বিজেপি শাসিত রাজ্যে আসছে ‘জেহাদ’ ক্যাবিনেট!




দীপেন্দু চৌধুরী

ভারতে কী ‘’erosion of democracy’’  চলছে? কথাটা আমার নয় বলছেন নোম চমস্কি। তিনি অভিযোগ করেছেন, ‘’erosion of democracy’’ in India and the Citizenship Amendment Act (CAA). ৯১ বছরের প্রবীণ অধ্যাপক এবং প্রথম সারির চিন্তাবিদ তথা দার্শনিক নোম চমস্কিযিনি আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি এবং বর্ণবিদ্বেষ নীতির অন্যতম সমালোচক। ঘটনার সূত্রপাত কয়েক দিন আগে। টাটা গোষ্ঠী স্পনসর করে মুম্বই সাহিত্য উৎসবকে। করোনা কালে এই বছর মুম্বই সাহিত্য উৎসবে আচমকা নোম চমস্কি এবং সাংবাদিক বিজয় প্রসাদের অনলাইন আলোচনা বাতিল হয়ে যায়। ২০ নভেম্বর রাত ন’টার সময় চমস্কির নতুন বই নিয়ে অনলাইন আলোচনা হওয়ার কথা ছিল।

সেই আলোচনা বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। মুম্বই সাহিত্য উৎসবের ডিরেক্টর অনিল ধরকর কারণ হিসেবে জানিয়েছেন,  বাকস্বাধীনতাকে সম্মান দিলেও কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ বা উদ্দেশ্যকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হবে না। যদিও চমস্কি এবং বিজয় প্রসাদ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘’কেন আমাদের আলোচনা বাতিল করা হয়েছে, তার কারণ আমরা জানি না। ফলে আমরা কেবল জল্পনা করতে পারি বা প্রশ্ন তুলতে পারি যে এটা সেন্সরশিপ কি না?’’ অনলাইন এই আলোচনা বাতিল করে দেওয়ার ঘটনাতেও কি রাষ্ট্রের ভূমিকা আছে?

অধ্যাপক লেখক নোম চমস্কি এবং বিজয় প্রসাদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করার কারণ ভারতে এক জটিল সামাজিক অবস্থার মধ্যে আমরা বাস করছি। গত ছ’বছর দেশে অঘোষিত এক জরুরী অবস্থা চলছে কী? সংবাদ মাধ্যমের বাক স্বাধীনতা নেই। সমাজকর্মীদের সামাজিক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। স্বঘোষিত গোরক্ষকদের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে মৃত্যু হয়েছিল পেহলু খান এবং আকবর (ওরফে রাকবর) খানের। এই ঘটনা এবং দাদরি-হাথরস-র ঘটনার মন্থন করলে উঠে আসছে এক ভয়াবহ চিত্র। দলিত- মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর ধারাবাহিক আক্রমণ। যে ঘটনা আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে আমরা এক অসহিষ্ণু, ধর্মান্ধ ভারতে বাস করছি। ভারতের এসব ছবি নিকট অতীতে আগে কখনও দেখা যায়নি। গত কয়েকবছরে নতুন বাতাবরণের ভাষা আমাদের চিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী ‘বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য’ ভারত আত্মার মন্ত্র উচ্চারণ করতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। আজ সেই সংস্কৃতি ভেঙেচুরে খানখান। সমাজ সভ্যতায় আকস্মিক এক ভয়ের পরিবেশ। সন্দেহের পরিবেশ। নির্দিষ্ট একটি ধর্মের মানুষদের আক্রমণের ধারালো ফলার সামনে রাখা হচ্ছে।

সম্প্রতি ‘গো ক্যাবিনেট’ গঠন করেছে বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশ সরকার। দেশে গত কয়েক বছরে ‘গো হত্যা’ নিষিদ্ধ করার দাবিতে একদল ‘গোরক্ষক’ তান্ডব চালিয়েছে। অমানবিক আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে কয়েক জনের। আদালতের রায়ে বর্তমানে এই আক্রমণ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে। তবু মানুষের ভয়। এরই মধ্যে তথাকথিত ‘লাভ জেহাদ’ রুখতে আইন আনতে চলেছে বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশ সরকার। পরে একই আইন আনতে চাইছে বিজেপি শাসিত অন্যান্য রাজ্য যেমন কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা এবং বিহার। বিহার নিয়ে যদিও দ্বিধায় পদ্ম-শিবির। কারণ শরিক দল জেডিইউ-র মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার। গত কয়েক বছরের অভিঞ্জতা বলছে, বিহারের কট্টরপন্থী বিজেপি নেতাদের অভিযোগ নীতিশ কুমারের সরকার মুসলিম তোষণ করছে। ২১ নভেম্বর নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র বেগুসরাইয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ বলেন, ‘’লাভ জেহাদ দেশের সামনে বিপদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজ সামাজিক ঐক্য রক্ষার পক্ষে এটা ক্যানসারের মতো। অনেক রাজ্যই এর বিরুদ্ধে আইন আনতে চলেছে। ‘লাভ জেহাদ’ রুখতে বিহার সরকারেরও আইন আনা উচিত।‘’ শিবসেনা সাংসদ সঞ্জয় রাউত এনডিটিভিকে বলেছেন, ‘’প্রথমে নীতিশ কুমার ‘লাভ জেহাদ’ আইন আনুক তারপর  মহারাষ্ট্র সরকার ভাবনা চিন্তা করবে।‘’  

 

‘বিয়েতে ধর্ম নয় মানুষই সত্য’

খুব সম্ভবত ২০০৭ সাল থেকে ‘লাভ জেহাদ’ নামক এক বিশেষ আন্দোলন শুরু করে বিজেপি। যদিও তার অনেক আগে ‘ ভ্যালেন্টাইনস ডে’ বা প্রেম দিবসের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রচার কর্মসূচী ছিল হিন্দুবাদী দলটির। বহু প্রেমিকযুগলকে আক্রমণও করা হয়ে থাকে ফেব্রুয়ারি মাসের ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-র দিন। তারপরে শুরু হয় ‘লাভ জেহাদ’ স্লোগান। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সমাজকর্মীদের অভিযোগ কে কার সঙ্গে প্রেম করবে সেটা সরকার ঠিক করে দেবে? যে মহিলা উচ্চ শিক্ষিত। যার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে তার নিজের স্বাধীনভাবে বিয়ে করার অধিকার থাকবে না?

একজন হিন্দু মেয়ে মুসলিম ছেলেকে প্রেম করে বিয়ে করলে পাঁচ বছর আগেও কোনওরকম সমস্যা ছিল না। দুই সম্প্রদায়ের বহু  পরিবার এই সম্পর্ক মেনে নিয়ে অনুমোদন দিয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান গড়ে ওঠে। ভাব বিনিময় হয়। এই সম্পর্ক বৃহত্তর সমাজের কাছে পৌঁছতে আহ্বান জানায়। গত পাঁচ বছর ‘লাভ জেহাদ’ নামক সমস্যার নামে সামাজিক জীবন জটিল হয়ে উঠে আসছে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের প্রশ্ন একুশ শতকে দাঁড়িয়ে আমদের ‘লাভ জেহাদ’ মেনে নিতে হবে? এমনতর প্রশ্ন থেকে বোঝাই যায় ভারতে তীব্র এক বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

বিতর্কটা শুরু হয়েছে মধ্যপ্রদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত থেকে। বিজেপি শাসিত ওই রাজ্য ধর্মান্তকরণ বন্ধ করতে চায়। মধ্যপ্রদেশে ১৯৬৮ সাল থেকে ধর্মান্তকরণ আইন আছে তারপরেও নতুন করে ‘লাভ জেহাদ’ আইন আনার কি প্রয়োজন আছে? ২০১৩ সালে মধ্যপ্রদেশে অন্তর্জাতীয় বিবাহ বিষয়ক একটি পাইলট প্রকল্প শুরু করা হয়। ‘ডঃ আম্বেডকর স্কিম ফর সোশ্যাল ইন্টিগ্রেশন থ্রু ইন্টারকাস্ট ম্যারেজেস’ নামে প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল। এই প্রকল্পে দুই ধর্মের বা দুটি জাতির মধ্যে বিবাহকে উৎসাহিত করার কথা। সেই প্রকল্পের কাজ কি হল?   

ভারতীয় নাগরিক (নারী-পুরুষ এবং সমলিঙ্গের হলেও) সংবিধানে তাঁদের বিয়ে করার যে অধিকার দেওয়া আছে তারপরেও নতুন আইন আনতে হবে কেন? কেরলের হাদিয়া মামলায় যে প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ২৩ জানুয়ারি, ২০১৮ তে এই মামলার সুপ্রীম কোর্টে শুনানী হয়। শীর্ষ আদালত বলে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী কাকে বিয়ে করবে না করবে সে বিষয়ে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে না।  

বিজেপি শাসিত রাজ্যে ‘লাভ জেহাদ’ আইন আনলে কংগ্রেস বিরোধিতা করবে। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলৌত বলেছেন, ‘’ভারতীয় নাগরিকদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনওরকম হস্তক্ষেপকে কংগ্রেস সমর্থন  করে না। নিজের জীবনসাথী বেছে নেওয়ার অধিকার সব ধর্মের প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষের আছে।‘’ তিনি আরও নির্দিষ্ট করে বলেন, ‘’লাভ জেহাদ আইন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষতি করবে। ভারতীয় নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না রাষ্ট্র বা কোনও রাজ্য সরকার।‘’ 

রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ ‘লাভ জেহাদ’ আইন এনে মুসলমান সম্প্রদায়কে টার্গেট করা হবে। গেহলৌত টুইট করেন, ‘’Marriage is a matter of personal liberty, bringing a law to curb it is completely un-constitutional and it will not stand any count of law.’’  ইলাহাবাদ হাইকোর্ট সম্প্রতি একটি রায়ে ঠিক একই কথা বলল। নিজেদের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কে কোন ধর্মের তা নিয়ে কোনও ব্যক্তি, পরিবার এমনকি রাষ্ট্রও হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ভিন ধর্মের বিয়ের একটি মামলার রায়ে ২৩ নভেম্বর বিচারপতি বিবেক আগরওয়াল ও বিচারপতি পঙ্কজ নকভির বেঞ্চের রায়ে একথা বলা হয়েছে। ঐতিহাসিক এই রায়ে বিচারপতিরা সংবিধানের ২১ ধারায় প্রাপ্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আরও বলেছেন, ‘কে কার সঙ্গে থাকবেন, সেটা তাঁর নিজের ব্যাপার। এর সঙ্গে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। ফলে সঙ্গী নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করলে নাগরিক জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়।‘’

বিজেপি মুসলিম বিদ্বেষ রাজনীতি থেকে কি এই আইন আনতে আগ্রহী? যেটা ফ্যাসিস্ত শক্তি করে থাকে বলে অভিযোগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির। হিটলারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনার কথা ইতিহাস বলে। ইহুদী বিদ্বেষ থেকেই হিটলার ইহুদীদের গিলোটিনে চড়াতেন। পাশাপাশি আরও একটা বিষয় উঠে আসছে, বিজেপির একাধিক শীর্ষ নেতার মেয়ে জীবন সঙ্গী হিসেবে মুসলিম পাত্রকে বেছে নিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কি ‘লাভ জেহাদ’ আইন কাজ করবে? সাংবাদিক রবীশ কুমার প্রশ্ন তুলছেন, ‘’ভারতে প্রতি ১৫ মিনিটে একজন করে মহিলা ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের বিয়েতে পণ দিতে হয়, সেই দেশে ‘লাভ জেহাদ’ আইন এনে কি লাভ হবে?’’ শেষ কথা তাই আমদের উচ্চারণ করতে হয় ‘বিয়েতে ধর্ম নয়, মানুষই সত্য’।

                            (এই লেখাটি ২৭ নভেম্বর, ২০২০ ‘সপ্তাহ’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে।)                  

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?