মর্মরিত শুকনো পাতার দামামা আজও শুনতে পাই
দীপেন্দু চৌধুরী
স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে ওরা কেমন আছে? আনুষ্ঠানিকতায় ওদের যতটা আপ্যায়ন থাকে
সামাজিক পরিসরে, সত্যিই কি ওরা মূল
স্রোতের অধিকার অর্জন করতে পেরেছে? আজকের বর্তমানকে নিয়ে হৈ চৈ করার গণতান্ত্রিক
অধিকার আমাদের আছে। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে প্রায় হারিয়ে যেতে চাওয়া
মানবাধিকার থেকে চুঁইয়ে পরা আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে আমার চোখে, আমার মনে, আমার আত্মশক্তিতে।
আত্মনির্ভর ভারতীয় সমাজের সমাজবাদী চেতনার মানদন্ডে। সংখ্যালঘু, দলিত মানুষের
সঙ্গবদ্ধ শক্তিতে, আদিবাসী মানুষের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ভরসায়। শ্রমজীবী মানুষের
ঐকতান সুরে। ওই মানুষগুলো। হ্যা, ফেলে আসা অতীতের ওই উপজাতি মানুষগুলোর মাঝে
অতীতের সারল্য, নীমতেল মাখা কালো কুচকুচে চামড়ায় আজকের সমাজেও খুঁজে পাওয়া যায়।
পাহাড়ে পাহাড়ে, পাহাড়তলিতে প্রতিধ্বনি শোনা মানুষেরা আজও জঙ্গলমহলের আত্মীয়। শাল,
সেগুন, মেহগনি, মহুল গাছের সবুজ সামাজিকতায় ওরা পাকদন্ডি রাস্তায় চলতে অভ্যস্ত। বিশ্বায়ন
সভ্যতার নিওন আলো, এলইডি আলোর ঝলকানি ‘বাবু সমাজ’-র মলে ওদের ভিড়তে অধিকার দিলেও
‘জলচল’ ওরা নয়। ওরা আদিবাসী, ওরা উপজাতি। ওদের অতীত
ইতিহাস আছে।
ইতিহাসবিদরা জানাচ্ছেন, আদিবাসীদের শতকরা ৯৫ ভাগেরও বেশী হচ্ছে কৃষিজীবী।
ভাষাগতভাবে ওঁরাও বাদে সব আদিবাসীদের ভাষা অষ্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত। আদিবাসীদের মধ্যে
গত এক দশক আগেও একসঙ্গে যৌথভাবে বসবাস করার সংস্কৃতির প্রচলন ছিল। যৌথ পরিবার
প্রথা মেনে চলতে দেখা গেছে এই শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত। নারীদের সম্মান
দেওয়াটাই রেওয়াজ এই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের। সামাজিক বিবাহের মধ্যে বধূধন প্রথা
চালু ছিল। পাত্র পক্ষের তরফে বধূধন হিসেবে কিছু নগদ টাকা এবং নতুন বস্ত্র দেওয়া
হত। সেটা ছিল নাম মাত্র। কৃষ্টি সংস্কৃতির মানদণ্ডে। এই সংস্কৃতি নারীর সম্মান
দাবি করে বলেই মনে হয়। গ্রাম মোড়লের উপস্থিতিতে এই লেনদেন সম্পন্ন হত। মনোনীত মোড়ল
বা মুখিয়ারা পঞ্চায়েত ব্যবস্থার শরিক। আদিম সভ্যতার মূলবাসী হিসেবেই আদিবাসীরা ছিল
পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। পশ্চিমী বহুজাতিক সংস্কৃতির দাপুটে ঝড় ঝাপটা এই
উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের ‘শিশুমন’, অনুভূতিতে আঘাত হানল। আধুনিক সভ্যতার করাল
অভিঘাতে ওরাও জেনে গেল ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’। ধনতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ওদের
জানান দিল, ভাগ হয়ে যাও। তোমারটা তুমি বুঝে নাও। পরিবার ছোট করে বাস কর। খোঁজ নিয়ে
জানা গেছে, বর্তমান সময়ে এই বধূধন দেওয়ার প্রথার চলও আর নেই।
আধুনিক সভ্যতার অভিভাবকরা সফলভাবে নীতি প্রয়োগ করল ভাগ কর শাসন কর।
আদিবাসীদের সাম্রাজ্যে প্রথম নজর পড়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের। ১৭৬০ সালে ঝাড়খন্ড অঞ্চলে
নজর পড়ে ব্রিটিশ শাসকদের। ১৭৬৫ সালে বাদশা দ্বিতীয় শাহ আলম ছোট-নাগপুর রেঞ্জে ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধিকার মেনে নেয়। জঙ্গলের অধিকার থেকে ক্রমশঃ আদিবাসী সমাজ
পিছনে হটতে শুরু করে। বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, মাটির নীচে কয়লা, কালো পাথর। এসব
কিছুর অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকে তারা। ‘ঝাড়’ অর্থাৎ জঙ্গল আর এই জঙ্গলকে
কেন্দ্র করে যে জনবসতি ছিল তাকে বলা হত ‘খন্ড’। ঝাড়খন্ড বা ছোট-নাগপুরের বিস্তৃতি
মূলত অবিভক্ত বিহার, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ
এবং পশ্চিমবাংলায়। ১৯৭১ সালের সেনসাস রিপোর্টে আছে, উল্লেখিত চারটে রাজ্যের ১৬ টা
জেলাকে কেন্দ্র করে গভীর জঙ্গলঘেরা বনবস্তিতে আদিবাসীদের বসবাস ছিল। ১৯৭১ সালে মোট
আদিবাসী জনসংখ্যা ছিল ৩, ৮০, ১৫, ৬২০। যেটা শতকরা হিসেবে দাঁড়ায় মোট জনসংখ্যার ৬.৯২%।
অবিভক্ত বিহারের ৭টি জেলা, পশ্চিমবঙ্গের ৩টি জেলা। ওড়িশার ৪টি জেলা এবং
মধ্যপ্রদেশের ২টি জেলা। এই হিসেব ১৯৭১ সালের লোকগণনার সময় পর্যন্ত। ভারতে
আদিবাসীদের বিষয়ে মূলস্রোতের ভারতীয়দের এখনও বিভিন্ন ভুল ধারণা রয়েছে। এই
সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে কৌতূহল থাকলেও স্পষ্ট
ধারণা নেই অনেকের।
২০১৯ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ৩০
সেপ্টেম্বর সাহিত্য অকাদেমীর কলকাতার আঞ্চলিক অফিসের সভাঘরে একটি অনুষ্ঠান হয়। সেই
অনুষ্ঠানে সাওতালি ভাষার কবি সুবোধ হাঁসদা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, বর্তমান
ভারতে ৮ শতাংশ আদিবাসী আছে। পরিকাঠামোর অভাবে আদিবাসী ভাষাকে অনুবাদের মাধ্যমে মূল
স্রোতের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়নি। আদিবাসী ভাষার অনুবাদও অপ্রতুল। সাওতালি
সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সংস্কার, মূল্যবোধ আজও এক সামাজিক বন্ধন দাবি করে।
আদিবাসী এবং ছোট-নাগপুরের প্রেক্ষাপটে বাংলা উপন্যাস সঞ্জীবচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ ( উনবিংশ শতাব্দী), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’
এবং মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’। আদিবাসীদের জঙ্গলের অধিকারচ্যুতি থেকে
বাঁচাতে ইউপিএ সরকার ‘অরণ্যেরর অধিকার আইন’ আনলেও জঙ্গলের আদিবাসীদের বঞ্চনার কতটা
লাঘব হয়েছে সেটা কয়েকটি তথ্যে নজর রাখলে বোঝা সম্ভব। একটি বেসরকারি সংস্থা এবং
সরকারি সংস্থার রিপোর্ট থেকে উঠে আসছে ৭ শতাংশ আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষ জানিয়েছেন,
প্রাথমিক বিদ্যলয়ে যাওয়ার জন্য তাঁদের পরিবারের সন্তানদের এক কিলো মিটারের বেশি
হাঁটতে হয়। শিক্ষার অধিকার আইনে বলা আছে, শিশুর বসত বাড়ি থেকে এক কিলোমিটারের
মধ্যে বিদ্যালয় করতে হবে। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলছে। এই রিপোর্ট থেকে আরও জানা
যাচ্ছে, ৬৮ শতাংশ শিশুর টিকাকরণ কার্ড হলেও ৫৮ শতাংশ শিশুর টিকাকরণ সম্পূর্ণ করা
গেছে। করোনা আবহে ভাবতে পারছেন? আমাদের দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল? ৪৪
শতাংশ আদিবাসী পরিবারের শৌচাগার নেই। এদের মধ্যে আবার ৫ শতাংশের বাড়িতে শৌচাগার
থাকলেও সেগুলি ব্যবহারযোগ্য নয়।
রিপোর্টটি খুব পুরনো নয়। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটি এবং প্রতীচী
ইন্সটিটিউটের একটি যৌথ রিপোর্ট প্রকাশ করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য
সেন। রিপোর্ট প্রকাশ করে অধ্যাপক সেন মন্তব্য করেছিলেন, ভারতের উন্নয়নে আদিবাসীরা
উপেক্ষিত। তিনি বলেছিলেন, ‘’আদিবাসীদের উন্নয়নে আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে।‘’
মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ ছবির কথা। উৎপল দত্ত অভিনীত মণিমামা
আফ্রিকার জঙ্গল, অ্যামাজনের জঙ্গল সহ সারা বিশ্বের আদিবাসীদের সঙ্গে কাটিয়ে ফিরে
গেলেন ছোট-নাগপুর রেঞ্জের বীরভূমে। শান্তিনিকেতনে। সেখানে হাঁড়িয়া নিয়ে আদিবাসীদের
নাচ দেখছেন। মহুল রসে মন ভিজিয়ে শুকনো পাতার মর্মরিত আওয়াজ শুনছেন। আদিবাসী
মাদলের ছন্দে কালো কুচকুচে মেয়েরা নিজেদের ছন্দে নাচছে। মণিমামা ডেকে নিলেন ভাগ্নিকে।
অভিনেত্রী মমতা শঙ্করকে। বাস্তব জীবনেও মমতা শঙ্কর নৃত্যশিল্পী। মিলে গেল
রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ, রামকিঙ্কর। মিলে গেল সাদা চামড়া কালো চামড়া। ‘’তাদের
জিঞ্জাসা করো! যে পাখীরা গান গায়, / যে ঝর্ণারা নিশ্চিত মনে এদিকে ওদিকে ছুটোছুটি
করে, / যে বাতাস এই উপমহাদেশের মধ্যকার মানচিত্র থেকে মর্মরিত হয়, / যে ধর্ষিতা
অরণ্যের বুক চিরে সোনার ফসল লুট হয়, তারা সকলেই উত্তর দেবে...............।‘’
Comments
Post a Comment