অবরুদ্ধ শশ্মানে সৃষ্টির আহ্বান



দীপেন্দু চৌধুরী

একদিকে যেমন ভাঙে প্রকৃতি আবার ফিরিয়েও দেয়। করোনা পরিবেশে এ বছর আমাদের দেশের তথা আমাদের বাংলার বর্ষাভাগ্য ভালো বলতে হবে। দীর্ঘ তিনমাস সাড়ে তিনমাস লকডাউন থাকার জন্য বাস,গাড়ি, অটো চলেনি। বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক অনেক কম। জলবায়ু পরিবর্তনের সংযোজিত অংশ বলা যায়। দূষণ কম হওয়ার কারণ হোক অথবা প্রকৃতির উদারতা, বর্ষা এই বছর বর্ষার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, পত্রসাহিত্য, ছেলেবেলা, বর্ষাবেলার স্মৃতি ফিরিয়ে দিল। জল পড়ে পাতা নড়ে। টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে/ নদেয় এল বান......। বৃষ্টির ছন্দের আনন্দে বুলবুলি পাখির একটানা শিষ চেনা পাখিদের বৃষ্টিস্নান শেষে সন্ধ্যায় গাছভেজা নীড়ে ফেরা। শীত গ্রীষ্মের ঘুম ভেঙ্গে ব্যাঙের গ্যাঙর গঙ, গ্যাঙর গঙ একটানা আওয়াজ। কখনও একক ছন্দে, আবার কখনও বা সমবেত কন্ঠে। যেন ফিরে পাওয়া নিজেদের সভ্যতার আনন্দচেনা সভ্যাতা চেনা ঋতুতে। ওদের করোনা ভাইরাসের চিন্তা নেই। ওরা থাকে ওদের গোষ্ঠীবদ্ধ সামাজিকতায়।         

করোনা ভাইরাসের মৃত্যুমিছিল ব্যক্তি ‘আমি’-কে পরিবার সমাজ নতুন ভাষায় চিনতে শেখাচ্ছে। সমাজ পরিবারকে প্রতিবেশীদের চিনতে জানতে বলছে। কোথাও কোভিড রুগীকে সামাজিক ভাবে প্রতিবেশীদের ঘৃণায় পাড়া ছেড়ে, নিজের ঘর ছেড়ে অন্যত্র থাকতে হচ্ছে। সামাজিক বয়কটেরমতো পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে বাধ্য হতে হচ্ছে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের। ছবিটার উল্টো দিকও আছে। করোনা রুগীকে পাশের প্রতিবেশী তরুণ নিজে পিপিই পড়ে, মাস্ক পড়ে নিজের বাইকে চাপিয়ে হাসপাতালে পৌচ্ছে দিচ্ছেন। মানবিক গল্প। বেঁচে থাকার আহ্বান। সামাজিক ভাষার আনন্দ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে এমনতর মানবিক গল্প অনেক আছে। সভ্যতার আলো আমাদের পথ চিনতে বলছে। পথে নামতে আমন্ত্রণ করছে। পথিক পথ ভোলেনায়। আধুনিক সভ্যতা মানবিকতা ভোলেনি।

পত্র উপাত্যকা-১  

এই বর্ষার সময় আমি দু’টি চিঠি খুঁজে পেলাম। একটা সত্যেনের। সত্যেন আমার বন্ধু। সত্যেনের একটা চিঠির ফাইল আমার কাছে আছে। সেই ফাইলে ওর কিছু চিঠি রয়েছে। ওকে যারা চিঠি দিয়েছিল সেইসব চিঠি। আজকাল কেন প্রায় গত চল্লিশ বছর ‘রানার’-এর ঘণ্টা বাজে না। ঝুম ঝুম ঘণ্টাও আর বাজে না। একা প্রিয়া কিন্তু আজও রাত জেগে থাকে। ‘রানার! রানার!/ এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?/ রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?’  সত্যেনের স্ত্রী একা রাত জেগে থাকত। বর্ষামুখর দিনরাতের লড়াইয়ে। কুড়ি কুড়ি বছর আগে, তেইশ তেইশ বছর আগে। সত্যেন আর্থিক বিপর্যয়ের পরে কলকাতা ছেড়ে পরিবার নিয়ে নিজেদের গঞ্জ শহরের মাটির বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল। সত্যেনের স্ত্রী কলকাতার শিক্ষিত মহিলা। তার কাছে শুনেছি। ওরা দু’বছর ছিল ওই মাটির বাড়িতে। যদিও সত্যেন ছোটবেলা থেকে কলেজ জীবন পর্যন্ত ওই মাটির বাড়িতে থেকেই বড় হয়েছে। তারপর জীবীকার প্রয়োজনে আবার কলকাতায় ফিরে আসেসত্যেনের স্ত্রী মজা করে আমাকে বলেছিল, জানেন সে এক অদ্ভুত অভিঞ্জতা। মাটির বাড়ি। বারান্দা সহ দু’টো ঘর। বর্ষার সময় ঘর ছাইতে দেরি হলে রাতের আকাশে চাঁদের আলো এসে লুটোপুটি খেলত। জোনাকি ঘরের ভেতর সুখের ডানা মেলে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো। সে এক রোমাঞ্চকর অভিঞ্জতা। সত্যেন শিখিয়েছিল বর্ষার সময় খড়ের চাল ফুটো হয়ে জল পড়লে গামলা, বালতি, থালা পেতে রাখতে। আমি তাই করতাম। নিশুত রাতের ভয়ের থেকে আমাকে ‘বৃষ্টি মজা- মজাবৃষ্টি’খেলায় পেয়ে বসেছিল। স্যাঁতসেতে মেজেতে পলিথিনের বস্তা পেতে রাখতাম। পরপর তিনদিন বৃষ্টি তিনদিন রাতজেগে ‘বৃষ্টিমজা-মজাবৃষ্টি খেলা। মাটির দেওয়ালে টাঙ্গানো শরৎচন্দ্রের ছবিওর এক বন্ধু এঁকে দিয়েছিল। আপনি চেনেন তাকে। পেন্সিল স্কেচ। শরৎবাবু আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, শরৎবাবু এক অসামান্য নারীর গল্প লিখুনআমি সেই রাতগুলিতে অসামান্য এক নারীকে খুঁজতাম। এক সাধারণ মেয়ে হয়ে স্বামীর ভিটেয় থেকেছি। বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছোয়নি। যে চিঠির কথা দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম সেই চিঠিটা সত্যেনের স্ত্রীকে লেখা সত্যেনের মায়ের। ৭৫ পয়সার ইনল্যান্ড লেটার খামে লেখা। এই খামের সুবিধা ছিল আলাদা করে কাগজে লিখতে হয় না। তিনি লিখছেন,  

তারিখঃ ১৪-৪-৯৫

কল্যানীয়া বৌমা,

তোমরা আমার শুভ নববর্ষের আশীর্বাদ নিও। আশা করি তোমরা ভালো আছ। আমার যাওয়া হল না। হয়ত তোমরা চিন্তিত। ........................। আরেকটি কারণ হল ঘর ছাওয়া হয়নি। যদি কালবৈশাখীর নৃত্য আরম্ভ করে তা হলে ঘরের ছাওনির অস্তিত্ব বজায় থাকবে না। যদি ঘরটায় খড় চাপানো যেত তাহলে নিশ্চিন্ত হতাম। এদিকে খরচও কম নয়, ৪০০-৫০০ টাকা লাগবে। এত টাকা জোগার করা আমার ক্ষমতা নয়। বছরে একবার এসে মায়ের পুত্ররা যদি তার কুঁড়ে ঘরটা ঠিক করে না দেয়, তাহলে সে থাকে কোথায়? আসলে পুত্ররা থাকে অট্টালিকায়। তাঁরা আর কুঁড়ে ঘরের মর্ম কতটা বুঝবে! দু-দশ দিনের জন্য অট্টালিকা ভোগ করে লাভ কি? যদি সেই কুঁড়ে ঘর আমার বাসস্থান হয়! তোমরা বল জ্যোতিকে নিয়ে আমায় কলকাতায় থাকতে। কিন্তু আমার স্বামীর বাসস্থান ছেড়ে কোথাও থাকতে মন চায় না। তোমার পাঠানো ২০০ টাকা পেয়েছি। জ্যোতির এবার রেজাল্ট বেড়বে। ওর এবার ভালো মাস্টার চাই। চারিদিকে নানা চিন্তা ভাবনার মধ্যে আমার এই ফুটো চাল ও ছেঁড়া ক্যাথা খুবই উপযুক্ত। তোমরা দুঃখ পেওনা। ইতি আশীর্বাদিকা মা।

পত্র উপত্যকা-২

চিঠিতে ‘জ্যোতি’ নামের একজন এসেছে। জনান্তিকে পাঠকদের বলে রাখি, জ্যোতি সত্যেনের এক দাদার ছেলে। শৈশবকাল থেকেই জ্যোতি ঠাকুমার কাছে মানুষ। জ্যোতির সব খরচ খরচার দায়িত্ব সামলাত সত্যেনহয়ত বিদগ্ধ পাঠকের কৌতূহল হতে পারে! ভুরু কুঁচকে পরিহাসের ভাষায় বলতে পারে এসব আমারা জেনে কি করব? হক কথা। খুব ঠিক কথা। জহুরির কাজ ধাতু চেনানো। সত্যেন একসময় সাহিত্য চর্চা করত। লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করত। ছোট গল্প লিখত। তারপর একদিন নাগরিক কলকাতায় হারিয়ে গেল! সত্যনের স্ত্রী আক্ষেপ করে বলে তেইশ তেইশ বছর পর ওকে কেউ কেউ লিখতে বলছে! সত্যেন কোনও উত্তর দেয় না। মানসিক অবসাদ? সাহিত্যের পাঠচক্রের ছাত্র ছিল সত্যেন। রাজনীতির পাঠচক্রের ছাত্র ছিল। পত্র সাহিত্যেও হাত পাকিয়েছিল। সত্যেন আমার থেকে বয়সে পাঁচ-ছয় বছরের ছোট। মনে আছে তখন ও গঞ্জের বাড়িতে থাকত। কলকাতায় এক বন্ধুর সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করত। সে বছর কলকাতায় এসে আমাকে পায়নি। শান্তিনিকেতনের ঝোলা থেকে প্যাড বের করে খচ খচ করে কয়েক লাইন লিখে রেখে চলে গিয়েছিল। এই পরিচ্ছেদেও চিঠিটা লিখে দিই। না হলে কেমন অসম্পূর্ণ হবে। লেখকের নামে কালী পড়বে! তাই না? সত্যেন গোটা গোটা অক্ষরে লিখছে,

তারিখঃ ২০-৭-৮৯

প্রিয় দ্বীপেনদা,

আমি এসেছিলাম। কিন্তু দীর্ঘ প্রতীক্ষাও মিলনে বাধ সাধল। যাইহোক! বিশেষ কোন সংবাদ না থাকলেও এবার কলকাতার বিভিন্ন কাজের সঙ্গে তোমার দেখা পাওয়া বেশ অনুভবের ছিল।

আমরা সবাই ভাল আছি। বৌদির সাথে কিছুক্ষণ সন্ধ্যাবার্তা হল। তোমার উপস্থিতি পূর্ণতা আনত।

তোমার সত্যেন

১৩৩৪ সালের বিচিত্রায় স্মৃতিচারণায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন চল্লিশ বছর আগের স্মৃতি। ‘’বহুকাল পূর্বে, তখন বয়স অল্প, ঘরে কিংবা বাইরে খাতির করবার লোক নেই— লেখা আরম্ভ করেছি কিন্তু সে লেখা দূরে পৌঁছয়নি। আমার কাছে দেশের লোকের বা বিদেশের লোকের কোনো প্রত্যাশা ছিল না। .........তখন মাসিকপত্র দুটি-চারটি তার মধ্যে যারা প্রবল কন্ঠশালী তারা ছিল আমার নিয়ত প্রতিকূল। সাপ্তাহিক যে কয়টি ছিল তারা কেউ আমার প্রতি প্রসন্ন ছিল না, তাই আমার দায়িত্ব ছিল প্রধানত আমার নিজের কাছেই। তখন না ছিলেম অখ্যাত, না ছিলেম বিখ্যাত। ছিলেম প্রত্যাখ্যাত। তখন বাংলাদেশের নির্জন নদীর চরে ছিল আমার যাওয়া আসা। সম্পূর্ণ নিজের মনেই লিখে যেতুম, শোনবার লোক কেউ ছিল না তা নয়, ছিল দুটি-চারটি।‘’  

রবীন্দ্র উত্তর যুগ পেরিয়ে বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ হয়ে তারাশঙ্কর, বিভূতি, মানিক টপকে আমরা সতীনাথ ভাদুড়িকে পেয়েছিলাম। পরে সমরেশ বসু, শক্তি সুনীল সন্দীপন, শীর্ষেন্দু, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী আমাদের চিনতে শিখিয়েছে ভদ্র সমাজের কৌলিন্য কেমনতর হয়! পারিবারিক জীবন, সামাজিক ঘাত প্রতিঘাত আমরা চিনেছি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একবার রবীন্দ্রনাথকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি ইংরেজি ভালো জানি না। তাই পশ্চিমের ভালো বই আমার পড়া হয় না। তবু সমালোচকদের সঙ্গে একমত হয়ে বলতে হবেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধযায় অবরুদ্ধ শশ্মনে সৃষ্টির আনন্দ শুনতে পেয়েছিলেন। সতীনাথ ভাদুড়ি শুনতে পেয়েছিলেন। মানিক বিভূতি শুনেছেন। শীর্ষন্দু শুনেছেন। সত্যেনেরমতো অনেকের জীবনের অণুগল্প, ছোট গল্প জুড়েই বড় গল্পের আল্পনা আঁকা যায়। শশ্মান অবরুদ্ধ হোক। জীবন আজও গতিময়। গতিশীল জীবনের নতুন অধ্যায় লেখা হবে আগামীতে।             

                                       

 

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?