ভারতে মনুবাদী রাজনীতির নতুন অধ্যায়
দীপেন্দু চৌধুরী
চলতি বছরের ৪ অগস্ট পান্ডুয়ার তিয়া সংলগ্ন মোড়ে লোকনায়ক সিধু এবং কানহুর
কংক্রিটের তৈরি মূর্তির হাতে ধরা কুড়ুল, হাতের আঙুল কে বা কারা এসে ভেঙে দিয়ে চলে
যায়। পায়েও ফাটল দেখা যায়। এই ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয় আদিবাসী মানুষ রাস্তা অবরোধ
করে। ঘণ্টা দেড়েক অবরোধ চলে। পুলিশ তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিলে তবে অবরোধ ওঠে।
উল্লেখিত ঘটনাটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একদিকে আদিবাসী সমাজের
রাষ্ট্রনায়কদের মূর্তি ভেঙে আদিবাসী সমাজকে ভয় দেখাতে চাইছে। নির্দিষ্ট
একটি মনুবাদী রাজনৈতিক দল। সম্ভবত তারা নিজেদের সমর্থকদের কাছেও হিন্দুত্ববাদী
রাজনীতির বার্তা দিতে চাইছে। আবার পাশাপাশি আদিবাসী সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্যতার
প্রয়োজনে আদিবাসী নেতা বীরসা মুন্ডার মূর্তিতে মালা দিতে ছোটেন ওই দলের নেতারা। সম্প্রতি এমনই
একটি অভিঞ্জতা হল পশ্চিমবঙ্গের মানুষের। বিজেপি নেতা তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত
শাহ ৫ নভেম্বর গিয়েছিলেন বীরসা মুন্ডার মূর্তিতে মালা পরাতে। বীরসা মুন্ডার
মূর্তিতে মালা দেওয়ার আগে রাজ্য বিজেপির নেতৃত্ব হোম ওয়ার্কটুকুও করেননি। ফলে
মূর্তি নিয়ে উঠেছে বিতর্ক।
দৃশ্য-১, নভেম্বরের ৫ তারিখ বাঁকুড়ার পোয়াবাগানে একজন আদিবাসী শিকারির
মূর্তিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল আদিবাসীদের কিংবদন্তি নেতা বীরসা মুন্ডার মূর্তি
হিসেবে। পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আদিবাসী সমাজের ভগবান বীরসা মুন্ডার একটি ছবি
এনে রাখা হয় ওই মূর্তির নীচে। অমিত শাহ মালা দিলেন ওই ছবিতে। তবে পুষ্পার্ঘ দেওয়া
হয় মূর্তির পায়ের তলায়। এই ঘটনায় আদিবাসী সমাজ ক্ষুব্ধ। আদিবাসীদের সংগঠন ‘ভারত
জাকাত মাঝি পারগানা মহল’এর নেতা সনগিরি হেম্ব্রম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘’ওটা বীরসা
মুন্ডার মূর্তি নয়, জনৈক আদিবাসী শিকারির মূর্তি। বিষয়টা জেলা বিজেপি নেতৃত্বের
নজরে আনা হয়েছে।‘’
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। করোনা আবহে
ভোটের দামামা বেজে গেছে। তার আগে শুরু হয়ে গেছে মনুবাদী দলের আদিবাসী প্রেম। ওই
একই দিনে অমিত শাহ বাঁকুড়া ১ ব্লকের চতুর্ডিহি গ্রামের আদিবাসী দিন মজুর বিভীষণ
হাঁসদার বাড়িতে যান মধ্যাহ্নভোজনের জন্য। কলাপাতা দেওয়া কাঁসার থালা বাটিতে
ভাত-রুটি, ডাল, আলু, পটল ভাজা, আলু-পোস্ত এবং মিষ্টি দেওয়া হয় ভারতের
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। খুব ভালো বাঙালি খাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন বলে অমিত শাহ টুইট
করেন।
সূত্রের খবর, বিভীষণ হাঁসদার একটি কিশোরী মেয়ে আছে। মেয়েটি হাই ডায়াবিটিসের
রোগী। বিভীষণের ইচ্ছে ছিল মেয়ের চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাওয়া। কিন্তু ভারতের
গৃহমন্ত্রীজীর সময়ের অভাবের কারণে বিভীষণ রামের দেশে আর পৌঁছতে পারলেন না। আদিবাসী
সমাজ বিভীষণ সম্প্রদায়ভুক্ত থেকে গেলেন স্বাধীন ভারতে স্বাধীন ভারতেও।
দৃশ্য-২ অমিত শাহ পরেরদিন মধ্যাহ্নভোজনের জন্য যান বাগুইহাটির এক মতুয়া
বাড়িতে। বাড়ির মালিকের সচ্ছল পরিবার। দোতলা পাকা বাড়ি। বাড়িতে ঠাসা আধুনিক আসবাবপত্র। সেখানেও
অমিত শাহ বাঙালি খাবার খান মধ্যবিত্ত বাঙালি আয়োজনে। বিজেপির লোক দেখানো সংস্কৃতি
নিয়ে সমালোচনা করতে শুরু করে দিয়েছে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা।
দৃশ্য-৩, তিন বছর আগে ২০১৭ সালেও
তৎকালীন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়িতে আদিবাসী গীতা মাহালীর
বাড়িতে গিয়েছিলেন মধ্যহ্ন ভোজনের জন্য। দু’বছর পরেই ছিল লোকসভার ভোট। ২০১৯ সালকে
সামনে রেখে ভোট রাজনীতির নতুন অধ্যয় শুরু করেন বিজেপি নেতা অমিত শাহ। সেদিনের
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গীতা মাহালীর ঘরে নতুন টিন দিয়ে অস্থায়ী দেওয়াল তোলা হয়েছে। তার
সামনে বসে অমিত শাহ এবং রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ আসনপিঁড়ি হয়ে বসে কলাপাতায়
দুপুরের খাবার খাচ্ছেন।
কিছুদিন পরে গরিব গীতা মাহালী বিজেপির কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য না পেয়ে দল
বদল করেন। তার বাড়িতে চলে আসেন তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্ব। তৃণমূল কংগ্রেসে
যোগদান করেন গীতা মাহালী। সাধাণ মানুষের প্রশ্ন ভোট এগিয়ে আসতেই বিজেপি এবং তৃণমূল
কংগ্রেস সহ বিভিন্ন ক্ষমতাসীন দলের কাছে আদিবাসী, জনজাতি, তপসিলি জাতি এবং মতুয়া
প্রেম নতুন করে জেগে ওঠে। এই সম্প্রদায়ের মানুষদের ভোটের বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করা
হয়।
দৃশ্য-৪ ক্যামেরা ফ্ল্যাশ ব্যাকে। কারণ ওপরের ঘটনা দু’টির মতোই তৃতীয়
দৃশ্যের সময়ও সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরা লাইভ ছিল। বিশেষত টিভি এবং পোর্টাল মাধ্যমের
ক্যামেরা। বিশেষ সেই ঘটনাটি হচ্ছে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি।
কুম্ভ মেলায় ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর জন্য অভিযান চলছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
পৌঁছে যান এলাহাবাদে। গঙ্গার ঘাটে পাঁচজন শৌচকর্মী (সাফাইকর্মী)-র পা ধুয়ে
দিয়েছিলেন তিনি। এবং পা ধোওয়ানোর পরে তোয়ালে দিয়ে যত্ন করে পা মুছেও দিয়েছিলেন
তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ছিল সাজ সাজ রব। সেদিন প্রচারের
সব রকমের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সুপরিকল্পিতভাবে। এলাহাবাদের কুম্ভমেলাকে স্বচ্ছ
রাখতে ভোটকুশলী এবং রাজনীতিতে প্রাঞ্জ বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী পাঁচজন শৌচকর্মীর
পা ধুয়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানকে বেছে নিয়েছিলেন।
ওই দিনের পাঁচজন শৌচকর্মীরা হলেন যথাক্রমে, পিয়ারেলাল, নরেশ কুমার। এই দু’জন
বান্দার বাসিন্দা। হরি লাল, সম্ভব এবং জ্যোতি এসেছিলেন ছত্তিষগড়ের কৌবা থেকে। পাঁচজনের
মধ্যে দু’জন ছিলেন মহিলা শৌচকর্মী। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির পরে এই পাঁচজন সম্পর্কে
কোনও খবর সংবাদ মাধ্যমে পাওয়া যায়নি। মনুবাদী রাজনীতির প্রবর্তকদের এই সংস্কৃতিকেই
বলা যেতে পারে ভারতে এক নতুন অধ্যায়। ভারতীয় অর্থনীতির হাল হকিকত নিয়ে শুধুমাত্র
অর্থনীতিবিদরা চিন্তিত এমনটা নয়। তরুণ প্রজন্ম থেকে আম জনতার আলোচনায় উঠে আসছে
বিষয়টি। সম্প্রতি জানা গেছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত ১০৭ টি দেশের মধ্যে ৯৪
তম স্থানে আছে। ক্রমতালিকায় ভারতীয় উপ-মহাদেশের অন্যান্য দেশ শ্রীলংকা (৬৪), নেপাল
(৭৩), বাংলাদেশ (৭৫), মায়ানমার (৭৮) এবং পাকিস্তান (৮৮) তুলনামূলকভাবে ভারতের থেকে
তারা ভালো অবস্থায় আছে।
ডাঃ বিনায়ক সেন ২০১১ সালে কলকাতায় এসে একটি আলোচনাসভায় বলেছিলেন, বিশ্বের
মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ বাস করে যে দেশে, সেই ভারতে পুষ্টির মাপকাঠি ‘বডিমাস
ইনডেক্স’ অনুসারে ৩৭ শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার। তপসিলি জনজাতির ক্ষেত্রে এই
সংখ্যা ৫০ শতাংশ। ভারতে ৪৫ শতাংশ আদিবাসী এবং ৩২ শতাংশ তফসিলি জাতির মানুষ আজও
দারিদ্র সীমার নীচে। একটি সূত্রের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, এদের বৃহত্তম অংশই
ভূমিহীন এবং নিম্ন মজুরির পেশায় নিয়োজিত। কয়কে দশক আগে কংগ্রেস সরকারের আমল থেকে
যে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয়েছে, সেই ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে তপসিলি
উপজাতির উপস্থিতির হার ছিল ১৭ শতাংশ। আদিবাসী ৮ শতাংশ, বেসরকারি চাকরিতে এদের
উপস্থিতির কোনও হিসেব নেই বললেই চলে। পরিসংখ্যান বর্তমান সময়ের সঙ্গে তুলনায়
কিছুটা হেরফের হলেও হতে পারে।
তফসিলি জাতি এবং আদিবাসীদের উপর অত্যাচার রোধের সংশোধিত আইন নতুন করে বলবৎ
হয়েছে ২৬ জানুয়ারি, ২০১৬ সালে। তারপরেও কি দলিত আদিবাসীদের উপর অত্যাচার বন্ধ
হয়েছে? উত্তরপ্রদেশের হাথরসে কিশোরী কন্যাকে দৈহিক নির্যাতন করে নৃশংসভাবে খুন করল
ঠাকুর পরিবারের কয়েকজন যুবক। যারা মনুবাদী রাজনৈতিক দলের সমর্থক ক্ষমতাশীল
পরিবারের সদস্য। বিজেপির শাসনকালে দলিত, আদিবাসীদের উপর অত্যাচার সমানে বেড়েই
চলেছে।
নির্বাচন আসলেই বিজেপির আদিবাসী তপসিলি জাতিদের কথা মনে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে
৪০টি বিধানসভা কেন্দ্রে মতুয়াদের প্রভাব রয়েছে। যারা ভোটে জয়-পরাজয়ে নির্ণায়ক
ভূমিকা নিতে পারে। তাই মতুয়াদের নিয়েও বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে শুরু হয়েছে দড়ি টানা
টানি। অভিজাত মতুয়া সম্প্রদায় আর্থিকভাবে এতটাই সচ্ছল যে সাধারণ তপসিলি
সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সঙ্গে কোনওরকম তুলনায় আসেন না তারা। তবু ভোট রাজনীতির
কারণে মতুয়া সম্প্রদায় বিজেপি তৃণমূলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভোট ব্যাঙ্ক।
সেই কারণে এই সম্প্রদায়কে এই দুই দলেরই প্রয়োজন।
(এই লেখাটি ১৩ নভেম্বর সপ্তাহ পত্রিকায় প্রকাশিত)
Comments
Post a Comment