বিহার নির্বাচনঃ ইভিএম ব্যবহার নিয়ে প্রশ্নের মুখে কমিশন







 দীপেন্দু চৌধুরী

হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর বিহার ভোট টানটান উত্তেজনার মধ্যে শেষ হয়েছে। সপ্তম বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেছেন নীতিশ কুমার। সঙ্গে দু’জন উপমুখ্যমন্ত্রী। এনডিএ জোটে বিজেপির থেকে ৩১ টি আসন কম পেয়েও বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসলেন নীতিশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, এনডিএ-র ছোট শরিক হয়ে এই আসন তাঁর কাছে কাঁটার আসন। ২০২০-র বিধানসভায় শুরু থেকেই বড় শরিক বিজেপির চাপের কাছে মাথা নোয়াতে হচ্ছে তাঁকে। এই বিষয়টা যদি এনডিএ জোটের আভ্যন্তরীণ ঝড় হয় তার থেকেও বড় তুফান অপেক্ষা করছে বিধানসভার বাইরে।

বিহার ভোটে ইভিএম কারচুপির অভিযোগে আরজেডির কর্মী সমর্থকরা ইতিমধ্যেই স্বতঃস্ফুর্তভাবে পাটনা সহ বিভিন্ন শহরে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। মিছিল করে প্রতিবাদ চলছে। সেই সব প্রতিবাদ মিছিলের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। পরবর্তী আন্দোলনের চেতাবনী দিয়ে রেখেছেন তেজস্বী যাদব। আগামী বছরের জানুয়ারি মাস থেকে ইভিএম কারচুপির অভিযোগে সারা দেশব্যাপী আন্দোনের প্রস্তুতি নিচ্ছে মহগঠবন্ধন।

বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশ হতেই মহাগঠবন্ধন জোটের নেতা হিসেবে তেজস্বী যাদব অভিযোগ করেন, প্রশাসনের আধিকারিকদের কাজে লাগিয়ে ভোটের ফল বদলে দেওয়া হয়েছে। এনডিএ পেয়েছে ১ কোটি ৫৭ লাখ ৭২৮টি ভোট। মহাজোট পেয়েছে ১কোটি ৫৬ লাখ ৪৫৮টি ভোট। তিনি বলেন, ‘’এনডিএ মহাজোটের থেকে মাত্র ১৫টি আসন বেশি পেয়েছে। কিন্তু দু’দলের ভোটের ব্যবধান মাত্র ১২, ৭৬৮ ভোট। এনডিএ পেয়েছে ৩৭.২৬ শতাংশ ভোট, আর বিরোধী মহাজোট পেয়েছে ৩৭.২৩ শতাংশ ভোট। মাত্র ১%-র ব্যবধান। এত কম ব্যবধান কী করে হয়? মাত্র ১২ হাজার ভোটের ব্যবধানে ১৫টি বেশি আসন পাওয়া সম্ভব?’’

কংগ্রেস নেতা রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালাকে পাশে বসিয়ে একদফা সাংবাদিক সম্মেলন করেন তেজস্বী। সেদিন তিনি নির্দিষ্ট ভাবে অভিযোগ করেছেন। তিনি জানান, ৩০টি আসনে আমাদের মহাগঠবন্ধনের প্রার্থীদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে, ইভিএম কারচুপি এবং পোস্টাল ব্যালট গণনায় কারচুপি করে! তিনি পুনঃগণনার দাবি জানাচ্ছেন। দ্বিতীয় সাংবাদিক সম্মেলন করেন তেজস্বী দাদা তেজপ্রতাপকে পাশে বসিয়ে। প্রায় একঘণ্টার এই সাংবাদিক সম্মেলনে তেজস্বী তার অভিযোগের সমর্থনে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন।

ইভিএম হটাও লোকতন্ত্র বাঁচাও

তেজস্বী নিজের অভিযোগের সমর্থনে নির্বাচন কমিশনের ১৯৬১ সালের আইনের উল্লেখ করেন। নির্বাচনী আইনের একটি পৃষ্ঠার ফোটোকপি সাংবাদিকদের দেখিয়ে তিনি দাবি করেন, এই আইনের ১৫.১৫.৪ ধারার ২৬০ পাতায় বলা আছে,  পোস্টাল ব্যালটের গণনা প্রথমে শুরু করতে হবে। পর্যবেক্ষক, রিটার্নিং অফিসারের উপস্থিতিতে গণনা করতে হবে। ভবিষ্যতের প্রমাণ হিসেবে পোস্টাল ব্যলট গণনার ভিডিওগ্রাফি করে বিভিন্ন খামে সিল করে রাখতে হবে। কমিশনের নিয়মে বলা আছে ৪০ দিন পর্যন্ত সিল করা খাম রাখতে হবে। যদি পোস্টাল ব্যালট ভিডিওগ্রাফি করা হয়ে থাকে তাহলে আমাদের তার সিডি-ভিডিও দেওয়া হোক। 

তেজস্বী প্রশ্ন তোলেন এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে কী? তাঁর আরও অভিযোগ, রাতের অন্ধকারে ৯০০, ৭০০, ৫০০ করে ভোট বাতিল করে দেওয়া হল? আরা থেকে রাতের অন্ধকারে একটা গাড়িতে করে পোস্টাল ব্যালট সরিয়ে ফেলা হয়েছিল বলে আমরা মনে করছি১৫.১৫.৪ ধারায় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ আছে নির্বাচন চলাকালীন রাতে কোনও যানবাহন চলবে না। আমরা জানতে চাইছি, আরা থেকে যে গাড়ি গভীর রাতে বেরিয়ে যায় সেই গাড়িতে কী ছিল? পোস্টাল ব্যালটের সমস্ত ভোট স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সরকারি কর্মচারীদের ভোট। বিহারের উচ্চশিক্ষিত সচেতন ভোটারদের অপমান করা হল? আমরা পুনঃগণনার দাবি জানাচ্ছি। বিহারের সদ্য নির্বাচিত অভিঞ্জ মুখ্যমন্ত্রী উত্তর দিক পোস্টাল ব্যলট প্রথমে কেন গণনা করা হল না। রাত ১১টার সময় সার্টিফিকেট দেওয়া হল কেন? দুপুর তিনটের সময় গণনা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সিসিটিভির ফুটেজ আমজনতাকে দেখালেই বিষয়টা প্রমাণ হয়ে যাবে। সচেতন নাগরিকদের ভোটেই কারচুপি করতে হল?

ইভিএম নিয়ে অভিযোগ করছে সিপিআই (এমএল) দলও। ১০ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন দফতরের সিইওকে দলের তরফে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, বিহারের গোপালগঞ্জ জেলার ভোরে বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট গণনার সময় গণনাকেন্দ্রে গোপালগঞ্জের জেডিইউ সাংসদ অলোক কুমার সুমন ঢুকে পড়েছিলেন। প্রার্থী নির্দেশাবলীর ১৬.৯ ধারা লঙ্ঘন করে গণনাকেন্দ্রে প্রবেশ করেন সাংসদ অলোক কুমার সুমন। সিপিআই(এমএল)-র অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন ভোট গণনার সিসিটিভি ফুটেজ চেয়ে নির্দেশ দিয়েছেন জেলাশাসক আরশাদ আজিজকে। এবং সিপিআই(এমএল)- দল মনে করে এই অনুপ্রবেশের কারণে কেন্দ্রটিতে নতুন করে গণনার প্রয়োজন রয়েছে। নির্বাচন কমিশনও অভিযোগটি গুরুত্বের দিয়ে দেখছে।           

ইভিএম কারচুপি যে করা যায় সেটা বহুজন টিভিতে সম্প্রতি একটি ইভিএম যন্ত্রের ‘ডেমো’ দেখান হয়েছে। উপস্থিত  সাংবাদিকদের সামনে করা সেই হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখানো হয়েছে। ইভিএম যন্ত্রে কী ভাবে কারচুপি করা যায়। সফটওয়্যার-হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্যে এই ‘ডেমো’র ছবিও সোশযাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। বহুজন টিভির দাবি, আমেরিকার বিঞ্জানীরা এক বছর আগেই দেখিয়েছিলেন, ইভিএম যন্ত্র হ্যাক করা যায়। পাশাপাশি বিহার ভোটের পরে আলোচনায় উঠে এসেছে, ২০২০ সালের আমেরিকার ভোট ব্যালট পেপারে না হয়ে যদি ইভিএমে হত তাহলে প্রসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় বারের জন্য পুনঃনির্বাচিত হয়ে যেতেন। এই আলোচনার কোনওরকম সারবস্তু নেই এমনটা ধরে নেওয়াটা ঠিক হবে না।

কারণ, ২০১৬ সালে আমেরিকার ভোটের ইতিহাস এখনও বিশ্ববাসীর মনে আছে। সিপিএম নেতা শমীক লাহিড়ী ২০ অগস্ট দলের ওয়েবসাইট সিপিএম ডট ওআরজি ডট ইন-এ ‘ঝুলির গেরুয়া বিড়াল’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছেন। সেই লেখায় তিনি দাবি করেছেন, ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নালে প্রকাশিত খবর ভারতের প্রায় সব কাগজরেই হেডলাইন। ফেসবুক-বিজেপি গাটছড়া। এটাই তো হওয়ার কথা। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই এতে। দেশপ্রেমের আর তথ্য সুরক্ষার ধুয়োর আড়ালে সব হঠাও-থাকবে শুধু আম্বানি-গুগুল-ফেসবুক গাঁটছড়া। সব এদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে, বকলমে বিজেপির।

উপ শিরোনাম ‘এদের হাতে ভারতবাসী কতটা সুরক্ষিত?’ কলমে শমীক লিখছেন, বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে নাক গলানোর অভিযোগ ফেসবুকের বিরুদ্ধে আছে। এর মধ্যে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ঘটনা সবারই জানা। আমেরিকার নির্বাচনে সেদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারী নির্বাচকমণ্ডলীদের তথ্যভান্ডার তুলে দেওয়া হয়েছিল ঘুরপথে ট্রাম্পের হয়ে কাজ করা ভোট কুশলী কোম্পানি কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার হাতে। অভিযোগ আছে একইভাবে তথ্য সংগ্রহ করে রাশিয়ার সরকারও নাকি ট্রাম্পকে জিতে আসতে সহযোগিতা করেছিল।

এই ফেসবুক কোম্পানির সাথে বিজেপির সখ্যতা ২০১৩ সাল থেকেই। ২০১৪ সালের প্রচারেও বিজেপিকে সাহায্য করার অভিযোগ উঠেছিল।‘’ ভারতে সম্প্রতি ফেসবুক আধিকারিক আঁখি দাসকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক দানা বেঁধেছিল। 

সমাজবাদী পার্টির নেতা তথা উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের অভিযোগ, আমাদের আর কিছু বলার নেই। এমন ভোট আমরা কোনওদিন দেখিনি। ১৩ থেকে ১৪ হাজার ভোট বেশি পেয়েছে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ। মহাগঠবন্ধনকে বেইমানি করে হারানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘’বিজেপি-জেডিইউ জোট ষড়যন্ত্র করে মহাগঠবন্ধনকে হারিয়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টি লড়াই করেনি। বিহার সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। আমি বলতে চাইছি এই সব আধিকারিকরা নির্বাচনে ছায়া হয়ে লড়েছেন। বিহারের সংখ্যাধিক্য মানুষের সমর্থন পেয়েছে মহাগঠবন্ধন জোট। তবু আমাদের হেরে যেতে হল। জনাদেশ আমাদের সঙ্গে আছে।‘’

আরজেডির সাংসদ এবং মুখপাত্র মনোজ ঝা সম্প্রতি বিবিসি টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘’ভোটে কারচুপি (ম্যানিপিউলেইট) করা হয়েছে। একজন আরজেডি প্রার্থী মাত্র আট ভোটে হেরেছেন। কম ভোটের ব্যবধানে হেরে যাওয়া প্রার্থীদের একটি তালিকা আমি কমিশনে জমা দিয়েছি। বহুমতকে প্রভাবিত করা হয়েছে। সন্ধ্যে ৫ টার পরে সব কিছু হয়েছে।‘’ বিবিসি সাংবাদিক ইকবাল আহমেদের প্রশ্নের উত্তরে আরজেডি সাংসদ জানান, আমরা আইনি রাস্তার কথা এখনই বলছি না। আমাদের দলে, মহাগঠবন্ধনে কংগ্রেস সহ অন্য যে সব দল আছে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।

ইভিএম হটাও লোকতন্ত্র বাঁচাও স্লোগানকে সামনে রেখে কংগ্রেস-সিপিএম সহ বিরোধী দলগুলি অনেক দিন থেকেই সরব। বিহার ভোটের ইভিএম নিয়ে অভিযোগ মহাগঠবন্ধনের সঙ্গে যুক্ত দলগুলির কাছে অক্সিজেনের কাজ করবে। সামনের বছর পশ্চিমবঙ্গ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন আছে। এখন দেখার সামনের বছর যে রাজ্যগুলিতে ভোট আছে সেই সব রাজ্যে ইভিএমে ভোট হয় না ব্যালট পেপারে!  

                              (এই লেখাটি ২০ নভেম্বরের ‘সপ্তাহ’ পত্রিকায় প্রকাশিত)          

      

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?