আমি চে-কাস্ত্রোর ভক্ত প্রতিবাদ আমার রক্তে






দীপেন্দু চৌধুরী  

একজন হলেন মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রনায়ক। দ্বিতীয়জন ফুটবলের রাজপুত্র, ফুটবল মাঠের ভগবান। সারা বিশ্বের আপামর ফুটবলপ্রেমী মানুষের আরাধ্য দেবতার সম্মান পেয়ছেন তিনি। প্রথমজন ফিদেল আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো। দ্বিতীয়জন দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। এই দু’জনের সম্পর্ক ছিল ভিন্ন খাতের। ফুটবল এবং রাজনীতির উর্ধে আরও এক নতুন অধ্যায় লেখা হয়েছে দু’জনের সম্পর্কে।

বুধবার (২৫ নভেম্বর) রাত দশটার সময় যখন হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে জানতে পারলাম মারাদোনা মারা গেছেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। বিশ্বাস করতে চাইছিলামও না। আমার স্বপ্নের ফুটবলার মারাদোনা নেই এটা ভাবতে কেমন যেন একটা আত্মীয় বিয়োগের মতো মনে হচ্ছিল। তাই বিশ্বাস করতে চাইছিলাম না। বিভিন্ন সূত্রে যোগাযোগ করে খবরের সত্যতা যাচাই করে তবে মেনে নিয়েছিলাম। ৬০ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্ব ফুটবলের মহানায়ক, বিশ্ব ফুটবলের কিংবদন্তি মারাদোনা চলে গেলেন     

আমাদের ছোটবেলায় আমরা বড়লোকের খেলা ক্রিকেট সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু একটা বল নিয়ে খালি পায়ে ২২ জন খেলোয়াড় ফুটবল খেলতে পারেসেই খেলা নিজে যেমন অপটু অভ্যাসে খেলেছি। একটু বড় হয়ে আমাদের গঞ্জ শহরে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচে স্বেচ্ছাসেবক হয়েছি। দু’টি কারণে, এক) বিনা টিকিটে বড় বড় দলের ফুটবল ম্যাচ দেখতে পাব। ২) স্থানীয় যে ক্লাবের উদ্যোগে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ হত, সেই ক্লাবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার তাগিদে। ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে ক্লাবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্য শহরে খেলা দেখতে যাওয়ার সুযোগ হবে। আমার বা আমাদের ফুটবলের প্রতি অনুরাগ এতটাই ছিল।

১৯৮৬ বিশ্বকাপ কলকাতার একটি মেসবাড়িতে বসে টিভিতে দেখেছিলাম। মারদোনার পায়ের জাদু দেখে উত্তেজনায় আমাদের দিশাহারা অবস্থা। হ্যা, ঠিক সেইদিন থেকে তিনি আমার মনের মণিকোঠায় স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিলেন। ফুটবল খেলা যে একটা শিল্প এই বোধ তখনও আমার হয়নি। ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কের খেলা এবং তাঁর সহযোগী কয়েকজনের খেলা দেখে উপলব্ধি করলাম। সেদিন থেকে বুঝতে পারলাম ফুটবল খেলা নিজস্ব ঘরানার এক বিশেষ শিল্প। যে ধ্রুপদী শৈল্পিক জাদু ঈশ্বরের বরপুত্র মারদোনার কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দু’জন ফুটবলারের একজন মারাদোনা। দ্বিতীয়জন পেলে। ১৯৮৬ থেকেই সামনে এল কে বড় ফুটবলার? পেলে না মারাদোনা? সম্ভবত ফুটবল বিশ্বের অধিকাংশের অভিমত মারাদোনাই বড় ফুটবলার। ইতিহাস বলছে, ৪৯১ ম্যাচ খেলে ২৫৯ গোল করা আর্জেন্টিনীয় ফুটবলার জনতার ভোটে একবার হারিয়ে দিয়েছিলেন ব্রাজিলের কিংবদন্তিকে। বিংশশতাব্দীর সেরা ফুটবলারের ভোটাভুটিতে পেলে মারাদোনার কাছে হেরে গিয়েছিলেন। পেলে নিজেও এই হার মেনে নিয়েছিলেন। যদিও ফিফা দু’জনকেই যোগ্য সম্মান দিয়ে সম্মানিত করেছিল।      

মানুষের যন্ত্রণা থেকেই কি মানুষ সৃষ্টির এক ভিন্নতর শিল্প গড়ে তুলতে চায়! মারাদোনা, যার শৈশবের দারিদ্র, অবমাননা, অপমান তাঁকে মুক্তির খোলা মাঠ চিনিয়েছিল? চ্যালেঞ্জ মারাদোনা, চ্যালেঞ্জ দিয়েগো চ্যালেঞ্জ বলে কি কেউ তাঁকে চাগিয়ে দিত! ছোট বয়সের বঞ্চনা, ক্ষুধার যন্ত্রণা মারাদোনা কোনওদিন ভুলতে পারেন নি। ভুলতে চাননি। বৃহত্তর সবুজ মাঠের ‘দৌড়’ ছিল মারাদোনার সেই যন্ত্রণার শৈল্পিক জবাব। আমাদের কাছে তাঁর স্বপ্নের দৌড়। বা পায়ের জাদু ছিল রক্তিম প্রভাতের শুভেচ্ছা। অভিজাত জাতির জাত্যাভিমানের মোক্ষম জবাব দিয়েছেন ফুটবল মাঠে। মাত্র ১৬ বছর ১২০ দিন বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবলে আর্জেন্টিনার অভিজাত নীল-সাদা জার্সি পরে তাঁর আবির্ভাব। তাঁর আগে ছোট মারাদোনার নিজের দল সেবোলিটাসকে ১৩৮ ম্যাচে অপরাজিত রেখেছিলেন। আর্জেন্টিনার হয়ে খেলতে নেমে ৯১ ম্যাচে ৩৪ টি গোল করেছেন মারাদোনা। ১৯৮৬-র মেক্সিকো বিশ্বকাপে একার আধিপত্যে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন নিজের দেশকে।

মারাদোনার জীবন যন্ত্রণার কথা বলছিলাম। জোয়াকিন সাইমন পেদ্রোস লিখেছেন, ‘’ মারাদোনার অতি ঘনিষ্ট এক বন্ধু আমাকে এক বার বলেছিলেন, দিয়েগোর সব চেয়ে বড় শত্রু ওর আবেগ। এত বড় তারকা হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে পরিবর্তন করতে পারেনি। ওকে বহুবার বলেছি, বিশ্বের মানুষ তোমাকে ঈশ্বর জ্ঞানে পুজো করে। প্রকাশ্যে তোমার অনেক সংযত হওয়া উচিত। ভেবে-চিন্তে কথা বলা উচিত। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলত, বন্ধু যারা সফল হওয়ার পরে নিজেকে বদলে ফেলে, তাদের মেরুদন্ড নেই। আমি চে, কাস্ত্রোর ভক্ত। প্রতিবাদ আমার রক্তে। যারা লড়াই করে আমি সব সময় তাদের পাশে। তাতে যে যা খুশি মনে করে করুক আমার কিছু যায় আসে না।‘’ ( সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬-১১-২০)

আমরা লেখার শুরুতে দুই ব্যক্তির কথা লিখেছিলাম। একজন মারাদোনা দ্বিতীয়জন ফিদেল কাস্ত্রো। দু’জনেই যুদ্ধের নায়ক। একজন ফুটবল মাঠের যুদ্ধের নায়ক। দ্বিতীয়জন জনযুদ্ধের নায়ক। মারাদোনা কিউবা বিপ্লবের সেই বিপ্লবী নায়ক ফিদেল কাস্ত্রোকে দ্বিতীয় পিতা বলেছিলেন। কিন্তু এত গভীর বন্ধুত্ব থাকা সত্বেও ফিদেল কাস্ত্রোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেননি মারাদোনা। অথবা বামপন্থী রাজনীতিকে নিজের প্রয়োজনে কখনও ব্যবহার করতে দেখা যায়নি তাঁকে। এটাই তাঁর মহত্ব। ফিদেল কাস্ত্রো নিজেও অনুভব করতেন বয়সে অনেক ছোট মারাদোনাকে। মারাদোনার কাছে ফিদেল ছিলেন একজন বন্ধুর থেকেও আরও বেশি কিছু।

২০১৬ সালে মারা গেছেন কিউবার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। তাঁর প্রিয় বন্দুর স্মরণসভায় যেতে পারলেন না তিনি। মারাদোনা ছিলেন ক্রোয়েশিয়ায়। শোকবার্তায় লিখলেন, ‘’আজ আমার দ্বিতীয় পিতাকে হারালাম। আমার আর কোনও আশ্রয় রইল না।‘’ সংবাদ মাধ্যমে বলেছিলেন, ‘’এখানকার কাজ শেষ হলেই আমি কিউবা যাব। আর্জেন্টিনা যখন আমার জন্য সব দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে, কিউবার দরজা খুলে দিয়েছিলেন ফিদেল।‘’ কি অদ্ভূত এক সমাপতন। ২৫ নভেম্বর মারা গিয়েছিলেন কিউবা বিপ্লবের নায়ক। চার বছর পরে সেই দিনেই আমাদের অনাথ করে দিয়ে চলে গেলেন ফুটবল বিশ্বের মহানায়ক।   

ফুটবলের ঈশ্বর মারাদোনার যে পায়ে ছিল ফুটবল শিল্পের জাদু, সেই বা পায়ে তিনি ফিদেল কাস্ত্রোর ছবি ‘টাট্টু’ এঁকেছিলেন। ফুটবলের রাজপুত্রের ডান হাতে চে গুয়েভারার ‘টাট্টু’ আঁকা ছিল। বিশ্বকাপ জয়ের কয়েক মাস পরে ১৯৮৭ সালে প্রথম দেখা করেন ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে। ২০০০ সালের আগেই দু’জনের বন্ধুত্ব গভীরতায় পৌঁছায়। মারাদোনা চিকিৎসার প্রয়োজনে চারবছর কিউবায় ছিলেন। মারাদোনা লিখেছেন, ‘’He opened Cuba’s doors to me when clinics in Argentina were slamming them shut because they didn’t want the death  of Maradona on their hands.’’ লাতিন আমেরিকার বামপন্থী আন্দোলনে মারাদোনাকে খুব একটা সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। এটা অত্যন্ত সচেতনভাবেই তিনি সম্ভবত কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। রাজনীতিকে নিজের বিতর্কিত জীবনের সঙ্গে জড়াতে চাননি হয়ত। তবু তিনি মানবতাবাদী শিল্পী ফুটবলার হিসেবে বলেছেন, ‘’আমি চে-কাস্ত্রোর ভক্ত। প্রতিবাদ আমার রক্তে’’।  (এই লেখাটি ২৭ নভেম্বর 'সপ্তাহ' পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে।)
    

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?