কৃষিক্ষেত্রে যন্ত্রসভ্যতার অভিশাপ কি নেমে আসছে!




দীপেন্দু চৌধুরী

২০০৭-০৮ সালের আর্থিক সংকট থেকে বিশ্বের কর্পোরেট সংস্থাগুলি বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। এই তথ্যের সারবত্তা সারা বিশ্বজুড়ে বৃহৎ ব্যবসার ক্ষেত্রগুলি বিশ্লেষণ করলেই পাওয়া যায়। প্রাক কোভিড-১৯ আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। পুঁজিবাদকে এই ব্যবস্থায় ফিরে আসতে সারা বিশ্বে সাহায্য করেছে বিভিন্ন দেশের সরকার। কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষভাবে পুঁজিবৃদ্ধির জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র নামক আরও এক বৃহৎ শক্তিআমাদের দেশ ভারতে রেল সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিলগ্নীকরণের ঝোঁক সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। কোভিড-১৯ আবহের মধ্যে ভারতের ধনীদের বিষয়ে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। আইএফএল ওয়েলথ হুরুন ইন্ডিয়ান রিচ লিস্ট ফর ২০২০ এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতের প্রথম ১০০ জন বিত্তবানের হাতে দেশের প্রায় ৬৪ শতাংশ সম্পদ রয়েছে। এই তালিকায় আরও দাবি করা হয়েছে, ১০০০ কোটির বেশি সম্পত্তি আছে ভারতের ৮২৮ জনের কাছে। এদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ৮২১ মিলিয়ন ডলার। আম্বানী-আদানী সহ ভারতে প্রথমসারির ১০টি শিল্পগোষ্ঠী দেশের মূল কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করছে। এই রিপোর্ট থেকে সেই তথ্যও  উঠে এসেছে।  

২০ সেপ্টেম্বর কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয় এবং কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত করা হবে এমন একটি বিল রাজ্যসভায় পাস হয়েছে। বিরোধী দলগুলির আপত্তিকে উপেক্ষা করে। এই বিল পাস করে কেন্দ্র দাবি করে, বিলে কৃষকদের সুরক্ষা এবং চুক্তি সংক্রান্ত বিষয় আছে। এবং কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের জন্যই এই বিল আনা হয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি পাল্টা দাবি করছেন, মোদী সরকারের উপর থেকে চাষিদের আস্থা উঠে গিয়েছে। চাষিরা জানেন, এই সব কৃষিআইন এনে মোদী সরকার নিজের বন্ধু শিল্পপতিদের ব্যবসা বাড়াবে। চাষিদের রুটি রুজিতে হাত দেবে। কৃষি সংস্কার বিল বিষয়ক অভিযোগকে আরও ধারালো করে শাণ দিয়ে রাহুল বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, পঞ্জাব হরিয়ানা তথা গোটা দেশে কৃষি ক্ষেত্রে তিনটি স্তম্ভকে অকেজো করে দিতে চাইছে। কৃষকদের জমি কেড়ে নিয়ে তার শিল্পপতি বন্ধুদের দিতে চান। এটা মোদী সরকার নয়, আম্বানী, আদানীর সরকার। ওরা কৃষকদের থেকে জমি কেড়ে নিয়ে দেশের দু’তিন জন ধনকুবেরকে দিতে চায়।’ কৃষি বিল নিয়ে পঞ্জাবের কৃষকরা ক্ষোভে ফুটছে। তিন দিনের ‘ক্ষেতি বাঁচাও’ ট্রাক্টর যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে ৪ অক্টোবর রাহুল পঞ্জাব যান। সেদিনই এই কথা বলেন।

একটি তথ্যের উল্লেখ করা যায়, ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, শুধু ২০১৯ সালেই ভারতে ৪২, ৪৮০ জন কৃষক ও দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন। মোদী জমানায় দেশে প্রতিদিন ৩৮ জন বেকার এবং ১১৬ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন! কৃষক আত্মহত্যার অন্যতম কারণ কৃষিতে ভয়ঙ্কর মন্দা। কৃষকরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। ফলে অনাদয়ী ঋণ মেটাতে পারেন না। ভারত একটি ‘উদীয়মান বাজার’। পশ্চিমের দেশগুলি ভারতকে পণ্য এবং পরিষেবার ক্ষেত্রে এই ভাষায় নিজেদের পত্র-পত্রিকায় উল্লেখ করলেও গ্রামীণ মানুষের সমস্যার কথা তারা লেখে না।

২০১৯ সালে ভারতের গড় জাতীয় আয় বর্তমান দরে ২০০০ মার্কিন ডলারের বেশি। বিশ্ব ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান এমনটা দাবি করছে। ত্রিশ বছর আগে এটাই ছিল ৩০০ ডলারের কাছাকাছি। পশ্চিমের সংবাদ মাধ্যম এই তথ্য তুলে ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের পক্ষে দাঁড়ালেও বাস্তবের ছবিটা সম্পূর্ণ উল্টো। ভারতে বেকার চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা করছে। সরকারি চাকরিতে নিরাপত্তা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকছে না। বয়স পঞ্চাশ হলেই কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের মূল্যায়ন হবে। পরে তাঁদের স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার কথা বলা হবে। শ্রমিকরাও আটঘণ্টা কাজের অধিকার হারিয়েছে নতুন শ্রম আইনে।   

সম্প্রতি একটি ভার্চুয়াল আলোচনাসভায় সমাজকর্মী তুষার গাঁধি বলেন, পুরনো সামাজিক ভারতের গ্রমীন ব্যবস্থার বন্ধন ছিল। যে গ্রামের কথা মহাত্মা বলেছিলেন। গ্রামকে ভিত্তি করে গ্রামীণ মানুষ যে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল সেই গ্রামীণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আধুনিক যন্ত্র গ্রামের আর্থসামাজিক মেরুদণ্ড ভেঙে খান খান করে দিয়েছে। গ্রামের শ্রমজীবী মানুষ কাজের প্রয়োজনে ভিন রাজ্যে বা ভিন দেশে যেতে বাধ্য হচ্ছে। মহাত্মা গাঁধির প্রপৌত্র তুষার গাঁধির আশঙ্কা, আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার নামে ভারতীয় চাষিদের আরও বড় চ্যালেঞ্জের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।        

কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলির মূল অভিযোগ, দেশের ৮৬ শতাংশ চাষির জমির পরিমাণ ২ হেক্টরের কম। এই সব জমির মালিকরা তাঁদের জমিতে উৎপন্ন ফসল সাধারণত স্থানীয় মান্ডিতে বিক্রি করে। বা গ্রামের বাজারে বিক্রি করে। কৃষি আইন লাগু হলে চাষিরা নিজেদের জমিতে উৎপাদিত আনাজ বাইরে কোথাও বেচতে যাবেন না। তাহলে কৃষি সংস্কার আইন কাদের জন্য? প্রশ্ন আরও উঠেছে, নতুন কৃষি সংস্কার আইনের বলে বেসরকারি বৃহৎ সংস্থাগুলি নিজেদের ইচ্ছে মতো খাদ্যশস্য মজুত করার অধিকার পাবে। নিজেদের সংস্থার প্রতিনিধি মারফৎ ছোট এবং মাঝারি চাষিদের থেকে ফসল কিনে নেবে বৃহৎ পুঁজির মালিক। সংস্থার ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থায় গড়ে তোলা ‘কর্পোরেট চেন’-র মাধ্যমে সেই সবজি বা কৃষিপণ্য বিক্রি করবে আম্বানী-আদানী গোষ্ঠী। যে অভিযোগ পঞ্জাবে ‘ক্ষেতি বাঁচাও’ ট্রাক্টর জাঠায় অংশ নিয়ে রাহুল করেছেন।   

বিকল্প ব্যবস্থা না থাকার কারণে চাষি বাধ্য হবে বৃহৎ পুঁজির মালিকের প্রতিনিধিকে ফসল বিক্রি করতেএর ফলে স্থানীয় মান্ডি বা বাজারে ভারতীয় কৃষক হারাবে তার ফসল বিক্রি করার পরম্পরাগত স্বাধীনতা। কংগ্রেস থেকে দাবি করে বলা হয়েছে, কংগ্রেসের ইস্তাহারে ছোট শহর ও বড় গ্রামে হাজার হাজার কৃষিবাজার তৈরির কথা বলা আছে। কিন্তু কেন্দ্রের নতুন বিলে কোথায় সে কথা লেখা আছে? বিলের কোন পরিচ্ছেদে কৃষকদের সহায়ক মূল্য (এমএসপি) দেওয়ার কথা লেখা আছে? জানতে চাইছে কংগ্রেস সিপিএম সহ বিরোধী দলগুলি। অথবা কম দামে যাতে চাষিরা ফসল বিক্রি করতে বাধ্য না হয় সেই বিষয়ে নিশ্চিত করা হবে কি? এই বিলের ক্ষমতায়?

বিরোধী দলের নেতৃত্বের আশঙ্কা এই বিল ‘চুক্তি চাষ’ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রাথমিক ধাপ। পঞ্জাব হরিয়ানার চাষিদের থেকে পূর্ব ভারতের ছবি সম্পূর্ণ আলাদা। চুক্তি চাষের সুফল আদৌ পাওয়া কি সম্ভব পূর্ব ভারতের ছোট জমির মালিকদের? উত্তর জানা নেই। পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্যে ভাগচাষি নিজেদের অধিকার ‘বর্গাদার’ হিসেবে নাম নথিভুক্ত করে এতদিন চাষ করে আসছিলেন। চুক্তিচাষ ব্যবস্থায় বর্গাদারের জমি, ছোট চাষির জমি হাত বদল হয়ে বৃহৎ পুঁজির মালিকের কাছে যাবে। প্রযুক্তি এবং কৃষিতে বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশের কারণে জমি থেকে উচ্ছেদ হবে ছোট ক্ষেতের মালিকরা। ভারতীয় কৃষকদের আরও ঘোর দুর্দিনের সম্মুখীন হতে বাধ্য হতে হবে। বিকল্পের কথা বলেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি। তিনি পঞ্জাবের ট্রাক্টর জাঠা থেকেই বলেছেন, ‘মোদী সরকার দেশের অন্নদাতাদের মুখের রুটি এবং পায়ের নীচের জমি কেড়ে নিতে চাইছে। তবে কংগ্রেস দেশের কৃষকদের ধ্বংস হতে দেবে না। যে দিন কংগ্রেস কেন্দ্রে সরকারে আসবে, এই তিনটি কালা কানুন আমরা বাতিল করব। ততদিন পর্যন্ত  আমাদের লড়াই চলবে।'

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?