সূর্যের পাহারায় ভাঙা মেঘের গান
দীপেন্দু চৌধুরী
দুর্গাপুজো মানেই মিলনোৎসব। ভারতের অঙ্গ রাজ্য
পশ্চিমবঙ্গে বসে বলতেই হবে বাঙালির সেরা উৎসব। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঋতু চেনার
সময় বর্তমানে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ছয় ঋতুর বৈচিত্র উপভোগ
আমরা শৈশব কৈশোর যৌবনে করেছি। তখনও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল গ্রীনহাউস গ্যাস আমাদের
শৈশব দখল করতে পারেনি। কৈশোর যৌবনেও গ্রীনহাউস গ্যাস, জলবায়ু পরিবর্তন, ঘন ঘন
কালবৈশাখী ঝড়, সাইক্লোন এসব শব্দ আমাদের দৈনন্দিন অভিধানে ছিল না। শরৎকালে
সন্ধ্যের পরে টুপ টুপ করে হিম পড়া। না কোনও শব্দ হয় না। নীরব নিভৃতে আমাদের দেহের
বর্ষা শেষের উত্তাপ শুষে নিতে থাকে। শরৎকালের নিঃশব্দ হিম। শিশির ভেজা শরতের
কাশফুল, শিউলিফুলের শাশ্বত সাদর আমন্ত্রণে আমরা আমাদের স্মৃতি মন্থন করি। দুর্গাপুজোর
সময়কাল শরৎঋতু। এই কারণে শিউলিফুলের সঙ্গে একটা দীর্ঘায়ত সম্পর্ক আমাদের গড়ে ওঠে। আমার
মনে আছে, বিগত শতাব্দীর ৭৬ সালের কথা।
আমার এক বন্ধুর বাবার ধান ভাঙা এবং গম ভাঙার কল
ছিল। নতুন তিনতলা বড় বাড়ির এক তলায় ওদের এই ব্যবসা ছিল। ওদের বাড়িতে খুব বড় করে
বিশ্বকর্মা পুজো হতো। পুজোরদিন খুব ভোরে আমার সেই বন্ধু আমাদের বাড়ি চলে আসত।
আমাদের বাড়ির দরজার সামনে একটা বড় শিউলি ফুলের গাছ ছিল। বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য
আমরা শিউলিফুল সংগ্রহ করতাম। সেই কৈশোরবেলা টপকে সদ্য যৌবনের শিউলিফুলের স্মৃতি।
ভোরের শিশিরে ভেজাশিউলি আরও তরতাজা হয়ে আগমনীর জানান দিত। সেই সময় থেকেই আমাকে
পেয়ে বসে শিউলি প্রেম। শ্বেতশুভ্র শিউলি প্রণয়। শিউলি ফুলের কমলা রঙের বৃন্তের
সঙ্গে আমার সেই বন্ধু যুবতী নারীর স্তনের বোঁটার মিল খুঁজে পেত। সে কল্পনায় খুঁজে
নিত নিজের পছন্দের সেই যুবতী নারীর ভরাট স্তনের বৃন্ত।
শিউলি ফুলের সঙ্গে ভালোবাসা, প্রেম এসবের কোথাও একটা মিল যে আছে সেটা আমরা
অস্বীকার করতে পারি না। বহুল প্রচলিত কিংবদন্তি আছে। পারিজাত নামে নাগরাজের এক
কন্যা ছিল। পারিজাত সূর্যদেবকে ভালোবাসতেন। সূর্যদেব নিজেও পারিজাতের প্রেমে কাতর
ছিলেন। কিছুদিন পরে সূর্যদেবের জীবনে অন্য নারী আসে। তার প্রেমে পড়ে সূর্যদেব
পারিজাতকে পরিত্যাগ করেন। দুঃখ সহ্য করতে না পেরে প্রাণত্যাগ করেন পারিজাত। কিংবদন্তি
হচ্ছে, ভালোবাসার জন্য আত্মহুতি দেওয়া পারিজাতের চিতাভস্ম থেকে নাকি শিউলি গাছের
জন্ম। হে প্রেম তোমার কাছে আমি প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। আমার বেদনা থেকে শিউলির
শাখা-প্রশাখা কমলা বৃন্তের শ্বেত শুভ্র হয়ে ফুটুক। পারিজাতের অভিমানী প্রেমের
চিরন্তন আবেদনে, শিউলিফুলের শাখা-প্রশাখায় শিউলি কমলা বৃন্তের শ্বেতশুভ্র হয়ে আজও ফোটে।
সূর্যদেবের প্রেম থেকে ব্যর্থ হয়ে পারিজাতের অভিমানে শিউলিফুল সূর্যোদয়ের আগেই ঝরে
পড়ে যায়।
দুর্গাপুজো কি চারদিনের না পাঁচদিনের? ষষ্ঠীতে বোধন দিয়ে পুজো শুরু হয়। বেল
গাছের নীচে প্রথম পুজো করা হয়। সপ্তমীর দিন নবপত্রিকা স্নান করিয়ে প্রতিমার পাশে
স্থাপন করে পুজো আরম্ভ। তারপর সপ্তমীর সকালে কলাবউকে স্নান করিয়ে দুর্গাবাড়ি বা
পুজো মন্ডপে রাখা হয়। ঘটে গঙ্গার জল নিয়ে এসে দুর্গা প্রতিমার সামনে স্থাপনও করা
হয় সেদিনই। অষ্টমী পুজোয় ভোগ নিবেদন। সন্ধি পুজোয় ১০৮ টি প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবীর
আরাধনা। নবমীতে হোমযঞ্জ এবং ১০৮ টা বেল পাতা দিয়ে পুজোর নিয়মবিধি মেনে পুজো করা হয়।
দশমীতে দর্পণ বিসর্জনের পরে আসে সব থেকে বড় সামাজিক বিনিময়ের সংস্কৃতি। প্রতিমা
বিসর্জনের আগে হয় সিঁদুর খেলার অনুষ্ঠান। এয়োতি মেয়েদের
সিঁদুর খেলার অনুষ্ঠান। চেনা অচেনার বাঁধ
ভেঙে, জাত-পাতের সীমানা পেরিয়ে, শাঁখের আওয়াজে মান-অভিমান খান খান করে সমাজ আমাদের
মিলনমেলায় সম্মিলনের আহ্বান জানায়। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব শারদীয় দুর্গাপুজোর বিশেষ
বিশেষত্ব এই সংস্কৃতি বহন করে চলেছে। প্রতিমা বিসর্জনের পরে আমরা জাত-পাত,
ধর্ম-বর্ণ, শত্রুমিত্র নির্বিশেষে পরস্পর পরস্পরকে কোলাকুলি করি। পরস্পরে ভারতীয়
সনাতন ধর্মের আনুষ্ঠানিক মিলনের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মানবতার বৃহৎ পরিসরে এসে দাঁড়াই।
শরৎ-হেমন্তের শিশিরভেজা শিউলিফুলের যমজ ঋতুতে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি
সামজিক মহা মিলনমেলার শঙ্খনাদ আওয়াজ আজও শোনা যায়।
‘ভারতে ধর্মের উদারতা’ নিবন্ধে ক্ষিতিমোহন সেন লিখছেন, ‘’যদি বিবর্তনবাদ
বিশ্বাস করতে হয়, তবে পশুই আগে মানুষ অনেক পরে। পশু-জগতে শক্তিই প্রধান কথা। যে
শক্তিমান, সে প্রধান হয়ে সকলকে দাবিয়ে রাখবে আর সবাই মাথা নীচু করে তার নির্দেশ
পালন করবে। এই দলপতিত্ব পদ পাবার জন্য পশুদের মধ্যে কম মারামারি রক্তারক্তি চলে
না। দলপতিকে শক্তিহীন বুঝলেই নতুন পদপ্রার্থীর দল এসে যুদ্ধে ডাক দেয়। সেই ডাকে
সাড়া দিলেও তার প্রভুত্ব গেল হারলেও প্রভুত্ব গেল।
বহু যুগ পরে ক্রমবিকাশে মানুষ এই জগতে এলো। তার পরেও তো কমদিন হয়নি। তবু কি
মানুষ আজও সেই আদিম পশুধর্ম হতে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পেরেছে? পরপর কয়টা মহাযুদ্ধ
প্রমাণ করেছে যে, মানুষ এখনও পশুধর্ম হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারেনি। তবে
মানুষের মধ্যে উচ্চতর আদর্শও যে এসে তাঁকে একটুও দীপ্ত করেনি, একথাও বলা চলে না।‘’
(দেশ, ১৪ বর্ষ, ৫ সংখ্যা, ৭ ডিসেম্বর ১৯৪৬)
দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকমাস আগে শ্রদ্ধেয় ক্ষিতিমোহন সেন যে কথা লিখে
রেখেছেন আজও সেই কথা প্রাতঃস্মরণীয়। কারণ গত কয়েক বছর ভারতে ভেদাভেদের সংস্কৃতি
আমাদের মানবতার আকাশ কালো করে দিতে চাইছে। তবু দীপ্তমান মানবতা আমাদের পাহারা দিয়ে
জানিয়ে দিয়েছে, সূর্যের পাহারায়, ভাঙা মেঘের গান আমরা প্রতিদিন গাইতে পারি। ভোরের
ভেজা শিউলিফুল বেলা শেষে আজও দীপান্বিতা। বিজয়ার পরেই হয় মহামিলন।
Comments
Post a Comment