেখেছি। কথা বলার সুযোগও হয়নি। আমি চেষ্টাও
করিনি। আমাদের মূল্যবোধ বা উপলব্ধি ছিল আপনি বড় শিল্পী তাইতে আমরা হামলিয়ে পড়ব
এমনটা আমরা ভাবি না। সৌমিত্র তখন কফি হাউসে আসতেন মূলত ‘এক্ষণ’ পত্রিকার অন্যতম
সম্পাদক নির্মাল্য আচার্যের কাছে। কারণ সৌমিত্র নিজেও ‘এক্ষণ’ পত্রিকার
যুগ্ম-সম্পাদকের একজন ছিলেন। গত শতকের ষাটের দশকে নির্মাল্য আচার্য এবং সৌমিত্র
চট্টোপাধ্যায়ের যৌথ সম্পাদনায় মননশীল এবং অত্যন্ত উন্নত মানের লিটল ম্যাগজিন
‘এক্ষণ’ প্রকাশ হয়েছিল। তৎকালে সেই পত্রিকার চাহিদা ছিল গগনচুম্বী।
১৯৭৬ সালে একটি
সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র বলেছিলেন, ‘’আজ থেকে বার বছর আগে ‘এক্ষণ’ প্রথম বেরিয়েছিল।
তখন আর পাঁচজন উৎসাহী যুবকের মত আমরাও ভাবতাম কাগজ বের করব, লিখব, ইত্যাদি। তবে
পাকাপাকিভাবে কাগজ বার করার আইডিয়াটা আমার বন্ধু নির্মাল্যর। নামটা দিয়েছিলেন
সত্যজিৎ রায়।‘’
ওই একই
সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র জানাচ্ছেন, ‘’............... একটা খুব ‘ইন্টারেস্টিং’
ব্যাপার হোল আমরা মাণিকদার ‘শাখাপ্রশাখা’ বলে একটা চিত্র-নাট্যের কিছু অংশ
‘এক্ষণে’ ছেপে ছিলাম যেটা কোনদিন ছবি হয়নি। গল্পটা ওঁরই। এছাড়া আরও কয়েকটা
চিত্র-নাট্য আমরা বের করেছিলাম যেগুলোর মধ্যে আছে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘অশনি
সংকেত’,এবং ‘কাপুরুষ’। এ- ছাড়া ওঁর একটা খুব সিগনিফিকেনট লেখা আমাদের কাগজে
বেরিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের ওপর।...............।‘’ (আনন্দলোক ১৭ এপ্রিল, ১৯৭৬)
পাঠক মনে রাখবেন
‘শাখাপ্রশাখা’ পরে ছবি হয়েছে। এবং একটি ভিন্নধারার, ভিন্ন মাত্রার ব্যতিক্রমী
চরিত্রে সৌমিত্র অভিনয় করেছিলেন।
আজ থেকে ২০ বছর
আগে আমার নিজের সুযোগ হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার। সেদিন
আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি আমাকে চমকে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি নিজেও গ্রামের
কাদা-মাটি মেখে কলকাতায় এসেছেন। তাই মানুষের পাশে থাকতে ভালোবাসেন। একজন প্রকৃত
শিল্পীও মানুষের পাশে থাকতে চায় মানুষকে পাশে পেতে চায়।’ সৌমিত্র নিজের কবিতায়
লিখেছেন, ‘’পথে আজ বড় বেশি লোক/ মিছিলে কী খুঁজে পাবে হারানো বালক?’’ নাগরিক সাংবাদিকতায়,
নাগরিক সাহিত্যে, নাগরিক চলচ্চিত্রে, নাটকে ‘খারিজ’-র বালককে আমি আজও খুঁজছি।
নাগরিক কলকাতার ফুটপাথে। আর উচ্চারণ করছি ‘ফাইট কোনি ফাইট’।
যেমন করে একই
প্রেক্ষাগৃহে একজন শিল্পপতির কারখানার শ্রমিক ও বাংলার চাষি একসঙ্গে বসে নাটক
দেখে, সিনেমা দেখে। আলাদা আলাদা অনুভূতি এবং রুচি এবং মূল্যবোধের দোদুল্যমানতায় হয়
হাততালি দেয়। না হলে শোকে মুহ্যমান বিমূঢ় হয়। সমালোচকরা বলছেন, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে
শ্রেণিনিরপেক্ষ মানবিক ইন্দ্রিয়ানুভূতি খণ্ডিত এবং সীমিত। উন্নত মানব সভ্যতা এবং
বিশ্বায়ন উত্তর সাংস্কৃতিক গতিশীল বাজার দুই সভ্যতার মানুষকেই নিরন্তর টানছে।
শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য যে শিল্প সেই শিল্প চিরন্তন চিরায়ত হয় না। সেই শিল্পের
ঘনত্ব যৌনতার সূক্ষ্ম আবেদনের মধুময়তায় আকর্ষণ করে। ক্ষণস্থায়ী হয় তথাকথিত
‘শিল্পের জন্য শিল্প’-র সেই সৃষ্টি। মানুষের জন্য শিল্প আবহমান সময়ের মানদণ্ডে
লেখা হয়। চিরন্তন চিরায়ত শিল্পের দাবিতে। চলচ্চিত্র, নাটক সাহিত্যে এর ব্যতিক্রম
কখনও হতে আমরা দেখিনি।
বছর কয়েক আগে সিপিএম
দলগত অবস্থানের যখন ব্যাখ্যা করছে। দলকে ভারতীয় সংস্কৃতির মানদণ্ডে, ভারতীয় আত্মার
সঙ্গে একাত্ম করে মিলিয়ে নিজেদের ‘বিচ্যুতি’ খুঁজছে। অতি বামপন্থী না হলেও দেশের
কৃষ্টি, রিচুয়াল, স্বাধীনতার ইতিহাস, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মর্যাদা দেওয়া ইত্যাদি
বিষয়ে ভারতের প্রথমসারির বামপন্থী দলটির অভ্যন্তরে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ছিল।
জাতীয়তাবাদী কবি লেখক, সাহিত্যিকদের নিয়ে অবস্থানের ক্ষেত্রে এক প্রকারের দোদুল্যমানতা লক্ষ্য করা যেত। ভারতীয় মাটির
সঙ্গে নিজেদের অবস্থান এবং সত্তাকে মিলিয়ে দেওয়াতে এক রকমের তাত্বিক সীমারেখা টেনে দেওয়া হত। তারই
পুনঃমূলায়ন করে সিপিএম নামক ভারতের প্রথমসারির বামপন্থী দলটি। ঘোষিত বামপন্থী হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
একবার কোনও আলোচনাসভায় বলেছিলেন,
‘বামপন্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের বিচ্যুতিকে আমি সমর্থন করি না’।
ঠিক একই রকমভাবে
বাংলাদেশের স্কুলের পাঠ্যসূচী থেকে রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের লেখা বাদ দেওয়া
প্রসঙ্গে আমাকে টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘’বিষয়টা আমি ঠিক জানি না।
আমাকে খোঁজ নিতে হবে। তবে আমি এটা বিশ্বাস করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্রকে বাদ
দিয়ে বাংলা সাহিত্য হতে পারে না।‘’
Comments
Post a Comment