সচেতন চেতনা নব জাগরণের দ্যোতনা জাগায়




দীপেন্দু চৌধুরী 

৬ অগস্ট ২০১৯, প্রভাতি সংবাদপত্রের প্রথম পাতার শিরোনাম ছিল ‘রাজ্য নয় কাশ্মীর’। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করার প্রস্তাব তার আগের দিন অর্থাৎ ৫ অগস্ট পাস করিয়ে নেয় মোদী সরকার। পরেরটা ইতিহাস। প্রায় একবছর আগে ওই দিন হাতে গোপন নথি নিয়ে হাসি মুখে সংসদে এসেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য সুহৃদ অমিত শাহের মুখে সত্যিই সেদিন এক বিজয়ীর হাসি ছিল। ভাবটা এরকম ‘আমি জয়ী’ আমাদের জয় হয়েছে। আমরা পারি। দেখ আমাদের সমালোচকরা আমরা সংসদীয় পথে আজ জয়ী। হ্যা, সত্যি সত্যি জয় আস্তে বেশি সময় লাগেনি। বিল লোকসভায় পাশ হয়ে ৩৭০ ধারার বিলোপ হয়েছে। বিশেষ মর্যাদার অধিকার হারিয়েছে জম্মু-কাশ্মীর। ওই রাজ্যকে ভেঙে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয়েছে। এটা একটা অধ্যায়। এই অধ্যায়ের শুরুতেই জম্মু-কাশ্মীরের দুজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে আটক করে ‘গৃহবন্দি’ করে রাখা হয়। একবছর পরে জম্মু-কাশ্মীরের অর্থনীতির কি হাল? সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কাশ্মীর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সেখ আসিক আহমেদ জানিয়েছেন, গত একবছরে জম্মু-কাশ্মীর কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসেবে খুচরো ব্যবসা এবং বৃহৎ বাণিজ্য মিলিয়ে সর্বমোট ৪০,০০০ কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়েছে। এই হিসেব কাশ্মীর বিভাগের ১০টি জেলার। রাজ্য প্রশাসনের দাবি, এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র শাসিত জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ১০ হাজার নতুন চাকরির দরজা খুলে যাবে রাজ্যের বেকার যুবকদের জন্য।            

দীর্ঘ সুদীর্ঘ যাত্রা পথ ছিল জম্মু-কাশ্মীররের সাফল্যে গেরুয়া পতাকা উড্ডীন দেখার। অন্তত বিজেপি নামক গৈরিক বাহিনীর সদস্যদের কাছে। আর মাত্র চার দশক আগে গণতান্ত্রিক ভারতে ব্যতিক্রমী এবং বিতর্কিত আরও একটি রাজনৈতিক পরিক্রমা শুরু হয়েছিল। আশির দশকে রাম-রথ নিয়ে বেড়িয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আডবানী। সারা দেশে রাম জন্মভূমি আন্দোলনের সমর্থনে এই পরিক্রমা করেছিলেন বিজেপি দলের অন্যতম নেতা আডবানী। সেই রথ আটকে দিয়েছিলেন বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব। সেই রথের পরিক্রমা বাস্তবে রূপ পেতে চলেছে এ বছর অগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে। আর কোনও বাঁধা নেই সামনে কারণ মহামান্য আদালতের রায় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রয়েছে। ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর প্রভাতি সংবাদপত্রের প্রথম পাতার শিরোনাম ছিল মন্দির বিতর্কিত জমিতে। আমরা কাগজে পড়লাম ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’-করসেবকদের স্লোগানই সত্যি হল। ৯ নভেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-র নেতৃত্বাধীন সুপ্রীম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ রায় দিয়েছিল বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি হিন্দুরা পাবেন। এবং সেখানে তৈরি হবে রামমন্দির। ১৯৯৩ সালে বিতর্কিত জমি ঘিরে কেন্দ্র যে অতিরিক্ত ৬৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে রেখেছিল, কেন্দ্র চাইলে সেই জমিও মন্দির প্রকল্পের জন্য ট্রাস্টকে দিতে পারে। ১,০৪৫ পৃষ্ঠার রায় দিতে গিয়ে  মহামান্য আদালত মেনে নিয়েছে, ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদের মূল গম্বুজের নীচে গোপনে রামের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে মসজিদ অপবিত্র করা ও মুসলিমদের হঠানো আইনসঙ্গত হয়নি। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙাকেও ‘আইনের শাসনের গুরুতর লঙ্ঘন’ হিসেবে রায়ে বলা হয়েছে। শীর্ষ আদালতের রায়ে এ সব থাকলেও ৫ অগস্ট করোনা আবহের মধ্যেই অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভূমিপুজো এবং শিলান্যাস করতে যাবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মুঠো মুঠো বিতর্ক নিয়ে এই অনুষ্ঠান হচ্ছে বলে বিরোধীদের দাবি। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধির অভিযোগ, মোদী দেশ চালাচ্ছেন প্রথমে নোট বাতিল, তারপরে জিএসটি,করোনা মোকাবিলায় চরম ব্যর্থতা। মানুষের রোজগার নেই। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। ২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নোট বাতিল ঘোষণা করার পরে আয়কর দফতর সূত্রে খবর ছিল, ৪ লক্ষ কোটি টাকার লুকনো আয় সরকারের হাতে আসবে। আয়কর দফতরের এক অফিসার বলেছিলেন, নোট কান্ডের পরে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ফেরৎ আসা মোট টাকার পরিমাণ ৭.৩৪ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে? বিরোধীদের অভিযোগ যদি সেই টাকা ব্যাঙ্কে ফিরে এসে থাকে তার হিসেব কোথায়?  

করোনা নামক এক অতিমারির সময়ে আমাদের দেশের নাগরিকদের জন্য সরকারের দায়িত্ব তুলনামূলকভাবে দেখা যাক। উদাহারণ, বিভিন্ন দেশের করোনা প্যাকেজ। আমেরিকার সরকার প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক পিছু ১২০০ ডলার দিয়েছে। ব্রিটিশ সরকার কাজ হারানো নাগরিকদের ৮০% বেতন দিয়েছে। জাপান সরকার প্রত্যেক নাগরিককে ১০০০০০ ইয়েন দিয়েছে। সেখানে ভারতে মোদী সরকার কাজ হারানো অসহায় গরিব পরিযায়ী শ্রমিকদের থেকে ৪২৮ কোটি টাকা ট্রেনের ভাড়া নিয়েছে।  কংগ্রেসের আরও অভিযোগ, দেশের ঋণ এই সরকারের আগে কখনও ৮২ লক্ষ কোটি টাকা হয়নি। কংগ্রেস সরকারকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে ১.৭৬ কোটি টাকা নিতে হয়নি। কর্পোরেট মালিকদের ৪ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করে দেওয়া হল কোন যুক্তিতে?    

এক কথায় রাহুল বলতে চেয়েছেন, ‘’মোদীর পুঁজিবাদী মিডিয়া মায়াজাল তৈরি করেছে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি ভুল ভেঙে যাবে।‘’ সিপিএমের অভিযোগ, দেশের মানুষের কাজ নেই। চাকরি হারিয়ে খেটে খাওয়া বেকার চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কথা না ভেবে কেন্দ্র সব বেঁচে দিচ্ছে। রাজকোষ ঘাটতি মেটাতে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া মোদী সরকার লাভজনক বিপিসিএল, কনকর, এলআইসি-র কিছুটা অংশ এবং ৭ টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বিক্রি করে দিতে চাইছে। এই ছবি মোদী সরকারের দেউলিয়া অবস্থা ছাড়া কি প্রমাণ করে? সিপিএম দলের আরও অভিযোগ, জিডিপি বৃদ্ধির হার ৩.১ শতাংশ, সেটাও কমে যাচ্ছে। ভারতে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার জুন ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছিল ২৩.৫ শতাংশ। এখন কিছুটা কমলেও স্বাধীনতার পরে সর্বচ্চো বেকারত্ব বৃদ্ধি হয়েছে গত কয়েক বছরে। রাজ্য বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের অভিযোগ, গোটা দেশে করোনা আক্রান্ত যখন ১২ লক্ষ অতিক্রম করেছে, প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা ৪৫,০০০ এরও বেশি, কেন্দ্রীয় সরকার তখন হাসপাতাল নয় মন্দির উদ্বোধন করতে ব্যস্ত।

যদি আলোচনার প্রয়োজনে ধরেও নেওয়া যায় যে রাজনীতির কারণে বিরোধী দল অভিযোগ করছে। এর কারণ রাজনৈতিক সুবিধা লাভ। কিন্তু বাস্তব দাবি করছে আরও অতি বাস্তবতা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০১৬ থেকেই দেশের অর্থনীতির হাল অত্যন্ত খারাপ। ভারতের প্রথম সারির অর্থনীতিবিদদের দাবি, ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের মার্চ মাসে ১৬০০ কোটি ডলার মূল্যের বিদেশি লগ্নি ভারতের হাতছাড়া হয়। গুরুতর এই অভিযোগ কি অমূলক বলা সম্ভব?

ভারতের আম নাগরিক প্রাত্যহিক জীবনে করোনা অতিমারির সময়ে প্রতি নিয়ত জীবন যুদ্ধে রয়েছে। বেঁচে থাকার লড়াই করছে। অথচ কেন্দ্র আজও উদাসীন। ইতিমধ্যে শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। ৩৪ বছর পরে নতুন শিক্ষানীতি আনতে চলেছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। বিরোধী দলগুলি সুদূর প্রসারী এই নীতির মধ্যে এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম এক জাতির ইঙ্গিত খুঁজে বের করতে চাইছে। ভারতে ৯০ শতাংশ দলিত, আদিবাসী এবং নিম্ন বর্গের মানুষের বাস। এই ভাগের অনেকটা অংশ নিম্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের। যাদের কোনও মর্যাদা গ্রাম ভারতে আজও নেই। মাত্র ৬ শতাংশ ব্রাহ্মণ। দেশের জাতিভেদ প্রথা বা জাতপাতের বিষয়টা আজও এক করুণ অধ্যায়।  

আমরা প্রশ্ন তুলে রাখতে চাইছি ভারত এখনও একটি ধর্ম নিরপেক্ষ এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই দেশে নানা ভাষা, নানা মত, নানা ধর্মের, নানা জাতির মানুষ আমরা একসঙ্গে বসবাস করি। সেখানে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভারতের সচেতন নাগরিক অনুমোদন করবে কি? ৫ অগস্ট অযোধ্যায় প্রস্তাবিত রামমন্দির নির্মাণের শিলান্যাস করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসারে। কংগ্রেস দাবি করছে এবং প্রচার করছে, ১৯৮৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধির আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি নিয়ে অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভূমি পুজো এবং শিলান্যাস হয়েছিল। বিজেপি নতুন করে যে অনুষ্ঠান করছে, সেটা বিভিন্ন রাজ্যের ভোটকে সামনে রেখে এই অনুষ্ঠান করছে। কংগ্রেসের এই দাবির পরে বলতে হয় যে কংগ্রেস দলকে এতদিন যারা সংখ্যালঘুদের দল হিসেবে দেখত সেই ধারণা পাল্টাতে হবে। ভারত যে বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির সম্মেলনের একটি ঐক্য মঞ্চ কংগ্রেসের এই দাবি থেকে উপলব্ধি করা যায়।

২০১৯ সালে হারিয়ে যাওয়া চেতনা কি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তি ফিরে পাচ্ছে? যে উত্তরণের আকাঙ্খা প্রতিটি দেশের অবরুদ্ধ গণতন্ত্রে অবচেতনে হোক অথবা সচেতন চেতনায়, নবজাগরণের দ্যোতনা জাগায়। ২০২০ সালে ভারতে লোকসভার নির্বাচন না থাকলেও চলতি বছরে ঠিক হবে, ভারত নামক দেশটি তার ঐতিহ্যশালী বহুত্ববাদ, উদার ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামো ধরে রাখতে কি পারবে? না পারবে না? ভারতে তথা কলকাতায় জনবাদী সমাবেশ আমাদের আশা জাগাচ্ছে।

( তথ্যসূত্রঃ আনন্দ বাজার পত্রিকা। এই লেখায় কোনও ব্যক্তি, ধর্ম বা সম্প্রদায়কে আঘাত করতে চাইনি। সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে লেখাটি লিখেছি।)        

                              

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?