কলকাতায় যারা মৌন মিছিলে হেঁটেছিল




দীপেন্দু চৌধুরী

করোনা নামক ভাইরাস বিশ্ব সভ্যতাকে যে ভাবে আক্রমণ করেছে তার থেকে আমরা কেউ রেহাই পাইনি। জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস বুরো ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে কৃষি ক্ষেত্রে গত এক বছরে আত্মহত্যা করেছেন ১০, ২৮১ জন। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের যে রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে সেই রিপোর্ট থেকে পাওয়া যাচ্ছে, এক বছরে ভারতে ৩২, ৫৬৩ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন। শতাংশের হিসেবে ২৩.৪ শতাংশ। আমাদের এই দেশ বহুজাতিক বাসভূমি। সংবিধান বিশেষঞ্জরা বলছেন, একটি রাষ্ট্রসংঘ। অনেক আলোচনাতেই এসেছে গ্রাম ভারত আর শহর ভারত দু’টি আলাদা রাষ্ট্র। ভারত এবং ইন্ডিয়া আলাদা আলাদা পরিচিতি নিয়ে গড়ে উঠেছে অথবা গড়ে তোলা হয়েছে। ২০১১ সালের সেনসাস রিপোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য ‘গ্রাম ভারত’-এ দেশের ৭৩.৪৪ শতাংশ পরিবার বসবাস করেন। উল্টোদিকে ‘শহর ইন্ডিয়া’-য় থাকেন বাকি ২৬.৫৬ শতাংশ।

প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে শহর ভারতের খবর আমরা দ্রুততার সঙ্গে পেলেও গ্রাম ভারতের সম্পূর্ণ চিত্র আমাদের সামনে সঠিকভাবে আসে না। সামাজিক মাধ্যমের রমরমার সময়েও অপ্রতুল ইন্টারনেট ব্যবস্থার কারণে গণমাধ্যমেও গ্রাম ভারতের খবর উঠে আসে না। গ্রাম ভারতের ৮৮.৪ কোটি জনসংখ্যার ৩৫.৭৩ শতাংশ নিরক্ষর। প্রাথমিক বিদ্যালয় উত্তীর্ণের হার ১৭.৭৮ শতাংশ। এই হিসেব ২০১১ সালে সেনসাস ( Socio Economic and Caste Census, SECC 2011 ) থেকে উল্লেখ করছি। তারপরে ৯ বছর পার করে এসেছি আমরা। দেশের এই ব্যবস্থার কতটা উন্নতি হয়েছে সেটা সমাজ বিঞ্জানী এবং সংবাদ মাধ্যম বলতে পারবে।

গ্রাম ভারতের পাশাপাশি শহর ইন্ডিয়ার ছবিও খুব কিছু ভালো নয়। গত ছ’ বছরে ভারতের গণতন্ত্র এবং সংবিধান যেভাবে আক্রান্ত, দেখে মনে হচ্ছে উদার ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী ভারতীয় নাগরিক নিরাপত্তার অভাবে ভুগছে। সারা বিশ্বের কোনও কোনও দেশে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের পরিবর্তে ‘নিয়োলিবারাল’ রাজনীতির পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। সমাজ বিঞ্জানীরা বলছেন, চিনে যেমন এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রথম থেকেই চলে আসছে। সেখানে আলাদা মাপের রাখঢাক নেই। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়াত রাশিয়ার (ইউএসএসআর) পতনের পর নব্য রাশিয়ার নেতৃত্ব নিয়োঅর্থনীতি এবং নিয়োলিবারাল রাজনীতির পরীক্ষা শুরু করেছেন এই উদারবাদী গণতন্ত্রের আড়ালে উঁকি দেয় একনায়কতন্ত্রের ঝোঁকযে ঝোঁক ২৪৪ বছরের প্রাচীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রে দেখা যাচ্ছে। রিপাবলিকান পার্টির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে এই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছেরাষ্ট্রের সংবিধান এবং গণতন্ত্রের ভিত টলিয়ে দিয়ে ব্যক্তি ট্রাম্প নিজের গড়ে তোলা অনৈতিক নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন বলে দাবি ডেমোক্রাটদেরকতটা পারবেন সেটা চলতি বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বলে দেবে। ট্রাম্পের দেশ পরিচালনার নীতি দেশের কতটা ক্ষতি করতে পারে সে বিষয়ে সতর্ক করেছেন প্রথম সারির মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কি। গণতন্ত্রের আধারে গণতন্ত্রের যে ক্ষতি করা হচ্ছে তাকে আটকাতে মার্কিন নাগরিকদের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

ভারতের দিকে তাকালেও ‘জাতীয়তাবাদী’ স্লোগানের আড়ালে, এক ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত এক দলীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার ঝোঁক নজরে পড়বেযেটাকে ভারতীয় গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করে নতুন গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে। নিয়োলিবারাল অর্থনীতির প্রেক্ষাপট নির্মাণ? চাকরির বাজারের কথা ভুলে ব্যাঙ্ক, রেল, রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে কেন?  প্রতিনিধিত্বমূলক ভারতীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে আর এক নয়া গণতন্ত্র!  ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’ নামক নিয়োলিবারাল গণতন্ত্রের রোডম্যাপ আমাদের সামনে কৌশলে হাজির করা হচ্ছে নাতো?

এটা যদি মুদ্রার একপিঠ হয় উল্টোদিকে রয়েছে,  ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। বা লেখা যাবে না। তা হলেই রাষ্ট্রবিরোধী বলে দেগে দেওয়া হবে। সাম্প্রতিকতম উদাহারণ ডাঃ কাফিল খান এবং প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত কিশোরের লব্ধ অভিঞ্জতা। মহামান্য আদালতকে সম্মান জানিয়েই ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এই কথা লিখছি। যে কথা ডাঃ কাফিল খান জেল থেকে বেরিয়ে বলেছেন। মহামান্য আদালতের রায় মেনে নিয়ে আইনজীবী প্রশান্ত কিশোর এক টাকা জরিমানা দিয়েছেন।

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধা কৃষ্ণানের জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বরতার সম্মতিতে ভারতেআজকের দিনে শিক্ষক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। প্রাচ্যের শিক্ষা ছিল মূল্যবোধের শিক্ষা। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল সমাজ গড়ে তোলার সম্পর্ক। মূল্যবোধ ভিত্তিক নতুন যে শিক্ষার কথা বর্তমানে সারা বিশ্বে আলোচনা হচ্ছে। ভারতে দু’দশক আগেও এই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এই দিনে জানতে ইচ্ছে করছে ভারতের গণমাধ্যমের কর্মীরা কেমন আছেন? কারণ আমাদের শিক্ষকরাই সাংবাদিকদের গড়ে তুলেছেন।    

ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রসঙ্গে লিখতে গিয়েই আজকের দিনের কথা বেশি করে মনে পড়ছে। ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সালের এই দিনে দুষ্কৃতিদের গুলিতে খুন হয়েছিলেন সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। তিনি সাংবাদিকতা করতেন, টাইমস অব ইন্ডিয়ায়। পরে গৌরী নিজেদের পারিবারিক সংবাদপত্র ‘লঙ্কেশ পত্রিকা’-র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। বাবা পি লঙ্কেশ এই পত্রিকা শুরু করেছিলেন। বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী গৌরীর প্রতিবাদী কলম সুবিধাবাদী এবং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর রাজনীতির কুশিলবদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। তাঁর প্রতিবাদী কলম বন্ধ করতে লঙ্কেশ পরিবারে শুরু করে দেওয়া হয় অশান্তির বাতাবরণ। গৌরী বাধ্য হন বাবার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ছাড়তে। নিজেই শুরু করেন নতুন পত্রিকা। তার নিজের নামে সম্পাদিত নতুন পত্রিকার নাম ছিল ‘গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকা’। সম্পাদক সাংবাদিক গৌরীর জনপ্রিয় নির্ভীক শক্তিশালী কলম ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের মাথা ব্যথার অন্যতম কারণ।

সাংবাদিক হিসেবে গৌরী যে কোনও খবরকে গঠনমূলক সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখতন। যে কারণে ভারতে প্রথম শ্রেণীর সাংবাদিক হিসেবে সামনের সারিতে পাকা জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। সৎ, প্রতিবাদী নির্ভীক নিরপেক্ষ ভারতীয় এবং উপ মহাদেশ সহ বিশ্বের যে কোন প্রান্তের সাংবাদিকদের উপর আক্রমণে গর্জে উঠত তার প্রতিবাদী কলম। একটি সাক্ষাৎকারে গৌরী বলেছিলেন, "When I looked at the tweets and the kind of comments that were made about me, I was alarmed... It made me fear for the freedom of expression of the fourth estate in our country today in a larger context and not just in the personal sense."

After the legislative assembly sentenced two journalists to one year in jail for publishing articles that they considered defamatory, she wrote: "Legislators have no business to sit in judgement on journalists and it is high time they are stripped of their special privileges." সৌজন্যঃ বিবিসি নিউজ। তারিখ- ৬ সেপ্টম্বর, ২০১৭ 

বর্তমান বিশ্বে মাত্র দু’টো এমন পেশা আছে যে পেশা আমন্ত্রণ জানায় জীবন উৎসর্গের। মৃত্যুর কিছুদিন আগে লিখেছিলেন শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক লাসান্থা বিক্রম সিংহে। পেশা দু’টি হচ্ছে সেনাবাহিনী এবং সাংবাদিকতা। ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি ঘাতকের গুলিতে সাংবাদিক লাসান্থার প্রাণ যায়। ২০১৮ সালে সারা বিশ্বে কর্মরত অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন ৯৪ জন সাংবাদিক।  দেড় বছর আগে করা একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের সমীক্ষায় বলা হয়েছিল সাংবাদিক হত্যার তালিকায় ভারতের স্থান পঞ্চম। সংগঠনটির মতে পাকিস্তান, ফিলিপিন্স এবং ভারতে সাংবাদিক হত্যার কারণ যুদ্ধ অথবা সংগঠিত অপরাধচক্র নয়। স্বাধীন গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বরের প্রতি রাষ্ট্রের অসহিষ্ণুতা। ২০১৭ সালে কর্নাটকে গৌরী লঙ্কেশ এবং ২০১৮ সালে শুজাত বুখারির হত্যা সারা দেশের সচেতন নাগরিক সমাজকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল।

২০১৭ সালে গৌরী লঙ্কেশ হত্যার প্রতিবাদে কলকাতায় একটা মৌন মিছিলে আমরা হেঁটেছিলাম। আয়োজন করেছিল কলকাতা প্রেস ক্লাব। সেই মৌন মিছিলে আমাদের সঙ্গে হেঁটেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শরৎ সন্ধ্যা। আমাদের হাতে প্রতিবাদের প্ল্যাকার্ড। হাতে মোমবাতি। প্রেস ক্লাব থেকে মেয়ো রোড, পার্ক স্ট্রীট, জওহরলাল নেহরু রোড হয়ে আবার আমরা প্রেস ক্লাবে ফিরেছিলাম। অহিংসা এবং সত্যাগ্রহ আন্দোলনের দু’জন ঋত্বিক, গাঁধি এবং নেহরুর মূর্তি ছুঁয়ে সেদিন আমরা হেঁটেছিলাম। পদাতিক সাংবাদিকদের স্বাধীন কন্ঠের সমর্থনে। সাম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে দু’জন সাংবাদিকের মৃত্যু আমাদের আবার পদাতিক সাংবাদিকদের মিছিলে হাঁটতে বলছে। যে ভাষা আমাদের শিখিয়েছেন গৌরী লঙ্কেশ। সৎ, নির্ভীক প্রতিবাদী সাংবাদিক আত্মসমর্পণ করে না। এদের মৃত্যু হয় না। এরা মানুষের মাঝে বেঁচে থাকে। চিরদিন চিরকাল।             

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?