মৃত্যু মিছিলের নিঃশব্দ উচ্চারণ আজও শোনা যায়
দীপেন্দু চৌধুরী
হোক পোড়া বাসি ভেজাল মেশানো রুটি
তবু তো জঠরে বহ্নি নেবানো খাঁটি
এ এক মন্ত্র! রুটি দাও, রুটি দাও,
বদলে যা ইচ্ছে নিয়ে যাওঃ
(রুটি দাও, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
সরকার আছে কিন্তু সরকারের নায়েব নেই ভারত নামক
একটি দেশে। তথ্য জানার অধিকার আইন আছে কিন্তু তথ্য রাখার দফতর নেই! এরকম ধারণা
করাটা কি খুব কিছু ভুল হবে? লকডাউনে কাজ খুঁইয়ে কত জন পরিযায়ী শ্রমিক রাস্তাতেই
মারা গিয়েছেন, সেই হিসেব কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে
কেন্দ্র। প্রায় ছ মাস পরে সংসদে অধিবেশনের প্রথম দিন ১৪ সেপ্টেম্বর লোকসভায়
পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় শ্রমমন্ত্রকের স্বাধীন
দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ারকে।
মোদী সরকারের শ্রমমন্ত্রক জানেই না লকডাউনের
কারণে কতজন পরিযায়ী (প্রবাসী) শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। কতজন শ্রমিক কাজ হারিয়ে বাড়ি
ফেরার তাগিদে বাধ্য হয়ে প্রখর রোদে, গরমে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে। এটা আমাদের
দুর্ভাগ্য। কেন্দ্র লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ মেহনতী পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা ভাবতেই আগ্রহী
নয়। এই সব পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে অর্ধাহারে, অনাহারে এবং থাকার জায়গার অভাবে
বাধ্য হয় বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরতে। লকডাউন চলা অবস্থায় ট্রেন নেই, বাস নেই, কোনওরকম
পরিবহণ নেই। ‘আত্মনির্ভর’ ভারতে নতুন মহাভারত লেখা হয়ে যায় রাজপথে, জনপথে। পুলিশের
অত্যাচার সহ্য করেই হাজার হাজার মাইল হাঁটলেন তারা। নিজের বাড়ি ফিরতে হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ পথ। রাস্তায় না আছে খাবার, না পাওয়া যায় এক ঘটি জল (এখন বলতে হবে এক
বোতল জল), পকেটে পর্যাপ্ত অর্থও নেই। মৃত্যু হল এক এক করে। না খেতে পেয়ে। দুর্ঘটনায়, ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু
হল ওদের। অসুস্থ হয়ে শয়ে শয়ে, আহত হয়ে উত্তপ্ত রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন অনেকেই।
কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও হেল দোল ছিল না।
কি মর্মান্তিক ঘটনা! ঔরংগবাদের জালনা ইস্পাত
কারখানার ২০ জন শ্রমিকের দলটি বাড়ি ফিরবে বলে রওনা দিয়েছিল। যাবে মধ্যপ্রদেশে
নিজেদের গ্রামে। ৪০ কিমি হাটার পর সূর্য ঢলে পড়ে। হা ক্লান্ত শরীর নিয়ে আর হাঁটতে
পারছিল না। ২০ জনের দলটি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রেললাইনের উপরেই আশ্রয় নেয়। এবং গভীর
ঘুমে ঢলে পড়ে। ওরা জানত লক ডাউনে ট্রেন
চলবে না। কিন্তু ওরা জানত না পণ্য সভ্যতায় সরকারের প্রয়োজনে পণ্যবাহী ট্রেন চলছে। ৮
মে ভোরে মালগাড়ি পিষে দিয়ে চলে যায় ১৬ জন পরিযায়ী শ্রমিককে। ঘামে ভেজা শুকনো রুটি,
আধ খাওয়া রক্তাক্ত রুটির ছবি উঠে আসে গণমাধ্যমে। মন্ত্র ছিল রুটি দাও রুটি দাও/
বদলে যা ইচ্ছে নিয়ে যাও। না সরকার থেকে এদের বাড়ি ফেরার কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি।
প্রায় কয়েক কোটি পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফিরে যায়। আমাদের রাজ্যে ১১ লক্ষ পরিযায়ী
শ্রমিক বাড়ি ফিরেছে।
শুরু হল জাতীয় আন্তর্জাতিক সমালোচনা। সামাজিক
মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠল। সংবাদ মাধ্যমেও উঠে আস্তে থাকল পরিযায়ী শ্রমিকদের
দুর্দশার ছবি। মানবাধিকারের প্রশ্ন উঠে এল। শ্রমিকদের বিষয় গেল হাইকোর্ট সুপ্রিম
কোর্টে। তবু সরকারের ঘুম ভাঙল না। হস্তক্ষেপ করলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধি। ৪ মে তিনি সিদ্ধান্ত ঘোষণা
করলেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার ট্রেন ভাড়ার দায়িত্ব সরকার না নিলে কংগ্রেস
ভাড়া দিয়ে দেবে। বিভিন্ন রাজ্যের প্রদেশ নেতৃত্বকে সেই নির্দেশ জানিয়ে দিলেন
কংগ্রেস সভানেত্রী। এর পরেই নড়ে বসল কেন্দ্র। ৫ মে বিজেপি মুখপাত্র সম্বিত পাত্র ঘোষণা
করে, পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেন ভাড়ার ৮৫% রেল দেবে। রাজ্য সরকার ১৫% ভাড়া দেবে।
কিন্তু বাড়িমুখো শ্রমিকদের অভিঞ্জতা ভিন্ন। নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করেই তাঁদের
আস্তে হয়েছে।
১৪ সেপ্টেম্বর বাদল অধিবেশনের প্রথম দিনে লিখিত
প্রশ্ন করা হয়েছিল। জানতে চাওয়া হয়েছিল, লকডাউনে চলাকালীন কতজন পরিযায়ী শ্রমিকের
মৃত্যু হয়েছে? মৃত শ্রমিকের পরিবারকে কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে কি? উত্তরে
শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ার জানান, লকডাউনের সময় কতজন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু
হয়েছে সে সম্পর্কিত তথ্য সরকারের কাছে নেই। সেই কারণে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও উঠছে
না। ১৫ সেপ্টেম্বর কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি বিদেশ থেকে করা এক ট্যুইট বার্তায়
কেন্দ্রীয় সরকারকে আক্রমণ করেন। লেখেন, ‘সকলে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু দেখেছে,
শুধু মোদী সরকারের কাছে খবর নেই।’
সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম ট্যুইট
করেন, ‘লকডাউনের সময় হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে শত শত পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে,
সেই বিষয়ে কোনও তথ্য নেই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। কিন্তু ২ কোটি অবৈধ
অনুপ্রবেশকারী ভারতে বসবাস করছেন তার রেকর্ড ঠিকঠাক রাখা আছে।‘’
ভারতের আত্মা কাঁদছে। আপনারা শুনতে পাচ্ছেন না।
ভারতের আত্মার কথা শুনলেন না। শুনতে পেলেন না। গণতান্ত্রিক অধিকারহীন নাগরিক। কাজ
হারিয়ে মৃত্যু মিছিলের হাহাকারের নিঃশব্দ উচ্চারণ আজও শোনা যায়। রাস্তায় কান পেতে।
রেল লাইনে কান পেতে! রাজদরবারের ঝাড়বাতি যেন রক্তাক্ত রুটি।
Comments
Post a Comment