ন্যায়ের সন্ধানে গণমাধ্যমের আমিও একজন




দ্বৈপায়ন কবির   

‘জেন্টলম্যান ক্লাব’-র কথা কতজন জানেন? আমিও কি আগে জানতাম? বছর দশেক আগে সামাজিক মাধ্যমের সংস্পর্শে এসে জানতে পারি। জেন্টলম্যান ক্লাবের সদস্য হওয়ার অধিকার বা যোগ্যতা সকলের থাকে না। অদৃশ্য এই অভিজাত ক্লাবের সদস্য হতে গেলে বৃহৎ কোনও সংবাদ গোষ্ঠীর মালিক, সম্পাদক, প্রকাশক, সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলের সঞ্চালক অথবা সর্বভারতীয় সাংবাদিক হতে হবে। এবং সেই সঙ্গে অদৃশ্য কয়েকটি গুণ থাকেত হবে। তথকথিত অভিজাত এক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে পারলে তবেই ‘জেন্টলম্যান ক্লাব’-র সদস্যপদ পাওয়া যায়। এই ক্লাবের সদস্য হওয়ার অধিকার শুধুমাত্র সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধির আছে এমনটা নয় কর্পোরেট জগতের প্রথম ও দ্বিতীয়শ্রেণীর পদস্থ কর্মীরও আছে। তবে শর্ত অদৃশ্য ওই সব গুণ থাকতে হবে। তবেই বহুজাতিক সংস্থার পদস্থকর্মী জেন্টলম্যান ক্লাবের সদস্যপদ পাবেন।  

সম্প্রতি ভারতেবর্ষের একটি সর্বভারতীয় এবং প্রথমশ্রেণীর সংবাদমাধ্যমকে কেন্দ্র করে বিতর্ক শুর হয়েছে। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীর নাম ‘এআরজি আউটলায়ার’। যাদের জনপ্রিয় সর্বভারতীয় চ্যানেল হচ্ছে, ‘রিপাবলিক টিভি’এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে টিআরপি কেলেঙ্কারির অভিযোগ নিয়ে মুম্বই পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। ৮ নভেম্বর একথা জানান মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার পরমবীর সিংহ। ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল (বিএআরসি) ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলির জনপ্রিয়তার রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। দর্শকরা কোন টিভি চ্যানেল বেশি দেখছে বিএআরসি সেই রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপাবলিক টিভি ছাড়া আরও দু’টি টেলিভিশন চ্যনেলের বিরুদ্ধে টিআরপি জালিয়াতির অভিযোগ এনেছে মুম্বই পুলিশ। দু’টি চ্যনেলের মধ্যে রয়েছে ভারতের খ্যাতনামা টিভিস্টার অর্ণব গোস্বামীর মালিকানার সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীর সিস্টার কনসার্ন হিন্দি চ্যনেল ‘আর ভারত’। অন্যটি একটি মারাঠী টিভি চ্যানেল।

মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার পরমবীর সিংহের আনা অভিযোগের পরে অর্ণব গোস্বামী তথা রিপাবলিক টিভি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয় মুম্বই পুলিশের প্রাক্তন এসিপি ইকবাল শেইখ এই মামলার আবেদনকারীএআরজি আউটলায়ার গোষ্ঠীর মালিকানা আছে এমন দু’টি চ্যানেলের সম্প্রচারিত খবরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে এসিপি ইকবাল। এই মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, টিআরপি কেলঙ্কারি ছাড়াও চ্যনেল দু’টি মুম্বই পুলিশ কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে কুৎসামূলক প্রচার করেছে। এই প্রচারের জন্য মুম্বই পুলিশ কতৃপক্ষের মানহানি হয়েছে। ইকবাল শেইখের অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, রিপাবলিক টিভির সাংবাদিক সঞ্চালক অর্ণব গোস্বামী চ্যনেলে যে ‘টক শো’ পরিচালনা করেন, সেই অনুষ্ঠান সাংবাদিকতার এথিক্স মেনে হয় না। সাংবাদিকতার শর্ত লঙ্ঘন করা হয়।

আইনি প্রসঙ্গের বিষয়ে মন্তব্য না করেও উল্লেখ করা যায়, অর্ণব গোস্বামীর ‘টক শো’ পরিবেশনার চিৎকৃত ঘরানা নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের মধ্যেও বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে।  

মুম্বই পুলিশ কমিশনার ৮ অক্টোবর সাংবাদিক সম্মেলন করেনঅক্টোবর রিপাবলিক টিভির বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়। রিপাবলিক টিভির তরফে এই বিষয়ে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। এআরজি আউটলায়ার এই মামলার বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে পাল্টা মামলা করে। মামলার আবেদনে বলা হয়, টিআরপি কেলেঙ্কারির তদন্ত মুম্বই পুলিশের পরিবর্তে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই)কে দেওয়া হোক। শীর্ষ আদালত মামলা গ্রহণ করে ১৫ অক্টোবর শুনানিতে রিপাবলিক টিভির কর্ণধার অর্ণব গোস্বামীকে বলে, বম্বে হাইকোর্টে আবেদন করতে। বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় রিপাবলিক টিভির উদ্দেশ্যে বলেন, ‘’আপনাদের অফিস তো মুম্বইয়ের ওরলিতে। ফ্লোরা ফাউন্টেন আর হাইকোর্ট তো তার কাছেই। সেখানে যান।‘’  

১৫ অক্টোবর শীর্ষ আদালতের বিচারপতি চন্দ্রচূড়, বিচারপতি ইন্দু মালহোত্র এবং বিচারপতি ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যের বেঞ্চ রিপাবলিক টিভি কতৃপক্ষকে প্রথমে বম্বে হাইকোর্টে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। বম্বে হাইকোর্টে মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। টিআরপি কেলেঙ্কারির শুনানিতে বম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি এস এস শিন্ডে এবং এম এস কার্ণিকের ডিভিশন বেঞ্চ মুম্বই পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে, রিপাবলিক টিভির এডিটর ইন চিফ অর্ণব গোস্বামীর বিরুদ্ধে সমন জারি করারঅর্ণবের আইনজীবী হরিশ সালভে আদালতকে জানায়, রিপাবলিক টিভির কর্ণধার তার মক্কেল অর্ণব গোস্বামী সমনের আগেই মুম্বই পুলিশের সঙ্গে সব রকমের সহযোগিতা করবে। পুলিশের অভিযোগে বলা হচ্ছে, রিপাবলিক টিভি সহ আরও দু’টি চ্যানেলের টিআরপি কেলেঙ্কারিতে কয়েক কোটি টাকার তছরুপ হয়েছে।

টিআরপি কেলেঙ্কারির মামলা শুরু হতেই আপাতত তিন মাসের জন্য সাপ্তাহিক রেটিং প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে। ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল (বার্ক) এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেতারা পুরো প্রক্রিয়াটির মূল্যায়ন করবে। তারপর নতুন করে রেটিং প্রক্রিয়া শুরু করবে। বার্ক-র সিদ্ধান্তকে প্রশংসনীয় বলে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে নিউজ ব্রড কাস্টার্স অ্যাসোসিয়েশন।

হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা জানাচ্ছে, ‘’The high court has agreed to start the final hearing in the case from November 5. It has directed the police to produce all the developments in investigation before it in a sealed cover by November 4.

Six people have been arrested by the Mumbai police in the scam, which allegedly involves inducing homes which form the sample set whose TV viewing is monitored to ensure that certain channels get higher ratings. The ratings are a key influencer of advertiser preferences while placing commercials. The police claim this is a “multi-crore” scam.’’ Hindustan Times, October 19, 2020 

আলোচ্য লেখার শুরুতে ‘জেন্টলম্যান ক্লাব’-র কথা বলা হয়েছে। কংগ্রেস সিপিএম সহ বিরধী দলের অভিযোগ সম্পাদক-সঞ্চালক অর্ণব গোস্বামী অদৃশ্য এই ক্লাবের অন্যতম সদস্য। কংগ্রেসে-সিপিএম জোটের আরও অভিযোগ ভারতের প্রায় ২৬ টি সংবাদ গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করে ‘গোদী মিডিয়া’বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ‘গোদী মিডিয়া’ দেশের সংবাদ মাধ্যমে কোন খবর যাবে, কোন সাংবাদিক কোন সংস্থায় কাজ করবে সে সবের সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এবং  বিজেপি সরকার বিরোধী কোন খবর করলে সেই সাংবাদিককে সংস্থার চাকরি থেকে বহিষ্কৃত করার দায়িত্ব আরোপিত আছে এই ‘গোদী মিডিয়া’ নামক গোষ্ঠীর হাতে। বিরোধীদের আরও অভিযোগ আম্বানী-আদানী গোষ্ঠীর মালিকানা এবং ভারতের প্রথম শ্রেণীর কয়েকটি মিডিয়া গোষ্ঠী পরিচালিত গোদী মিডিয়ার অলিখিত শীর্ষ আধিকারিক অর্ণব গোস্বামী।

কংগ্রেস সহ বিরোধী দলের অভিযোগ ছিল, হাথরাস কিশোরীর উপর শারীরিক নির্যাতন, নিগ্রহ এবং খুনের অভিযোগকেও ‘লাভ জেহাদ’-র ঘটনা বলে প্রথমে সংবাদ পরিবেশন করেছিল রিপাবলিক টিভি। পরে নিজেদের খবরের ভুল স্বীকার করে রিপাবলিক গোষ্ঠী। অর্থ, বহুজাতিক সংস্থার সমর্থন, কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি নামক একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সমর্থনে পুষ্ট হয়ে সংবাদ মাধ্যমের নিরপেক্ষতা থেকে বিচ্যুত হতে হবে?  গণমাধ্যমের দায় এবং দায়বদ্ধতা বিসর্জন দিয়ে সাংবাদিকতার নামে এ কোন অভিসার? ভারতে প্রথম সংবাদপত্র হিকির গেজেট প্রকাশের পরে ২০০ বছরের বেশি আমরা পার হয়ে এলাম। বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় সংবাদ মাধ্যম কতটা স্বাধীন? কতটা সহনশীল? কতটা পরশ্রীকাতর? সৎ, নিরপেক্ষ এবং একজন বিবেকবান প্রতিবেদকের ডেস্ক থেকে এই প্রশ্ন তোলাটাও কি রাষ্ট্রদ্রোহ হবে?

টিআরপি কেলেঙ্কারির অভিযোগে মামলা চলছিলই। আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে একটি পুরনো মামলায় ৪ নভেম্বর অর্ণব গোস্বামীকে গ্রেফতার করেছে মুম্বই পুলিশ। ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁকে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আলিবাগ আদালত। আত্মহত্যার অভিযোগের ঘটনাটি ২০১৮ সালের। নিজের মাকে খুন করে নিজেও আত্মহত্যা করেন ইন্টরিয়র ডিজাইনার ৫৩ বছর বয়সি অন্বয় নাইক। অন্বয় সুইসাইড নোটে লিখেছিলেন, তিনটি সংস্থা তার পাওনা বকেয়া টাকা দেয়নি। কাজ করার জন্য যে সব সংস্থা থেকে অন্বয় ঋণ নিয়েছিল সেই সব সংস্থার থেকে তার উপর চাপ আসছিল। সেই কারণে অন্বয় নিজে এবং তার মা চরম পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ওই তিনটি সংস্থার মধ্যে একটি রিপাবলিক টিভি। এই সংস্থার বিরুদ্ধে ৮৩ লক্ষ টাকা বকেয়া রেখে দেওয়ার অভিযোগ করে গেছেন তিনি। অন্বয়ের মৃত্যুর পরই আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার মামলা হয়।

কোনও সাংবাদিক সম্পাদককে নিয়ে লেখা মানেই তার উপর ব্যক্তিগত রাগ অভিমান থেকে লেখা নয়। ভারতে নির্ভীক, গণতান্ত্রিক এবং  নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের হেনস্থা, শারীরিক নির্যাতন বা সাংবাদিকের মৃত্যু নিয়ে অর্ণব গোস্বামীকে কোনদিন প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে যে উচ্চতায় অর্ণব পৌঁছেছেন সেখান থেকে তার তথাকথিত আত্মবিশ্বাস চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল কি? তাই এক ধরণের ঔদ্ধত্য অর্ণব গোস্বামীর ঘরানায় আমরা দেখছিলাম। অর্ণবকে মুম্বই পুলিশ গ্রেপ্তার করার পরে মহারাষ্ট্র সরকারের এক মন্ত্রী বলেছেন, ‘আইনের উর্ধে আমরা কেউ নই।’       

পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘’আমি সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন সংবাদপত্রকেই পছন্দ করি। যদিও জানি যে অবাধ স্বাধীনতার ঝুঁকি অনেক, কারণ প্রতি মুহূর্তে অথবা যে কোনও মুহূর্তে স্বাধীনতা অপব্যবহার হতেই পারে। এতৎ সত্বেও অবদমিত অথবা নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র আমার একদম পছন্দ নয়।‘’  

( এই লেখাটি ২৯ অক্টোবর লেখা। ‘সপ্তাহ’ পত্রিকার জন্য। ৬ নভেম্বর সপ্তাহ পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশ হয়েছে।)                                               

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?