গর্বের প্রযুক্তির ভারতে বঞ্চনার শিক্ষা
দীপেন্দু চৌধুরী
‘ডিজিটাল ভারত’ গর্বের ভারত। উচ্চ শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত ভারত। তথ্যপ্রযুক্তি
শিল্পে ভারতের অবস্থান গর্ব করার মতো বিষয়। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে নিযুক্ত ভারতীয়
দক্ষ কর্মীদের চাহিদাও সারা বিশ্বে তুঙ্গে। প্রচার মাধ্যমের ঢক্কানিনাদ আমাদের
সামনে এক উজ্জ্বল ভারতের কথা শোনালেও আসল ছবি আমরা জানতে পারলাম কিছুদিন আগে। করোনা
ভাইরাসের থাবা আমাদের সমাজকে ভেঙে সত্য তথা বাস্তবের স্তরগুলোকে নতুন করে চিনতে
শেখাচ্ছে। অতিমারির কারণে প্রায় ছমাস সমস্ত রকমের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়
বন্ধ।
কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে পরিসংখ্যান মন্ত্রকের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা। সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা
গেল, সারা দেশে সাক্ষরতার হার ৭৭.৭ শতাংশ। এই হারের মধ্যেই আলাদা ভাবে উল্লেখ করা
হয়েছে, পুরুষ ৮৪.৭ শতাংশ এবং মহিলা ৭০.৩ শতাংশ। সর্বমোট সাক্ষরতা হারের মধ্যে। চলতি
বছরের পরিসংখ্যান আমরা আলোচনায় উল্লেখ করলাম। একটু পিছনের দিকে তাকান যাক।
২০১১ সালে একটি সমীক্ষার তালিকা প্রকাশ হয়েছিল। ওইসিডি-র আর্থিক সহায়তায়
‘পিসা’ নামক একটি সমীক্ষা সংস্থা তালিকাটি
প্রকাশ করে। সেই সমীক্ষা তালিকায় দু’তিনটি বিষয়ে সমীক্ষা চালান হয়েছিল। ১) সারা
বিশ্বের ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের অংক কষা। ২) মাতৃভাষায় ছাপার অক্ষরে লেখা
২০-২৫ লাইন গড় গড় করে পড়তে পারার দক্ষতা। মোট ৭৪ টি দেশের প্রায় এক কোটি পড়ুয়াদের
মধ্যে এই সমীক্ষা করা হয়। এই সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছিল, সমীক্ষা তালিকায় ভারতের
শিশুদের স্থান ৭৩-তম হিসেবে। ‘পিসা’-র প্রকাশিত প্রথম সংস্থার বার্ষিক শিক্ষা
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সারা ভারতের শিশুরা সহজ যোগ-বিয়োগ করতে পারে না। মাতৃভাষায়
পড়া এবং লেখা সেটাও আশাব্যঞ্জক বলা যাবে না।
পরিসংখ্যান মন্ত্রকের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, আমাদের
রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে নারী পুরুষ একসঙ্গে ধরে সর্বমোট সাক্ষরতার হার ৮০.৫ শতাংশ।
আলাদা আলাদা হিসেবে পুরুষ ৮৪.৮ শতাংশ এবং মহিলা ৭৬.১ শতাংশ। ২০১১ সালে রাজ্যে
নিরক্ষতার হার ছিল ৩৩.৫৮ শতাংশ। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণের হার ছিলো
যথাক্রমে ৬.৮ শতাংশ এবং ৩.৫ শতাংশ (সুত্র- SECC 2011 )। তুলনামূলক হিসেবে গত ৯ বছরে
রাজ্যে সাক্ষরতা বৃদ্ধির হার গড় হিসেব দেখলে অন্তত কিছুটা আশা জাগায়। সারা দেশের
সঙ্গে তুলনায়। কিন্তু বিতর্ক অন্য জায়গায়। আমরা সেই প্রসঙ্গে যাব। আমাদের স্বীকার
করতে হবে, ইউপিএ সরকারের আমলে ‘শিক্ষার অধিকার আইন’ পাস হয়েছে। তারপরের ছবি আমরা
তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।
২০১১ সালের বিশ্বব্যাঙ্কের মানব উন্নয়ন রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দারিদ্র
সূচকে ভারতে ৫২.৭ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক ভাবে বঞ্চিত। সেই সময়ে ৪১.৬ শতাংশের দিনে
উপার্জন ছিল ১.২৫ ডলারের নিচে। ২৮.৬ শতাংশ ছিল অতি-দরিদ্র এবং ১৬.৪ শতাংশ ছিল
দরিদ্র প্রবণ। এই হিসেব আজ থেকে ৯ বছর আগের। গত ৯ বছরে কতটা উন্নত হয়েছে? ৬
সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসের পরের দিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য
টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি বড় ছবি প্রকাশিত হয়েছে। জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ি
রাস্তা। সেই পাকদণ্ডি রাস্তায় তিনজন হেঁটে হাসি মুখে প্রাথমিক স্কুলে যাচ্ছেন। তিন
জনের মধ্যে দু’জন শিক্ষক, একজন সাংবাদিক। নিচে ক্যপশনে লেখা, ‘প্যারা টিচার মারটিন
সয় (রাইট) অ্যান্ড বরজু সয় (থার্ড ফর্ম রাইট) ওয়াক অ্যাক্রস এ ফরেস্টেড হিল অন
দেয়ার ওয়ে টু মেকশিফট প্রাইমারি স্কুল এ্যাট টুটকোরা ভিলেজ ইন খুন্তি, ঝাড়খণ্ড।
..................মারটিন অ্যান্ড বরজু ট্রেক ৮ কিমি ( ৪ কিমি ইচ ওয়ে) ডেইলি।
মারটিন হ্যাজ বিন মেকিং দ্য জার্নি ফর দ্য পাস্ট ১৭ ইয়ার্স অ্যান্ড বরজু ফর ১৪
ইয়ার্স, আস্কড অ্যাবাউট অনলাইন টিচিং ডিউরিং দ্য লকডাউন, বরজু সেইড, ‘’উই ক্যান নট
ডু দ্যাট ইভেন ইফ উই ওয়ান্ট টু।‘’ দ্য স্টুডেন্টস ডু নট হ্যাভ স্মার্টফোনস অ্যান্ড
দ্য এরিয়া হ্যাজ নো নেটওয়ার্ক কভারেজ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আশা করি আপনার ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’-র ছবি
দেখেছেন। অথবা আমার এই লেখা পড়ার পরে দেখে নেবেন। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ
পোখরিয়াল নিশঙ্ক আপনিও আশা করি খবরটা দেখেছেন। ৬ সেপ্টেম্বরের ‘দ্য টেলিগ্রাফ’
পত্রিকার ৫-এর পাতায় নিচের প্যানেলে খবরটা বিস্তারিত আছে। গ্রাম ভারতের প্রকৃত ছবি
আপনাদের জন্য। আপনাদের আর্থিক সহতায় পুষ্ট ভারতীয় মিডিয়া চেষ্টা করলে ‘ভারততীর্থ’
থুরি ভারতের শিক্ষাতীর্থের প্রকৃত ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরতে পারে। ঝা চকচকে পণ্য
সভ্যতায় শিক্ষাও বর্তমানে পণ্য। প্রাচ্যের মূল্যবোধ ভাঙা প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা
গ্রাম ভারতে কোন জায়গায় আছে সেই ছবি আমরা ৬ সেপ্টম্বরের একটি ইংরেজি দৈনিক থেকে
জানতে পারলাম। জাতীয় নতুন শিক্ষানীতি কি ইন্টারনেটে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পনা
ভবিষ্যৎ ‘রোডম্যাপে’ রাখবে? গ্রাম ভারতের বাস্তব ছবির কথা মাথায় রেখে? এবার
আপনাদের উচ্চশিক্ষিত ভারতের আরও একটি উজ্জ্বল পরিসংখ্যানে নজর দেওয়া যাক।
করোনা আবহে টানা লকডাউনের কারণে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস
শুরু হয়েছে। তারপরে পরীক্ষা চালু হতেই ঝোলা থেকে বেড়াল বেরিয়ে এল। সত্যি করেই
প্রমাণ হয়ে গেল ‘ডিজিটাল বিভাজন’-র আসল তথ্য। আমার এক বন্ধু চিত্রসাংবাদিক। থাকে
কলকাতার উপকন্ঠে। নিজের স্মার্টফোন নেই। বড় মেয়ে ইংরেজি অনার্স নিয়ে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটি কলেজে পড়ছে। তাকে একটি স্মার্টফোন কিনে দিতে হয়েছে। ছোট
মেয়ে অষ্টমশ্রেণীর ছাত্রী। ছোট মেয়েকে আরও একটি স্মার্টফোন কিনে দেওয়া তার পক্ষে
সম্ভব হয়নি। স্কুলের অন্য ছাত্রীদের সঙ্গে অষ্টমশ্রেণীর
ছাত্রীটি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষা বিষয়ে সদ্য প্রকাশিত জাতীয় নমুনা
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ভারতে কম্পিউটার আছে মাত্র ১০.৭ শতাংশ পরিবারে। ইন্টারনেট
সংযোগ আছে ২৩.৮ শতাংশ পরিবারে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে কম্পিউটার আছে ৯.৪ শতাংশ
পরিবারে। ইন্টারনেট ১৬.৫ শতাংশ পরিবারে। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক দাবি করছে,
উপরোক্ত দুটি সমীক্ষা করা হয়েছে ২০১৭-র জুলাই থেকে ২০১৮-র জুনের মধ্যে। তাই গত
দু’বছরের হিসেব অন্য কথা বলছে। মোবাইলে ইন্টারনেট পরিষেবা সস্তার হওয়ার কারণে
স্মার্টফোনের মাধ্যমে বর্তমানে ঘরে ঘরে ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছে গিয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রকের এই দাবিকে যেমন ভারতের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন মেনে নিতে
পারছে না। আমরাও মেনে নিতে পারছি না। প্রত্যন্ত গ্রাম ভারতের ছবি আমরা তুলে ধরতে
চেষ্টা করেছি। এটা ব্যতিক্রমী ঘটনা এমনটা বলা যাবে না। দেশের যে কোনও রাজ্যের জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ি অঞ্চল এবং
সাগর নদী বেষ্টিত উপকূলবর্তী প্রত্যন্ত এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবার কি হাল একটু
সচেতনভাবে নজর করলেই বোঝা যায়। তাই পেড প্রচার মাধ্যমের আলো দিয়ে সভ্যতার দৈন্যতা
আড়াল করা যায় না। শিক্ষামন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা এনসিইআরটি আলাদাভাবে যে সমীক্ষা
করেছে সেই সমীক্ষা থেকে জানা গেল, ২৭ শতাংশ পড়ুয়া ল্যাপটপ, স্মার্টফোন হাতে পাচ্ছে
না। ২৮ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীর ইন্টারনেট সংযোগ নেই। এর পরেও কর্পোরেট সামাজিকতায়
আমাদের বলতে হবে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ সফল!
Comments
Post a Comment