সার্বভৌমত্বের বৃহত্তর গণতন্ত্র আবার সাবেক পথ চেনাবে!
দীপেন্দু চৌধুরী
ইতিহাস দাবি করছে, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট
উডরো উইলসন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ নিজেদের কূটনৈতিক দ্বিধা দ্বন্দ
মেটাতে শান্তি আলোচনায় বসেন। কিন্তু সেই আলোচনা ব্যর্থ হয়। শুরু হয় নতুন বিশ্বের
ভারসাম্য। তথা দ্বিতীয় বিশ্বের মঞ্চ। গত একশ বছরে দ্বিতীয় বিশ্বের ভারসাম্যে
বিস্তর টাল মাটাল হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ঠান্ডা যুদ্ধের যুগ শুরু
হয়েছিল। দুই মেরুর বিশ্ব। তারপরে এক মেরু বিশ্বে আমেরিকান হেগেমনি সারা বিশ্ব
দেখেছে। সারা বিশ্ব জুড়ে মার্কিন আধিপত্য। বিংশ শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
ছিল প্রথম শ্রেণীর অর্থনীতির দেশ। পরিমাপে ছিল আগের থেকে অনেক বড় মাপের। উনবিংশ
এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভূত
হয়।
গ্রাম নির্ভর একটি সামন্ত কৃষিপ্রধান রাষ্ট্র থেকে শিল্পসমৃদ্ধ দেশ হয়ে
ওঠে। কয়লা, ইস্পাত, বাস্পশক্তি এবং রেলপথকে মাধ্যম করে এক উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে
স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। সারা বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশের সঙ্গে প্রতি তুলনায়। শিল্পোন্নত
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম কারিগর ছিলেন, প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন।
১৮২৯ সাল থেকে ১৮৩৭ সাল। আট বছরে বাগ্মী জ্যাকসন ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে পশ্চীমের
বাসিন্দা, কৃষক এবং শ্রমিকদের এক পতাকার তলায় এনে কার্যকর জোট গড়ে তুলতে
পেরেছিলেন।
বিংশ শতাব্দীতে দু’টো বিশ্বযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক
মহামন্দার সঙ্গে লড়ে আমেরিকা নামক দেশটি এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং নিজেদের দেশ
আমেরিকায় আধিপত্য বিস্তার করতে সফল হয়েছিল। এই শতাব্দীতেই প্রবল
মুদ্রাস্ফীতি, এবং বেকার সমস্যা নিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামক মহাশক্তিধর দেশ
১৯৯০ সালে উদার অর্থনীতির হাত ধরে আর্থিক স্থিতিশীলতার ভারসাম্য ফিরে পায়। বিশ্বায়ন
সভ্যতা, মল সংস্কৃতির পাশাপাশি বিশ্ব সন্ত্রাসের দাপট সামলাতে হয় আমেরিকার
রাষ্ট্রনায়কদের। ২০০৮ সালে ‘লে ম্যান ব্রাদার্স’-এর পতনের পর বিশ্ব অর্থনৈতিক
মন্দার সঙ্গে যুঝতে হয় ওবামা প্রশাসনকে। এবং
সন্ত্রাসবাদ নামক এক ভয়ঙ্কর শক্তির সঙ্গে লড়তে হয় প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে। বিশ্ব
বাজারে ধস নামার পাশাপাশি মার্কিন শতাব্দীর অবসান কি একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম?
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বের সময়কালে? ১৭ অগস্ট থেকে শুরু হওয়া
ডেমোক্রাটদের জাতীয় সম্মেলনের অনলাইন মঞ্চ থেকে ট্রাম্পকে চাছাছোলা ভাষায় বিঁধলেন
ডেমোক্রাট নেতা বার্নি স্যান্ড্রার্স। দেশের বেহাল অর্থনীতি এবং কোভিড-১৯
মহামারিতে মার্কিন নাগরিকরা বিপর্যস্ত। আমেরিকায় এই মহামারিতে মারা গিয়েছেন ১ লক্ষ
৬৫ হাজার মানুষ। সম্প্রতি রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব অ্যান্টেনিও গুয়েতেরেস
বলেছেন, ১৮৭০ সালের পর বিশ্বের আয় বর্তমানে সর্বনিম্ন। ১৫০ বছরে বিশ্বের মোট আয়
সর্বনিম্ন।
করোনার থাবায় মৃত্যুহারে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে আমেরিকা। সেই প্রসঙ্গকে উল্লেখ করে বার্নি বলেন, ‘রোম
যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো বেহালা বাজাচ্ছিলেন। আর উনি গল্ফ খেলে চলেছেন।‘’ করোনা
আবহের কারণে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার এই বছর অনেক দেরি করে শুরু
হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরটা প্রথম থেকেই হৈ হৈ
করে শুরু হয়ে যায়। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী বছরে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম থেকে
প্রচার মাধ্যমে তথা সংবাদ মাধ্যমে জায়গা করে নিতে থাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট
নির্বাচন। চলতি বছরে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট
প্রক্রিয়া শেষ হয়। সংসদের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টটিভস-এ দোষী প্রমাণিত
হয়েছিলেন ট্রাম্প। উচ্চকক্ষ সেনেটে-এ নির্দোষ ঘোষিত হন তিনি। প্রায় আরাইশো বছরের
মার্কিন গণতন্ত্রে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া হতে দেখা যায়
মাত্র তিন বার। সেই সরণীতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামও সংযোজিত হয়ে রইল। ভারত এবং
আমেরিকার আর্থসামজিক পরিস্থিতি প্রশ্ন তুলছে অংশীদারি গণতন্ত্র টিকে থাকবে? না পতন
হবে? উদার গণতন্ত্র তথা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র কি ভেঙ্গে পড়বে? ব্রিটিশ আধুনিক
গণতন্ত্রের কাঠামো তৈরি করতে সময় লেগেছিল ৭০০ বছর। ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা থেকে
১৯২০-র মহিলাদের ভোটাধিকার প্রাপ্তি। এই সময়টাকে বলা যায়, ৭০০ বছরের পরিক্রমা।
মার্কিন সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘’উই দ্য পিপল অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস, ইন
অর্ডার টু ফর্ম আ মোর পারফেক্ট ইউনিয়ন’’। মার্কিন সংবিধানের এই প্রস্তবনা কি
বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্বের সঙ্গে পালন করতে পারছেন? বিশ্বের বৃহত্তম
গণতন্ত্র কি বর্তমান প্রশাসকের হাতে বিপন্ন? উচ্চ শিক্ষা সংস্কৃতির দেশ আমেরিকাকে
আমরা কেন ভরসা করতে পারছি না? খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসছে, নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ
যুবক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ স্লোগানকে কেন্দ্র করে
বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন। আমেরিকা সহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় ছোট শহরে
এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। সামাজিক মাধ্যমে হ্যাজট্যাগ ব্যবহার করে এই আন্দোলনের
পক্ষে সমর্থন করতে দেখা যায়, শিক্ষিত অল্প শিক্ষিত সচেতন তরুণ থেকে প্রৌঢ়কে। মার্কিন
দেশে অভিবাসন একটি সমস্যা। সব প্রেসিডেন্টকেই সামলাতে হয়েছে।
আলোচ্য প্রেসিডেন্টের সময়কালে ভারতীয় তথা এশিয়রাও চিন্তিত। তারা
দুশ্চিন্তায় আছেন, তাদেরও কি মার্কিন মূলুক ছেড়ে চলে যেতে হবে? বর্তমান প্রশাসনের
নতুন অভিবাসন নীতির গেরোয়! ২০১৯ সালের ১২ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড
ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘’বহু মানুষ এ দেশে অবৈধ ভাবে ঢুকছেন এবং বসবাস করছে,
আমরা তাঁদের বৈধ ভাবে ফেরত পাঠাতে চাই।‘’ এই বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে
ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, তিনি নির্বাচিত হয়ে আসলে
এইচ-১ বি ভিসা আইন নতুন করে পর্যালোচনা করা হবে। মার্কিন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস
করার ছাড়পত্র গ্রীনকার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা আরও সহজ করা যায় কিনা তার প্রশাসন নতুন
করে ভেবে দেখবে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েই সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে বিতর্কে
জড়িয়ে পড়েন। বেশ কয়েকটি ঘটনার পর সিএনএনের সাংবাদিক জিম অ্যাকোস্টার আদালতে আবেদন
করেন তার হোয়াইট হাউসে খবর সংগ্রহের প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
ওয়াশিংটন ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারপতি যে কেলি হোয়াইট হাউসকে নির্দেশ দেন
জিমের কার্ড ফিরিয়ে দেওয়ার। ট্রাম্প প্রশাসন বাধ্য হয় সেই নির্দেশ মানতে। সারা
বিশ্বে এই রায়ের প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন দেশে শাসকের দমন নীতির বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের
লড়াই করার ক্ষেত্রে এই রায় মাইলস্টোন। সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা সাড়ে তিন বছর
অপেক্ষা করেছে। চলতি বছরের ১৩ অগস্ট ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক এস ভি ডাটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ছুঁড়ে দিলেন মোক্ষম প্রশ্ন। ‘’এই যে সাড়ে
তিন বছর ধরে মার্কিন দেশের মানুষের সঙ্গে লাগাতার মিথ্যাচার করে আসছেন, সে জন্য
আপনার অনুশোচনা হয় না?’’ বিব্রত প্রেসিডেন্ট সাংবাদিক ডাটেকে এড়িয়ে বুঝিয়ে দিতে
চেয়ছিলেন এই ধরণের প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি অভ্যস্ত নন।
ডেমোক্র্যাটদের জাতীয় সম্মেলনের অনলাইন মঞ্চ থেকে মিশেল ওবামা মনে করিয়ে
দিয়েছেন। বিভাজনের রাজনীতি বর্জনের কথা বলেন তিনি। তার কথায় ‘’অশান্ত পরিস্থিতিতে
যখনই আমরা হোয়াইট হাউসের দিকে তাকিয়েছি, বারেবারে হতাশ হতে হয়েছি।‘’ অভিযোগটা আরও তীব্র আকারে
এল ডেমোক্র্যাট দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত (ভারতীয় বংশোদ্ভূত) কমলা হ্যারিসের
কাছ থেকে। তিনি বলেন, ‘’ট্রাম্প প্রশাসন আমাদের কী দিয়েছে? দেশে দেড় কোটি মানুষের
কাজ নেই। লক্ষ লক্ষ শিশু স্কুলে যেতে পারছে না। দারিদ্র আমাদের সামনে এসে বিভীষিকা
হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নতুন সমস্যায় ফেলছে। কৃষ্ণাঙ্গ, অ-শ্বেতাঙ্গ এবং দেশের আদি
বাসিন্দারা আজ গৃহহীন। তাঁরা নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছে। প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে এক
জন আজ খাদ্য সঙ্কটের শিকার।‘’
সম্প্রতি ওয়ালস্ট্রীট জার্নাল এবং এনবিসির যৌথভাবে করা প্রাক নির্বাচনী
জনমত সমীক্ষার যে ফলাফল পাওয়া গেছে। ডেমক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে ৫০ শতাংশ থেকে ৪১ শতাংশ এগিয়ে
আছেন। প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সমর্থকরা বলছে, তাঁরা ট্রাম্প বিরোধী
এবং বাইডেনের পক্ষে মত দেবে।
সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, ১৫ অগস্ট জো বাইডেন ভারতীয় প্রশাসনকে আশ্বস্ত করে
বলেছেন, তিনি জিতে আসলে তাঁর প্রশাসন ভারতকে বিশেষ মর্যাদার (হাই প্রায়োরিটি) দেশ
হিসেবে দেখবে। চিন এবং পাকিস্তানের নাম না করে
তিনি আরও বলেছেন, ‘’নয়াদিল্লিকে তাদেরই সীমান্ত এলাকায় যে সব বিরুদ্ধ শক্তি
ভয় দেখায়, আমরা ক্ষমতায় ফিরলে তার বিরুদ্ধেও লড়ব। সব সময় সব ক্ষেত্রে ভারতের পাশে
দাঁড়াব।‘’
Comments
Post a Comment