‘মানুষের মধ্যে একটাই সত্য, ভাগ্যটাই মায়া’
দীপেন্দু চৌধুরী
আমাদের ক্ষুদিরাম ওদের...............। শহীদ ক্ষুদিরামের আত্মবলিদানের দিন।
এই ধরণের একটা স্লোগান সহ পোস্ট সম্প্রতি দেখা গেল সামাজিক মাধ্যমে। বড্ড দেরি হয়ে
গেল বন্ধু। ভারতে ক্ষুদিরাম, কানাইলাল, ভগত সিংদের নিয়ে ব্যপক প্রচার কয়েক দশক আগে
থেকে ধারাবাহিকভাবে করে যাওয়াটাই ছিল আমাদের দায়িত্ব। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জানাটা অত্যন্ত প্রয়োজন। গত কয়েক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে
উগ্র এক অতি দক্ষিণপন্থী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সুপরিকল্পিতভাবে শুরু হয়েছিল, সেটা
কংগ্রেস সহ ভারতের অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তি এবং বামপন্থীরা হয় টের পায়নি, না হলে এই বিষয়ে
উদাসীন থেকেছে। যার মূল্য আজ দিতে হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক নাগরিকদের।
ভারতের অংশীদারি গণতন্ত্র আজ আক্রান্ত। ব্যাপক পরিসরে এক অশুভ শক্তি ঘিরে ফেলতে
চাইছে। স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি
সুভাষচন্দ্র বসু এদের এখন আমাদের বড় বেশি প্রয়োজন।
গাঁধিজী লিখছেন, ‘ব্যারাকপুরে স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর বাড়ি গিয়ে
তাঁর সঙ্গে দেখা করার সৌজন্য আমার হয়েছিল। আমি শুনেছিলাম, উনি অসুস্থ এবং বার্ধক্য
ইস্পাত কঠিন চেহারায় ছাপ ফেলেছে। সেইজন্য আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম এবং শ্রদ্ধা জানানোর
জন্য আগ্রহী ছিলাম। যদিও তিনি আমার কিছু কিছু কার্যকলাপ সমর্থন করেননি তবু নতুন
বাংলার রূপকার এবং ভারতীয় রাজনীতিতে বাগ্মিতা ও পান্ডিত্যের জন্য ভারতীয় ‘নেস্টার’
হিসেবে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বিন্দুমাত্র কমেনি। আমার সেই সময়কার কথা মনে আছে
যখন শিক্ষিত ভারতবর্ষ তাঁর মুখে ভাষা পেত। ............... তিনি বললেন, যদি আপনি
ব্যারাকপুরে আসার সময় না পান, আমিই আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাব। আমি বললাম, আপনাকে
কষ্ট দেব না, আমি অবশ্যই সময় করে আসব।’ (ইয়ং ইন্ডিয়া, ১৪ মে, ১৯২৫, পৃষ্ঠা-
১৬৯-৭০)
স্বাধীনতা পূর্ব ভারতের এই ঘরানার সংস্কৃতির পরিচয় আমরা বিভিন্ন ঘটনা, লেখা
ইত্যাদিতে পাই। মার্গ দর্শনের যুগে নেহরু-গাঁধি ঘরানার ঐতিহ্য প্রায় হারিয়ে যেতে
বসেছে। নতুন ঘরানার ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের কান্ডারী নরেন্দ্র মোদী ভারতে একটি
আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্রের উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, ভীতি ছাড়া প্রীতি হয় না।
উদাহারণ দিয়েছেন, রামচন্দ্র ধনুক তোলার পরই সমুদ্র নড়ে বসেছিল। পরোক্ষভাবে ভয়ের
পরিবেশের কথা শুনিয়ে রাখলেন। যে ভয় একুশ শতাব্দীর ভারতে আমরা ২০০২ সাল থেকে
পাচ্ছি। গত শতাব্দীর নব্বই দশকের ৬ ডিসেম্বর যে ভয়ের পরিবেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের
সামনে এসেছিল। যে কথা প্রথম পরিচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। সুপরিকল্পিত এই ধরণের উগ্র
ঘরানার সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিষয়ে উদাসীন ছিলাম আমরা। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ
গণতান্ত্রিক তথা রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী। করোনা সভ্যতার শুরুর আগে দিল্লিতে যে ভয়
আমরা পেয়েছি। ভারতের উদার, গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক হিসেবে আমরা ভয়
পাচ্ছি। একদিকে দলিত হিন্দু ভয় পাচ্ছে, ভারতের সংখ্যালঘু নাগরিকরা আতঙ্কিত হতে হতে
মুহ্যমান হয়ে সামাজিক মেলামেশা করছে! এই দেশের ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্রের কথা বলে
গেছেন ভারতের বরেণ্য দেশ নায়করা? আমার এক প্রবীণ সাংবাদিক বন্ধু আজ হতাশ আতঙ্কিত।
গত পঞ্চাশ বছর সাংবাদিকতা করেন বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী এই সাংবাদিক। ৭৫ বছরের
প্রবীণ মানুষটি নিজে সংখ্যালঘু এবং নিজের পরিবারের আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক
সব ধরণের নিরাপত্তা রয়েছে। তবু তিনি আতঙ্কিত এবং হতাশ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কাউকে
বিশ্বাস করতে পারছেন না। আক্ষেপ করে বলেন, কংগ্রেস দলটা এতটা দুর্বল না হলে লড়াই
করার শক্তি পাওয়া যেত।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে জাতীয় কংগ্রেসের গুরুত্ব যে অপরিসীম সেটা উল্লেখ
করতেই হবে। গত শতাব্দীর বামপন্থীরা যেমন সীমাবদ্ধতা রেখে কংগ্রেসের সঙ্গে নীতি এবং
কৌশল তৈরি করতেন। একুশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে অনেক অনেক বিতর্কের পর ভারতের জাতীয়
কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ আন্দোলন করার সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছে মূল ধারার বামপন্থী
নেতৃত্ব। এই বছর ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবসে ‘সংবিধান বাঁচাও’ দিবসের আহ্বান দিয়েছে
বামেরা। আমাদের রাজ্যে সিপিএম রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব
যৌথভাবে ‘সংবিধান বাঁচাও’ আন্দোলনে সামিল হয়েছে। আমাদের উপলব্ধি ভারতে বামেদের আশু
কাজ হল অংশীদারি গণতন্ত্রের স্বার্থে, ভারতের সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনে
জাতীয় কংগ্রেসের একটি বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করা। এবং সমস্ত বামপন্থী শক্তিকে একজোট
করে সেই মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা। গত কয়েক দশক বামপন্থী দলসমূহ এবং জাতীয়
কংগ্রেসের দ্বিধাদ্বন্দের কারণে ভারতে অংশীদারি গণতন্ত্র দুর্বল হয়েছে। দেশে এক
অজানা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এই ভয় কাটাতে গেলে আমাদের একই সূত্রে
বাঁধতে হবে সহস্রটি প্রাণ।
যে শক্তির কথা অনেক আগে বলে গেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। ‘সমস্ত
মানবজাতির মধ্যে সত্য ভ্রাতৃভাব জাগাইতে হইলে ভিন্ন ভিন্ন জাতি সমূহকে বিকশিত
করিতে হইবে। তাহার পূর্বে এই ভ্রাতৃভাব অসার কল্পনা মাত্র। জাতি তুলিয়া দিলে
বিশ্বমানব দাঁড়াইবে কোথায়? যেমন প্রত্যেক ব্যক্তির বিকাশ না হইলে একটি পরিবারের
উন্নতি হয় না। যেমন পরিবার সমূহের উন্নতি না হইলে সমাজের উন্নতি হয় না, যেমন
সমাজের উন্নতি না হইলে জাতির উন্নতি হয় না। ঠিক তেমনি সেই একই কারণে সকল ভিন্ন
ভিন্ন বিশিষ্ট জাতির উন্নতি না হইলে সমগ্র মানবজাতির উন্নতি হয় না।’ (দেশবন্ধু
রচনাসমগ্র, রাজনৈতিক প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা- ৭৪/৭৫, প্রকাশকঃ তুলি কলম)।
কেমনভাবে মিলে যাচ্ছে নেহরুর সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের চিন্তা। ১৯৫০
সালের ২৬ জানুয়ারি ‘’ সার্বভৌম, প্রজাতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয়,
সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ’’ ভারতের অন্যতম আকর গ্রন্থ প্রকাশের দিন
সংবিধান-সভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে আবেগঘন এবং উদাত্ত কন্ঠে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী
জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘’এই সভার প্রথম কাজ, একটি নতুন সংবিধানের মাধ্যমে ভারতকে
মুক্ত করা, ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাদ্য জোগাতে পারা, বস্ত্রহীন মানুষের পরনে
বস্ত্র জোগাতে পারা, প্রতিটি দেশবাসীকে তার নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী বিকাশের সব রকম
সুযোগ দিতে পারা।‘’
সংবিধানের এই মূলমন্ত্র এবং সংস্কৃতিকে বাঁচানোর দায়িত্ব আজ আপামর
ভারতবাসীর। করোনা আবহেও সংবিধানের মূল অংশকে কেটে টুকরো টুকরো করে দিতে চাইছে
যারা, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, বন্ধু ১৩০ কোটি দেশে মাত্র দেড়কোটি মানুষ কর
দেয়। আমাদের মুখ ‘আয়হীন মুখ’। ‘ইনকামলেস ফেস’। এই আমাদের দেশ। হ্যা, আমি
‘আত্মনির্ভর’ আমার জন্মভূমির কথা বলছি।
সেই দেশের মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অপরাধের বিরুদ্ধে, ভ্রষ্টাচার,
বেরোজগারির বিরুদ্ধে বললেই অপরাধ? নারীর অধিকার, কিসানের অধিকার নিয়ে বললেই অপরাধ?
উত্তর প্রদেশে সাংবাদিক বিক্রম জোশী হত্যা যে ঘটনা প্রমাণ করে। সংবিধান আজ
আক্রান্ত তবু আমরা চুপ করে থাকব? আওয়াজ তুলব না? জেল ভরো আন্দোলনের জন্য ভারতীয়দের
প্রস্তুত হতে হবে। রাজনৈতিক পরিভাষা সেই দাবি আজ উত্থাপিত করছে।
রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘’............ য়ুরোপে অন্য সকল দেশেরই
সাধনা ব্যক্তির লাভকে ব্যক্তির ভোগকে নিয়ে। তারই মন্থন আলোড়ন খুবই প্রচন্ড, আর
পৌরনিক সমুদ্র মন্থনের মতোই তার থেকে বিষ ও সুধা দুই-ই উঠেছে। কিন্তু সুধার ভাগ
কেবল এক দলই পাচ্ছে। অধিকাংশই পাচ্ছে না--। এই নিয়ে অসুখ অশান্তির সীমা নেই। সবাই
মেনে নিয়েছিল এটাই অনিবার্য...... কিন্তু সোভিয়েতরা বলতে চায় তার থেকে বুঝতে হবে
মানুষের মধ্যে ঐক্যটাই সত্য, ভাগ্যটাই মায়া।‘’
Comments
Post a Comment