বহ্নিমান চিতায় আজও মানবতার ঠিকানা খুঁজি




 

দীপেন্দু চৌধুরী

যে শ্মশানে আগুন জ্বলছিল, উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের তত্বাবধানে তৈরি অস্থায়ী শ্মশান আপনি আপনারা চেনেন? আমি চিনতাম আগে? হাথরসের ৪ টি দলিত পরিবারের সদস্যরা কেউ এই অস্থায়ী শ্মশানের ঠিকানা আগে জানত? হ্যা, ওই গ্রামে মাত্র ৪ টি দলিত পরিবার বাস করে। একই গ্রামে ৪০০ ঠাকুর পরিবার ‘জাত-পাত’-র সমীকরণ মেনে উঁচু জাতের সামন্ত গরিমা নিয়ে বাস করে। উচ্চবর্ণের বংশ তাঁদের। উচ্চবর্ণের মানুষ। তারা জানত দলিত কন্যাকে পৈশাচিক ধর্ষণের পরে কি করিতে হইবে। নির্ভয়া কান্ডের পরে সারা দেশ শিহরিত হয়েছিল। প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। একুশ শতাব্দীর করোনা সভ্যতায় আমরা আরও চমকে উঠলাম। একটি ১৯ বছরের নিষ্পাপ কিশোরী যাঁকে নিপীড়ন করে ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হল। তার জিভ কেটে দেওয়া হল। নারীজন্মকে বহ্নিমান চিতায় তুলে একদল প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি সমাজের প্রথমসারির মোড়লকে জানান দিল, আমরা তোমাদের পাশে আছি। এই প্রশাসন ভারতের আধুনিক গণতন্ত্রের প্রশাসন! কিন্তু আমরা বাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের হুকুম তালিম করতে প্রস্তুত থাকি। চিতায় দলিত নির্যাতিতা  কিশোরীর দেহ রাতের অন্ধকারে দাহ করে বলি, ‘জয় হোক ঠাকুরদের’ জয় হোক বলদর্পী ঠাকুরদের।   

তথাকথিত জাত্যাভিমান নিয়ে এখনও উচ্চগর্বী সমাজপ্রভুর দল মনে করে ‘দলিত’ দের উপর অমানবিক অত্যাচার করাটা তাঁদের জন্মগত অধিকার। তাই ওই গ্রামের ৪০০ বলদর্পী ঠাকুর পরিবার অস্থায়ী শ্মশানের ঠিকানা চিনত। ১৯ বছরের কিশোরী নিপীড়ন সহ্য করে প্রশাসনের তৈরি চিতায় দাউ দাউ করে জ্বলল। পরিবারের কেউ অনুমতি পেল না শশ্মানের কাছে যাওয়ার। না ভারতীয় গণতন্ত্রের চতুর্থস্তম্ভ সংবাদ মাধ্যমকেও চিৎকৃত বহ্নিমান চিতার ধারে কাছে যেতে দেওয়া হল না। নিপীড়িত দলিত মেয়েটির দিদির আর্তনাদ আছড়ে পড়ল। আজও শুনতে পাচ্ছি। তিনি বলছেন, ‘ও ছিল বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়ে। সবার আদরের। আমাদের মেয়ের দেহ পুলিশ আমাদের দিল না। ওকে দাহ করার আগে একটু হলুদ লাগাতে পারলাম না। দু’ফোটা জল ছিটিয়ে দিতে পারলাম না।’

দিদি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন,  আমাদের সমাজের ‘রীত’ ( সনাতনী নিয়ম বা সংস্কার) হল, মেয়েদের মৃতদেহে হলুদ লাগিয়ে সৎকার করা। সেই হলুদ আমাদের কচি মেয়ের ফ্যাকাসে হলুদ হয়ে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত দেহে লাগাতে পারলাম না। দিদির কান্না একসময় থেমে গিয়েছিল। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের তৈরি বহ্নিমান চিতার সেই আগুন সেদিন নির্যাতিতা মেয়েটির দিদির দু’ই চোখে। দু’চোখে ঘৃণার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। ক্ষোভে তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘’এখানে বসে ডিএম (জেলাশাসক) বলছে,  ’২৫ লাখ টাকা তো পেয়ে গেছ। মেয়ে করোনায় মরলে এই টাকা পেতে?’.........।‘’ পাশে বসে ডুকরে কাঁদছেন ১৯ বছরের হাথরস কন্যার মা। তিনি চিৎকার করে সাংবাদিকদের বললেন, ‘’চাই না, কিচ্ছু চাই না। টাকা চাই না! মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিকওর দেহটাকে সামনে এনে দিক। আর কিচ্ছু চাই না!’’

নিভন্ত এই চুল্লিতে মা

একটু আগুন দে

আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি

বাঁচার আনন্দে!

যমুনাবতী, শঙ্খ ঘোষ

৩ অক্টোবর হাথরসের নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে রাহুল গাঁধি এবং প্রিয়াঙ্কা ৩৫ জন সাংসদকে নিয়ে এআইসিসি সদর দফতর থেকে রওনা দিয়েছিলেন। মিনিবাসে করে যাচ্ছিলেন সাংসদদের দল। রাহুল-প্রিয়াঙ্কা ছিলেন আলাদা গাড়িতে। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ রাজ্য প্রশাসন খাকি উর্দির প্রাচীর তৈরি করে আটকে দেয় তাঁদের। এক পুরুষকর্মী প্রিয়াঙ্কার পোশাক টেনে ধরে তাঁকে বাঁধা দেয়। অবশ্য যোগী সরকার শেষ পর্যন্ত সমালোচনার চাপে রাহুল, প্রিয়াঙ্কা সহ পাঁচজন কংগ্রেস নেতাকে ১৯ বছরের নির্যাতিতা দলিত মেয়েটির বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেয়। কিন্তু পরে আটকে দেওয়া হয় আইনজীবী সীমা কুশওয়াহা সহ আরও এক আইনজীবীকে। সীমা স্বেচ্ছায় নির্যাতিতার কিশোরীর হয়ে মামলা লড়বেন ঘোষণা করেছেন। নির্ভয়ার মামলাও সীমা লড়েছিলেন

হাথরসে যাওয়ার সময় গ্রেপ্তার হলেন কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কান্নান সহ তাঁর তিন সঙ্গী। তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে। বিরোধী শিবির কটাক্ষ করে বলছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগান নিয়ম করে বলে থাকেন। কিন্তু নারী সুরক্ষা, নারীর স্বাধীনতা অধিকারের বিষয় আসলেই তিনি উল্লেখ করেন তিন-তালাক রদ আইন। অথচ হাথরস নির্যাতিতার সঙ্গে পৈশাচিক আক্রমণের পরে এখনও তিনি রা-টি কারেননি। সেই জন্যই কি রাহুল গাঁধি বলেছেন, ‘’লজ্জার বিষয় এটাই যে, অনেকেই দলিত, মুসলিম এবং তফসিলদের মানুষ বলেই মনে করেন না।‘’ প্রসঙ্গত, একটি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে মোদীর সরকার ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও প্রকল্পের ৪৫ শতাংশ টাকা খরচই করতে পারেনি।

‘আপনার নিজের মেয়ে হলে এই কথা বলতে পারতেন?’

ভারতে দলিত পরিবারের মেয়েদের বিপদ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বিপদ যেন পায়ে পায়ে চলে। অর্থনৈতিক বঞ্চনা, কম শিক্ষা, অপুষ্টি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যজনিত কারণ থাকে দলিত মেয়েদের বিকাশের পথে। সামাজিক স্বীকৃতির গভীর থেকে গভীর স্তরে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় দলিত সম্প্রদায়ের মেয়েদের বিভিন্ন কারণে বেকারি এবং শারীরিক অত্যাচারের শিকার হতে হয় দলিত মেয়েদের। প্রায় ৮৫ শতাংশ দলিত নারী কাজ করে কৃষিক্ষেত্রে। এরা সাধারণত অদক্ষ নারীশ্রমিক। অসংগঠিত এই সব ক্ষেত্রে মেলে না কোনরকম সামাজিক সুরক্ষা। যে সুরক্ষা সংগঠিত ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। সেই কারণেই কি বংশানুক্রমিক ভাবে দলিত পরিবারের মেয়েদের উপর নেমে আসে পৈশাচিক অত্যাচার? এই অত্যাচার? হাথরসের অসহায় দলিত কিশোরী মেয়ের উপর অত্যাচার? রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে দিতে হয় নির্যাতিতার দেহ। প্রমাণ লোপাটের জন্য? এই অত্যাচার বন্ধ করার জন্য দেশে সংবিধান প্রণেতারা আইন তৈরি করে গেছেন। ডঃ আম্বেদকর লিখিত সংবিধানের নৈতিক অধিকার থেকে আজও বঞ্চিত রয়ে গেলেন এই সম্প্রদায়। মনুবাদী রাজনীতির প্রধান চাবিকাঠি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়।

সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের দাবি, গত চার বছরে দলিত মহিলাদের উপর বলাৎকারের সংখ্যা ৩৭ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে সর্বাধিক ৬৬.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।  

জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর সাপ্রতিক তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, গত আর্থিক বছরে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩২, ০৩৩ টি। এদের মধ্যে ১১ শতাংশই হলেন দলিত সমাজের। তথ্য থেকে আরও জানা যাচ্ছে, ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে প্রত্যেকদিন ৮৮ জন মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এবং প্রতি একশোটি ধর্ষণের ঘটনায় ২৭ জন অভিযুক্তের শাস্তি হচ্ছে। হাথরসের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে সেই সত্য জানান দিয়ে গেল। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯ বছরের হাথরসের দলিত কন্যা নির্যাতিতা হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। তাঁর পরিবার স্থানীয় থানায় ধর্ষণের অভিযোগ করে। কিন্তু থানা ‘ধর্ষণ’ না লিখে এফআইআরে ‘খুনের চেষ্টা’ লেখে। মনুবাদী ঠাকুর পরিবারের নির্দেশ এবং সামাজিক আধিপত্য মেনে। নির্যাতিতা কিশোরীর মৃত্যুর পরে ‘খুন এবং ধর্ষণ’ এফআইআরে সংযোজিত করা হলেও,  পুলিশ বলছিল হাথরসের নির্যাতিতাকে ধর্ষণ করা হয়নি। ১২ অক্টোবর এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন। ঠাকুর পরিবারের প্রশাসনের পুলিশ কর্তাদের উদ্দেশ্যে বিচারপতি বলেন, ‘’কী করে বলছেন ধর্ষণ হয়নি, তদন্ত কি শেষ হয়ে গিয়েছে? আপনার বা কোনও ধনী পরিবারের মেয়ে হলে পারতেন তাঁর দেহ এভাবে পুড়িয়ে দিতে?’’

দৈনিক সংবাদপত্র লিখছে,  এলাহাবাদ হাইকোর্টে পুলিশের এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) দাবি করেন, হাথরসের ঘটনা যোগী সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার ‘আন্তর্জাতিক চক্রান্ত’। ধর্ষণের কোনও ঘটনাই হয়নি। বিচারপতি তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘’কী করে জানলেন ধর্ষণ হয়নি।‘’ এর পরেই বিচারপতি বলেন, ‘’আপনার নিজের মেয়ে হলে এই কথা বলতে পারতেন? দরিদ্র দলিতের মেয়ে না-হয়ে কোনও ধনী পরিবারের মেয়ে হলে পারতেন তার দেহটা এই ভাবে রাতের অন্ধকারে জ্বালিয়ে দিতে?’’  

ভারতীয় রাজনীতির অন্ধকারের পরিসরটা সব সময় আদালতকে কেন বলে দিতে হবে? সেই কারণেই কি কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গাঁধি বলেছেন, ‘এক জন নির্যাতিতা হয়েছেন, কিন্তু উত্তরপ্রদেশের সব নারী এই সরকারকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবেন।‘’                                     

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?